কালবেলা ডেস্ক
প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৫:১৭ পিএম
আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৫:২২ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্তির পথে যেসব ভাষা

প্রতীকী ছবি।
প্রতীকী ছবি।

ভাষা বহমান নদীর মতো। প্রতিনিয়ত ভাঙা-গড়ার মধ্যে দিয়ে যায়। ভাষার সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানবজাতির হাজার বছরের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। নদী যেমন কোথাও বাধা পেলে ধীরে ধীরে মরে যায়, তেমনি ভাষাও এক সময় বিলুপ্ত হয়। মূলত একটি ভাষার মৃত্যু মানে কোনো একটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষারও বিলুপ্তি। সময়ের বিবর্তনে ঠিক সেই বিলুপ্তির শিকারেই পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের কয়েকটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষার। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটের সর্বশেষ সমীক্ষা অনুযায়ী, বাংলাদেশে বিলুপ্তপ্রায় ভাষার সংখ্যা মোট ১৪টি। এই বিলুপ্তপ্রায় ভাষা কোনোরকম বেঁচে আছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর গুটি কয়েক প্রবীণ সদস্যের মাঝে। অন্যান্য সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাষার প্রভাবে নৃ-গোষ্ঠীগুলোর নতুন প্রজন্মের কাছ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে এইসব মাতৃভাষাগুলো। চলুন বিলুপ্তপ্রায় সেই ভাষাগুলোর ব্যাপারে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক-

কুই

সিলেটের সীমান্ত ঘেঁষা পাহাড়ি এলাকায় কন্দ সম্প্রদায়ের বসবাস। এই সম্প্রদায়ের ভাষার নাম ‘কুই’। বর্তমানে মাত্র চার জন বয়োজ্যেষ্ঠ এই ভাষায় কথা বলতে পারেন। নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা এই ভাষায় কথা বলতে পারেন না। যদিও ভারতে কন্দ সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে ভাষাটির প্রচলন আছে।

বাংলাদেশে কন্দ সম্প্রদায়ের আগমন ঘটে ১৯ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। কুই আদিভাষার নাম কন্দফারসি। ভারতের ওড়িশা থেকে এ দেশে কন্দদের আনা হয়েছিল মূলত রেললাইন স্থাপন ও চা বাগানের কাজে।

খাড়িয়া

অস্ট্রো-এশিয়াটিক গোত্রের মুণ্ডা শাখার অন্তর্গত খাড়িয়া ভাষার সর্বাধিক ব্যবহার হয় ভারতের ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড়, ও ওড়িশায়। বাংলাদেশের শ্রীমঙ্গলে মংরাবস্তিতে প্রায় ১০০-এরও বেশি পরিবারের মাতৃভাষা খাড়িয়া। কিন্তু এ ভাষায় স্বাচ্ছন্দ্যে কথা বলতে পারে মাত্র ২ জন। এদের একজন খাড়িয়া সমাজকর্মী হিসেবে নিজেদের মাতৃভাষা রক্ষার কাজ করছেন।

২০২০ সালে তিনি খাড়িয়াদের ওপর একটি সমীক্ষা করেছিলেন, যেখানে বাংলাদেশে ৪১টি খাড়িয়া গ্রামের খোঁজ পাওয়া যায়। গ্রামবাসীদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫ হাজার ৭০০ জন।

কোডা

পশ্চিমবঙ্গ, পশ্চিম মেদিনীপুর এবং বাঁকুড়া জেলার প্রচলিত এক ধরনের মুণ্ডা ভাষার নাম কোডা। এর আরও নাম আছে, যেমন কোরা, কাওরা, কোরালি, কোরাটি, কোরে, এবং মুদিকোরা। ভারত ও বাংলাদেশের কোরা গোষ্ঠী দ্বারা কথিত একটি বিপন্ন মুণ্ডা ভাষা। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ কোডা-ভাষী গ্রামগুলো হচ্ছে রাজশাহী বিভাগের কুন্দং এবং কৃষ্ণপুর। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে কোডা বাংলার সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে গেছে। দুয়েক জন প্রবীণদের মুখে কিছু কোডা শোনা গেলেও তরুণদের সবাই বাংলাতেই কথা বলেন।

মুণ্ডারি

অস্ট্রোএশিয়াটিক ভাষা বিভাগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুণ্ডা ভাষা এই মুণ্ডারি। নেপাল, পূর্ব ভারতীয় রাজ্যের ঝাড়খন্ড, ওড়িশা এবং পশ্চিমবঙ্গের মুণ্ডাদের এই কথ্য ভাষার সঙ্গে সাঁওতালি ভাষার অনেক মিল।

বাংলাদেশে মুণ্ডারির ব্যবহার দেখা যায় খুলনার কয়রা উপজেলার উত্তর ও দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নে, ডুমুরিয়া, এবং সাতক্ষীরার শ্যামনগর, দেবহাটা ও তালা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামগুলোতে। সুন্দরবন সংলগ্ন নদী পাড়ের গ্রামগুলোর এই আদিবাসীরা এখন কদাচিৎ মুণ্ডা ব্যবহার করে। পাবনার ঈশ্বরদীর তরুণ মুণ্ডাদের অনেকেই প্রথম দিকে জানতো না যে, তাদের নিজস্ব একটি মাতৃভাষা ছিল।

