মাহমুদুল হাসান
১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০২:০৫ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ডেঙ্গুর চাপে ব্যাহত নিয়মিত চিকিৎসা

ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুসন্তানকে কোলে নিয়ে মা। ছবিটি রাজধানীর মুগদা হাসপাতাল থেকে তোলা। কালবেলা

অসুস্থ হলে রাজধানীর মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষের ভরসার জায়গা ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। এখানে মোট শয্যার প্রায় দ্বিগুণ রোগী সবসময় চিকিৎসা নেন। মেঝেতে বিছানা পেতে হলেও রোগী ও তার স্বজনরা এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে চান। কিন্তু হাসপাতালের দুই নম্বর ভবনের মেডিসিন ওয়ার্ড এখন ডেঙ্গু রোগীর দখলে। প্রতিদিন রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলার জটিল ডেঙ্গু রোগীরা ঢামেক হাসপাতালে ছুটে আসছেন। এতে অন্য রোগে আক্রান্তরা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

গতকাল শুক্রবারও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৫৮ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হন। সেখানে এখন ৩১১ রোগী ভর্তি। এমন চিত্র শুধু ঢামেক হাসপাতালে নয়, দেশের বেশিরভাগ হাসপাতাল ডেঙ্গু রোগীতে পূর্ণ। সরকারি তথ্যমতে, দেশের হাসপাতালগুলোর প্রায় ১০ হাজার শয্যা ডেঙ্গু রোগীর দখলে। এতে ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক চিকিৎসাসেবা।

খুমেকের মেডিসিন ওয়ার্ড ডেঙ্গু রোগীদের দখলে:

খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পাঁচটি মেডিসিন ওয়ার্ডে নির্ধারিত ২০০ বেডের মধ্যে গত ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৬০ বেডে ডেঙ্গু রোগী ছিলেন। যদিও এসব ওয়ার্ডের বারান্দা, করিডোরসহ মোট ভর্তি ছিলেন ৭০০ থেকে ৮০০ সাধারণ রোগী। তবে এতসংখ্যক ডেঙ্গু রোগীর জন্য হাসপাতালের অন্যান্য সেবায় বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে বলে হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে। হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মেডিসিন ওয়ার্ড পাঁচটি। এতে নির্ধারিত ৪০টি করে ২০০টি শয্যা রয়েছে। তবে প্রতিটি ওয়ার্ডে ডেঙ্গু রোগীর জন্য নির্ধারিত ৪টি বেড পূর্ণ হয়ে বারান্দা, করিডোর, লিফটের সামনে এমনকি চলার পথেও ডেঙ্গু রোগী রয়েছেন। হাসপাতালে সার্বক্ষণিক মশারি টানিয়ে রাখার কথা থাকলেও সেখানে গিয়ে বেশিরভাগ রোগীকেই মশারি ছাড়া শুয়ে থাকতে দেখা গেছে। এতে অন্য সাধারণ রোগীরও ডেঙ্গু হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। যদিও চিকিৎসকরা বলছেন, মশারি ছাড়া থাকলেই যে অন্য রোগীদের ডেঙ্গু হবে, এমনটি নয়। তবে মশারি টানিয়ে রাখা উচিত।

সাধারণ রোগীরা জানান, ডেঙ্গু রোগীদের জন্য হাসপাতালে অন্যান্য রোগীর চিকিৎসায় বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে। জালাল নামে এক রোগী বলেন, তার রক্তের পরীক্ষা করতে বলেছেন চিকিৎসক। তিনি প্যাথলজি বিভাগে গিয়ে শোনেন আজকের মতো সিবিসি পরীক্ষার স্যাম্পল নেওয়া হয়ে গেছে, আর সম্ভব নয়। এতে বাধ্য হয়ে তাকে বাইরে থেকে পরীক্ষা করাতে হয়েছে। একই অভিযোগ রয়েছে একই ওয়ার্ডের আরও দুজনের।

হাসপাতালের পরিচালক ডা. রবিউল হাসান বলেন, শুধু ডেঙ্গু রোগীদের জন্য অন্য রোগীর সেবা বিঘ্ন হচ্ছে, এটা সঠিক নয়। ৫০০ বেডের হাসপাতালে ১ হাজার ৭০০-এর বেশি রোগী থাকছেন সবসময়। এতে করে প্রত্যেক রোগীর আশানুরূপ সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

