আমার বর্তমান কর্মস্থল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেমুরকৃবি) ক্যাম্পাসের ভেটেরিনারি মেডিসিন অ্যান্ড অ্যানিম্যাল সায়েন্স অনুষদ থেকে বেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল সড়ক ধরে হাঁটছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে ফিশারিজ অনুষদ ও বড় পুকুরটি পার হয়ে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেসা মুজিব হলের শেষ মাথায় চলে এলাম। এমন সময় কোত্থেকে হঠাৎ একটি পাখি আমার ঠিক মাথার ওপরের বৈদ্যুতিক তারে এসে বসল। ওপরের দিকে তাকালাম। না, আগে কখনো দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না। পাখিটি আমার কাছে একেবারেই নতুন। লাইফার অর্থাৎ নতুন পাখি পাওয়ার আনন্দে মনটা খুশিতে ভরে উঠল। ক্যামেরা তো সঙ্গেই ছিল। পটাপট দু-তিনটা শট নিয়ে নিলাম। ২০১১ সালের ১২ সেপ্টেম্বরের ঘটনা এটি। এরপর পাখিটিকে আর কখনো কোথাও দেখিনি। এ বছরের ২৬ এপ্রিল মিরপুরের জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান থেকে পক্ষী আলোকচিত্রী মো. ইমরুল হাসান পাখিটির ছবি তুলল। তবে, সঠিক সময়ে যেতে না পারায় পাখিটিকে দ্বিতীয়বার দেখা থেকে বঞ্চিত হলাম।
বশেমুরকৃবি ক্যাম্পাসের বৈদ্যুতিক তারে বসা হঠাৎ দেখা পাখিটি ও উদ্ভিদ উদ্যানে ইমরুল হাসানের দেখা পাখিটি এদেশের এক বিরল পন্থ-পরিযায়ী পাখি গায়ক কোকিল। আপনাদের মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে, পন্থ-পরিযায়ী পাখি কী? পন্থ-পরিযায়ী (Passage Migrant) পাখি হলো সেসব পাখি, যারা অন্য দেশে পরিযায়নের একপর্যায়ে আমাদের দেশে স্বল্প সময়ের জন্য বিশ্রাম নিতে আসে (যেমন—বাদামি চটক, বন খঞ্জন, লাল-পা তুরমতি ইত্যাদি)। এরা মূলত সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবরে অন্য কোনো দেশে পরিযায়নের পথে এদেশে যাত্রাবিরতি করে ও ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চে মূল দেশে ফিরে যাওয়ার সময়ও আরেকবার এদেশে যাত্রাবিরতি করে। যা হোক, গায়ক কোকিলের ইংরেজি নাম Common Cuckoo বা Eurasian Cuckoo, গোত্র-কুকুলিডি ও বৈজ্ঞানিক নাম Cuculus canorus (কুকুলাস ক্যানোরাস)। এরা মূলত ইউরোপ, চীন, হিমালয় ও জাপানের আবাসিক পাখি। শীতে সাব-সাহারান আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পরিযায়ী হয়। ইতোপূর্বে সিলেট, চট্টগ্রাম, খুলনা ও ঢাকা বিভাগে বসন্তে দেখার তথ্য থাকলেও গাজীপুরে হেমন্তে আমিই প্রথম দেখেছি। তবে, কয়েক বছর ধরে এদের গ্রীষ্মেও এদেশে দেখা যাচ্ছে। তবে, এখনো এদেশে এদের প্রজনন ও বংশবৃদ্ধির কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
প্রাপ্তবয়স্ক গায়ক কোকিলের দেহের দৈর্ঘ্য ৩৩ থেকে ৩৬ সেন্টিমিটার ও ওজন ৫৪ থেকে ৬০ গ্রাম। একনজরে এটি ধূসর রঙা পাখি। স্ত্রী-পুরুষের পালকের রঙে পার্থক্য থাকে। পুরুষ পাখির দেহের উপরিভাগ ধূসর। দেহতল সাদা। থুতনি, গলা ও বুক ফ্যাকাশে ছাই। পেট, বগল, অবসারণী ও লেজতল ঢাকনির ওপর চিকন কালো ডোরা রয়েছে। লেজ কালচে-বাদামি, যার আগা সাদা। স্ত্রীর দেহের পালকের রং দুই ধরনের হয়। প্রথম ধরনের ক্ষেত্রে ধূসর বুকের নিচের প্রান্তদেশে লালচে ভাব ছাড়া বাদবাকিটা পুরুষের মতো। দ্বিতীয় ধরনের স্ত্রীর লেজসহ পিঠ লালচে-বাদামি, যাতে কালচে-বাদামি ডোরা থাকে। কালচে ডোরাসহ দেহতল সাদা। স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে উভয়েরই চোখ, পা, পায়ের পাতা ও আঙুল হলুদ। নখ ধূসর-বাদামি। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখি শ্লেট-ধূসর, যার ঘাড়ের পেছনে সাদা তিল থাকে। এ ছাড়া পালকে থাকে সাদা পাড়।
গায়ক কোকিল মিশ্র চিরসবুজ বন, আর্দ্র পাতাঝরা বন ও গাছপালা সমৃদ্ধ এলাকায় সচরাচর একাকী বিচরণ করে। দিবাচর পাখিগুলো মূলত শুঁয়োপোকা ও নরম দেহের কীটপতঙ্গ খেয়ে থাকে। পুরুষ পাখি ‘কুক-কু--কুক-কু---’ এবং স্ত্রী ‘হুয়ি-হুয়ি-হুয়ি---’ স্বরে ডাকে।
মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর প্রজননকালে মূল আবাস এলাকা, সাইবেরিয়া ও হিমালয়ে ওদের থেকে ছোট আকারের পাখি, যেমন—খঞ্জন (Wagtail), তুলিকা (Pipit), চটক (Flycatcher) ইত্যাদির বাসায় ডিম পাড়ে। স্ত্রী বছরে অন্ততপক্ষে ১২টি পোষকের বাসায় একটি করে ১২টি ডিম পাড়ে। ডিমের রং পোষকের ডিমের কাছাকাছি। পোষকের ডিমের আগে (প্রায় ১২.৫ দিনে) ডিম ফোটে। ছানারা ২২ থেকে ২৩ দিনে ধাত্রী মা-বাবার থেকে কয়েক গুণ বড় হয়ে যায়। আয়ুষ্কাল কমবেশি সাত বছর।
লেখক: পাখি ও বন্যপ্রাণী প্রজনন বিশেষজ্ঞ এবং অধ্যাপক, বশেমুরকৃবি, গাজীপুর
মন্তব্য করুন