কোল

একদম আলাদা মুণ্ডা ভাষা হলেও কোল এবং কোডাকে মুণ্ডারির মিশ্র ভাষা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৮৩১ থেকে ১৮৩২ সালে কোলরা বৃটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। সুযোগ্য নেতৃত্বের অভাব, আঞ্চলিক সীমাবদ্ধতা, শিক্ষিত শ্রেণীর সমর্থনের অভাব এবং নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগের অভাবে আন্দোলন ব্যর্থ হয়।

কোলদের গ্রাম সবচেয়ে বেশি রয়েছে রাজশাহীর গোদাগাড়ি উপজেলার বরেন্দ্র অঞ্চলে এবং রংপুরের বাবুডাইংয়ে।

মালতো

পূর্ব ভারতের মাল্তো উপজাতির মুখে প্রচলিত উত্তর দ্রাবিড় ভাষা এই মালতো। এর ‘পাহাড়িয়া’ নামটিও বেশ প্রসিদ্ধ, তবে ‘রাজমহালি’ নামটি খুব কম শোনা যায়।

পাবনার ঈশ্বরদীর দাশুড়িয়া ইউনিয়নের মাড়মি পল্লীর অধিবাসীদের প্রথম ভাষা মালতো। এছাড়া নাটোর, রাজশাহী ও নওগা জেলায়ও রয়েছে মালতোদের বসবাস। বর্তমানে জীবিকার উদ্দেশ্যে লেখালেখির যাবতীয় কাজ বাংলায় হওয়ায়, কথা বলার সময়েও কমে গেছে মালতোর ব্যবহার।

সৌরা

ভারতের সীমান্ত পিলার ও ত্রিপুরা বনবাজার খেকে ২০০ গজ দূরত্বে বাংলাদেশের শ্রীমঙ্গলের রাজগাট ইউনিয়নের সৌরা পল্লী। এই গ্রাম পরম যত্নে আগলে রেখেছে ২২টি সৌরা পরিবারকে। এছাড়া উত্তরবঙ্গের রংপুরেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সৌরারা। এদের বেশিরভাগই কথা বলেন ওড়িয়া, সাদরি ও স্থানীয় তথা উত্তরবঙ্গের আঞ্চলিক ভাষায়।

খুমি

বার্মার (বর্তমান মিয়ানমার) দক্ষিণ চীন রাজ্যের ভাষা দক্ষিণ চীনের একটি উপভাষা খুমি। বার্মার পালেওয়া ও তার আশেপাশের অঞ্চল এবং বাংলাদেশের বান্দরবান জেলার আদিবাসীরা এই ভাষা ব্যবহার করে। আরাকানীয় (বর্তমান রাখাইন, যা মিয়ানমারের একটি অঞ্চল) এবং বর্মী ভাষার বিস্তর প্রভাব এই ভাষার ওপর। বান্দরবানের রুমা, থানচি এবং রোয়াংছড়িতে খুমিদের বসবাস।

চাক

মিয়ানমারের চাক নৃ-গোষ্ঠীর কথ্য হিসেবে প্রচলিত আরও একটি চীন-তিব্বতি ভাষা চাক। শাল বিভাগভুক্ত এই ভাষাটি সাক নামেও পরিচিত। ১৩ শতকের মাঝামাঝি সময়ে কাদু জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা ভাবে পরিচিতি লাভ করে চাকরা। ১৪ শতকে তাদের রাজ্য আরাকানিরা দখল করলে তারা পার্বত্য চট্রগ্রামে প্রবেশ করে। বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়ের ছড়া অঞ্চলগুলোই এখন এই চাকদের নিবাস। সুরপ্রধান চাক ভাষা সাহিত্যে বেশ সমৃদ্ধ হলেও লেখায় তেমন প্রচলন না থাকায় এখন বিপন্ন হতে চলেছে।

পাংখোয়া

ভারতের মিজোরাম রাজ্যে ব্যবহৃত কুকি ভাষার নাম পাংখোয়া, যা পাংখু, পাংখোয়া বা পাং নামেও পরিচিত। পাংখোয়ার দুইটি উপভাষা হচ্ছে বিলাইছড়ি ও কংলাক। বাংলাদেশে পার্বত্য রাঙ্গামাটির সাজেক উপত্যকা থেকে বারাবানের রুমা সংলগ্ন এলাকায় পাংখোয়া জাতির বসবাস।

২০২২ সালে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ থেকে পাহাড়ি ৭টি উপজাতীয় ভাষার স্বতন্ত্র শব্দকোষ প্রকাশ করা হয়েছিল। সেগুলোর মধ্যে পাংখোয়া অন্যতম।