বরিশালে ডেঙ্গু রোগীর চাপ, ঠাঁই নেই হাসপাতালে:

বরিশালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী যেভাবে হাসপাতালে প্রতিদিন আসছেন, তাতে চিকিৎসক-নার্স ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের উদ্বেগ বেড়েই চলেছে। এই পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেবেন, এ নিয়ে তারা দুশ্চিন্তায়। তারপরও চিকিৎসক -নার্স ও কর্মচারীদের মনোবল ভাঙেনি। তারা বলেন, সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাব তাদের চিকিৎসার জন্য। আমরা এখন মহাবিপদে আছি। হাসপাতালের কোনো বিছানা খালি নেই। ওয়ার্ডের বারান্দা, করিডোর, সিঁড়ির নিচে কোথাও পা রাখার জায়গা নেই। রোগী আর রোগী। সবাই ডেঙ্গু রোগী। এই রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে অন্য রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া ঠিকভাবে হচ্ছে না। তা ছাড়া রোগীদের চাহিদা অনুযায়ী চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ানসহ অন্যান্য জনবলের সংকট রয়েছে।

গত ১০ সেপ্টেম্বর শেবাচিম হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, চিকিৎসক-নার্সরা ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা নিয়ে ছোটাছুটি করছেন। তাদের কথা বলারও সময় নেই। তারা বলেন, আমাদের বিলম্বের কারণে একজন রোগীর মৃত্যু হতে পারে। এ পরিস্থিতিতে চেষ্টা করে যাব, যেন কোনো ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসাসেবা যেন ব্যাহত না হয়।

শেবাচিম হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. এসএম মনিরুজ্জামান বলেন, প্রতিদিন রোগীর চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় ডেঙ্গু কর্নার চালু করা হয়েছে। তারপরও অত্যধিক রোগীর চাপে হিমশিম খাচ্ছি।

রংপুরে সাধারণ ওয়ার্ডে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা:

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মেডিসিন ওয়ার্ডের সাধারণ রোগীদের ওয়ার্ডে (আলাদা ইউনিট) দেওয়া হচ্ছে ডেঙ্গু আক্রান্তদের চিকিৎসা। ডেঙ্গু রোগীর জন্য আলাদা ওয়ার্ড না করায় সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে মেঝে ও বারান্দায়। গত ১০ সেপ্টেম্বর বিকেলে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডে গিয়ে এ চিত্র দেখা গেছে। সিজনাল রোগে আক্রান্ত হওয়ায় মেডিসিন বিভাগের রোগীর চাপ বেড়েছে বহুগুণে। এ কারণে মেডিসিন ওয়ার্ডের বারান্দা, মেঝে কোথাও ফাঁকা নেই। সব খানে রোগীতে ঠাসা। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছ, বর্তমানে হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন ২৩ জন। এর মধ্যে নারী রোগী আছেন আটজন। ডেঙ্গু আক্রান্ত পুরুষ রোগীদের মেডিসিন ওয়ার্ডের পুরুষ বিভাগে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আর মহিলা রোগীদের মেডিসিন ওয়ার্ড মহিলা ইউনিটে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, একই ওয়ার্ডে তাদের চিকিৎসা দেওয়া হলেও ইউনিট অর্থাৎ নির্ধারিত বেড ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। যে কয়টি বেড ডেঙ্গু রোগীদের জন্য নির্ধারিত করা আছে, সেখানে অন্য রোগী তোলা হয় না। বেড ফাঁকা থাকলেও সেই বেড ফাঁকা থাকছে। সরেজমিন দেখা গেছে, রোগীর চাপে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালের মেঝে, বারান্দায় সবখানে রোগী। নীলফামারীর ডোমার থেকে সর্দিজ্বর আর বমি নিয়ে ভর্তি হয়েছেন লামিয়া বেগম। তার বাবা জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘আমি আমার মেয়েকে দুই দিন হলো ভর্তি করাইছি। বেড না থাকায় বারান্দায় বিছানা বিছিয়ে চিকিৎসা নিতেছি।