রেংমিটচ্য

খুমি এবং ম্রো ভাষার ঘনিষ্ট প্রভাব থাকলেও মায়ানমারের কুকি-চীন ভাষার শ্রেণীভুক্ত রেংমিটচ্য একটি স্বতন্ত্র ভাষা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্কালে আলীকদমের পার্টি পাড়ায় বাস করতো শতাধিক রেমিটচ্য পরিবার। আলীকদম সদর থেকে ১০ থেকে ১২ মাইল দূরে তৈনখালের উপত্যকার ছোট্ট গ্রাম ক্রাংসিপাড়া। সেখানে রেমিটচ্যভাষীদের বসতি ছিল প্রায় ৩০০ বছর ধরে। কালের বিবর্তনে এই সম্প্রদায়ের লোকসংখ্যা কমতে কমতে ২০২২ সালে ৬-এ এসে দাঁড়ায়। এদের বেশিরভাগই আবার ছিলেন ষাটোর্ধ্ব। এদের মধ্যে ২ জন থাকতেন নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় ম্রোদের সঙ্গে।

মূলত স্থানীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ায় সংখ্যা কমছে রেংমিটচ্য ভাষাভাষীদের।

খিয়াং

রাঙামাটির কাপ্তাই ও চন্দ্রঘোনা এবং বান্দরবানের থানচি ও রোয়াংছড়িতে বসবাসরত খিয়াং আদিবাসীদের কথ্য ভাষা খিয়াং। বাংলাদেশে খিয়াংরা মূলত দুটি গ্রুপে বিভক্ত- লাইতু ও কংতু। লাইতুরা থাকে সমতলে আর কুংতুরা থাকে পাহাড়ি এলাকায়। এদের বেশিরভাগই বর্তমানে বাস করে রাজকীয় মং সম্প্রদায়ের সঙ্গে। তাই কথ্য রীতিতে আর আগের সেই মৌলিকতা নেই। অবশ্য তা ফিরিয়ে আনার জন্য খুব ছোট পরিসরে হলেও তোড়জোড় শুরু হয়েছে। রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের ৭টি পাহাড়ি ভাষার শব্দকোষের মধ্যে খিয়াং একটি।

লালেং (পাত্র)

বাংলাদেশের উপভাষাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম পরিচিত পাত্র বা লালেং ভাষা। সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে গহীন জঙ্গলে এই ভাষাভাষী লোকদের বসবাস। এই ভাষার নাম মূলত লালেং ঠার বা লাইয়ুংটার। এর কোনও শব্দের সঙ্গে বাংলা অথবা অন্য ভাষার কোনও মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি।

লুসাই

উত্তর-পূর্ব ভারত ও মিয়ানমারের প্রসিদ্ধ একটি উপজাতীয় ভাষা লুসাই। আসামের লুসাই পাহাড় থেকেই এই ভাষার নামকরণ হয়েছে। বাংলাদেশের লুসাইভাষীরা নিজেদের মঙ্গোলীয়দের বংশধর বলে দাবী করে। রাঙ্গামাটির সদরের বাঘাইছড়ি এবং বান্দরবান সদর ও রুমায় রয়েছে লুসাইদের গ্রাম।

পাহাড়ি ভাষা সংরক্ষণের জন্য রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ কর্তৃক যে শব্দকোষগুলো প্রকাশ করা হয়েছিল, তার মধ্যে লুসাইও রয়েছে।

সূত্র : ইউএনবি

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ফোর্বসের তালিকায় ৯ বাংলাদেশি

ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলছাত্রী নিহত

রিট আরও আগেই করা উচিত ছিল : নিপুন

ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস আজ

ক্ষমতার দাপট, খাল বন্ধ করে বহুতল ভবন নির্মাণ

মঞ্চ কাঁপাচ্ছেন ডিজে ভিক্ষু, মাতাল হয়ে শুনছে সবাই

মিষ্টি জান্নাতকে চুমু খেতে চেয়েছেন জয়, আছে ভিডিও

তামাকজাত দ্রব্যে কর বৃদ্ধিতে পাশে থাকবেন অর্থ প্রতিমন্ত্রী

ভাড়া বাসা থেকে এনজিও কর্মীর লাশ উদ্ধার

২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার নতুন এডিপি অনুমোদন

১০

মৌলভীবাজারের তাজের প্রার্থিতার বিপক্ষে ইসির আপিল খারিজ, নির্বাচন স্থগিত

১১

আকর্ষণীয় বেতন আইসিডিডিআরবিতে চাকরি

১২

চোট নিয়েই মেয়ের হাত ধরে কানে ঐশ্বরিয়া, হাঁটবেন লালগালিচায়

১৩

একাদশ শ্রেণিতে ক্লাস শুরু ৩০ জুলাই

১৪

গরম পানি ঢেলে স্ত্রীর শরীর ঝলসে দিলেন স্বামী

১৫

সিল মারা ব্যালটসহ ফেসবুকে পোস্ট, ইউপি চেয়ারম্যানকে ইউএনওর নোটিশ

১৬

বিমানবন্দরের সামনে ফ্লাইওভারে প্রাইভেটকারে আগুন

১৭

পুতিনপন্থি প্রধানমন্ত্রীকে গুলির নেপথ্যে আমেরিকা?

১৮

পশ্চিমাদের আতঙ্ক এস-৪০০ কতটা শক্তিশালী?

১৯

ভেকুর নিচে চাপা পড়ে যুবক নিহত

২০
X