পীরগঞ্জের কুসুমপুর গ্রামের আফিজ উদ্দিন বলেন, ‘আমার মেয়ে আম্বিয়াকে নিয়ে আসছি। বেড পাই নাই, মেঝেতে চিকিৎসা নিতেছি।’ হাসপাতালের পরিচালক ডা. ইউনুস আলী জানান, একই ওয়ার্ডে আলাদা করে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে, তাতে তারা ভালো চিকিৎসা পাচ্ছে। আমাদের হাসপাতালে মৃত্যু সংখ্যাও কম।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ডেঙ্গু জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হিসেবে দাঁড়িয়েছে। রাজধানীতে আর সীমাবদ্ধ নেই। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। গত ২০১৯ সালের পর থেকে প্রতিবছর অসংখ্য মানুষ আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। এতে অন্যান্য চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হয়। মশা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে আগামীতে দেশের হাসপাতালে মেডিসিন ওয়ার্ডে অন্য রোগী আর ভর্তি হতে পারবে না, শুধুই ডেঙ্গু রোগীতে পূর্ণ থাকবে।

দেশের সবশেষ ডেঙ্গু পরিস্থিতি

ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গতকাল সারা দেশে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭৯০ জনে। এ ছাড়া গতকাল এক দিনে নতুন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ১২৯ জন। গতকাল শুক্রবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের ইনচার্জ মো. জাহিদুল ইসলামের সই করা ডেঙ্গুবিষয়ক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, গতকাল ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ১২৯ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৮৪৩ জন ও ঢাকার বাইরের ১ হাজার ২৮৬ জন। একই সময়ে মারা যাওয়া ১২ জনের মধ্যে চারজন ঢাকার ও আটজন ঢাকার বাইরের বাসিন্দা। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ লাখ ৬১ হাজার ৯৬৪ জন। তাদের মধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ৭১ হাজার ৫০৩ জন ও ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে ৯০ হাজার ৪৬১ জন ভর্তি হয়েছেন। বছরের একই সময়ে আক্রান্তদের মধ্যে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন ১ লাখ ৫১ হাজার ২৮৩ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৬৬ হাজার ৯৪০ জন এবং ঢাকার বাইরের ৮৪ হাজার ৩৪৩ জন। এখনো হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৯ হাজার ৮৯১ জন। তাদের মধ্যে ঢাকায় চিকিৎসা নিচ্ছেন ৪ হাজার ১৬ জন আর ঢাকার বাইরে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৫ হাজার ৮৭৫ জন।

প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন কালবেলার রংপুর ও বরিশাল ব্যুরো অফিস এবং খুলনা প্রতিনিধি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

হামাসের টানেল ধ্বংসে ইসরায়েলের ভয়ংকর কৌশল!

বিদেশিদের চাপ একেবারেই নেই : ইসি আলমগীর

না ফেরার দেশে ‘সিআইডি’র দীনেশ ফাডনিশ

সরকার আশ্বাস দিয়েছে বলেই নির্বাচনে এসেছি : জাপা মহাসচিব

এবার দক্ষিণ গাজা খালি করতে চায় ইসরায়েল

কবে আসন ভাগাভাগির সিদ্ধান্ত হবে জানালেন কাদের

নির্বাচনে অবৈধ অস্ত্রের চোরাচালান ঠেকাতে সীমান্তে সতর্ক অবস্থানে বিজিবি

শুরু হলো এপিকটা অ্যাওয়ার্ড-২০২৩

৬ ডিসেম্বর: লালমনিরহাট হানাদারমুক্ত দিবস আজ

বিতর্কিত জলসীমায় চীনের ১৩৫ জাহাজ!

১০

ছাত্রদল নেতাকে না পেয়ে ক্রীড়াবিদ ছোট ভাইকে গ্রেপ্তার

১১

জানা গেল হিরো আলমের বার্ষিক আয় ও সম্পদ বিবরণী

১২

চাঁদপুরে মনোনয়নপত্র বাতিলের বিরুদ্ধে লড়বে ১১ প্রার্থী

১৩

জাতীয় অধ্যাপক ডা. আব্দুল মালিক আর নেই

১৪

প্রতারণায় মামলায় গায়ক নোবেলের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন ৩০ জানুয়ারি

১৫

চট্টগ্রামে সড়ক দুর্ঘটনায় ২ ভাই নিহত

১৬

জিম্বাবুয়ের নির্বাচনে কারচুপি, জড়িতদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা

১৭

মিগজাউমের প্রভাবে লন্ডভন্ড ভারতের উপকূল, মৃত্যু ৮

১৮

কেন্দুয়ায় বেড়েছে সরিষার চাষ, বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা

১৯

জাবিতে সেই চার ছাত্রলীগ কর্মী বহিষ্কার

২০
X