আব্দুল আজিজ। পেশায় একজন বেসরকারি চাকরিজীবী। তার ঘরবাড়ি, আত্মীয়-স্বজন সবাই থাকেন চট্টগ্রাম নগরীতে। ট্রেনে চড়ে কখনো শহরের বাইরে যাননি তিনি। কিন্তু ট্রেনে না চড়লেও গত এক বছরে তার মোবাইল নম্বরের বিপরীতে ট্রেনের টিকিট কাটা হয়েছে ১৮৪ বার। এমনকি সহজের এপস-এ তার নাম রেজিস্ট্রেশন করা আছে ইসরাব উদ্দিন জোবাঈর নামে। এক বছরে তার মোবাইল নম্বরের বিপরীতে অস্বাভাবিক ট্রেন যাত্রাকে কেন্দ্র করে হঠাৎ একদিন আজিজের ডাক পরে চট্টগ্রাম রেলওয়ে থানায়। পরে নানা জেরা-জিজ্ঞাসাবাদের পর আজিজ পুলিশকে বোঝাতে সক্ষম হয়, ইসবার উদ্দিন জোবাঈর নামের কাউকে চেনেন না তিনি। কখনো ট্রেনে চড়েননি, এমনকি রেলওয়ের কোনো কাজেও তিনি জড়িত নন।
মূলত গত ফেব্রুয়াারিতে পুলিশের জালে মো. আরিয়ান হোসাইন নামের এক টিকিট কালোবাজারিকে গ্রেপ্তারের পর তার কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া টিকিটের সূত্র ধরেই বেরিয়ে আসে আব্দুল আজিজের নাম। আজিজ একা নয়। চট্টগ্রাম রেলওয়ে পুলিশের দীর্ঘ তদন্তে এভাবে একে একে হদিস মেলে প্রায় ৫০টি নম্বরের। যেসব নম্বরের ব্যবহারকারীরা জানেন না, তাদের নামে করা হয়েছে রেজিস্ট্রেশন। এমনকি অনেকেই কোনোদিন ট্রেনেও চড়েননি। কেউ কেউ চড়েছেন জীবনে কয়েকবার। কিন্তু তাদের একেক জনের নামে ৫০ থেকে সর্বোচ্চ ১৮৪ বার পর্যন্ত ট্রেনের টিকিট কাটা হয়েছে।
ভুক্তভোগী আব্দুল আজিজ কালবেলাকে বলেন, ‘আমি একজন সাধারণ মানুষ। আমার বাড়ি শহরের ফিরিঙ্গীবাজারে। নানুর বাড়ি ময়মনসিংহ। বাসে চড়ে সেখানে গিয়েছি কয়েকবার। জীবনে কোনোদিন ট্রেনে চড়িনি। কিন্তু কিছুদিন আগে থানা থেকে ফোন করে আমাকে ডাকা হয়েছিল। আমি স্যারকে (পুলিশ) বলেছি, এগুলো কি বলেন স্যার? আমার জীবনে কোনোদিন একটা বেড রেকর্ড নাই। এলাকায় খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন।’
একইভাবে ভুক্তভোগী রমজান আলী রেলস্টেশন এলাকায় একটি পানের দোকান করেন। তার বাড়ি লাকসাম। প্রতি মাসে ট্রেনে চড়ে বছরে সর্বোচ্চ ২০ বার বাড়ি যান তিনি। কিন্তু রমজান আলীর নম্বরের বিপরীতে ১৪২বার টিকিট কাটা হয়েছে। রেজিস্ট্রেশনে তার নাম ছিল সুমিত্র ঘোষ চৌধুরী।
তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘পুলিশ আমাকে ডেকেছিল। কিন্তু ওসি স্যারকে আমি বলেছি আমি এসবে জড়িত নই। পরে নিজের রেজিস্ট্রেশন ও ক্যান্সেল (বাতিল) করেছি। ঈদে আমি বাড়ি গেলে টিকিটও কাটাতে কষ্ট হবে।
তদন্তে নেমে আব্দুল আজিজ ও রমজান আলীর মতো এভাবে একে একে ৫০টি মোবাইল নম্বর পুলিশের নজরে আসে। এসব নম্বর ব্যবহারকারীরা কেউই জানেন না তাদের নম্বর ব্যবহার করে কাটা হচ্ছিল ট্রেনের টিকিট। এমনকি রেজিস্ট্রেশন নামেও ছিল অমিল। তবে দীর্ঘ তদন্তের পর রেলের টিকিট কালোবাজারিতে ডিজিটাল জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ে পুলিশের জালে।
রেলওয়ে পুলিশ জানায়, গত ফেব্রুয়ারিতে চট্টগ্রাম রেলস্টেশন থেকে বেশ কয়েকটি টিকিটসহ আরিয়ান নামের এক কালোবাজারিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর তার কাছ থেকে উদ্ধার টিকিটগুলো যেসব নম্বরের বিপরীতে কাটা হয়েছিল। তা দেখে পুলিশের সন্দেহ আরও প্রবল হয়। একপর্যায়ে চট্টগ্রাম রেলস্টেশন থেকে সর্বোচ্চ টিকিট কাটা হয়েছে যেসব নম্বর দিয়ে সেগুলো শনাক্তের কাজ শুরু করে পুলিশ। এ সময় ৫০টি টিকিট পর্যালোচনায় রেলের টিকিট কালোবাজারিতে ডিজিটাল জালিয়াতির বিষয়টি পুলিশের নজরে আসে। এরপর জালিয়াতি রোধে রেলওয়েকে তিন দফা সুপারিশ দেয় রেলওয়ে পুলিশ। সেই সুপারিশ অনুসারেই এবারের ঈদযাত্রায় রেলটিকিট কাটার ক্ষেত্রে ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড (ওটিপি) চালু করে রেলওয়ে।
রেলওয়ে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, টিকিট কালোবাজারিতে বিভিন্ন অসংগতির পর আমরা কালোবাজারি রোধে কিছু মতামত দিয়েছিলাম। যেমন- আমরা মতামত দিয়েছি ওটিপি চালু হলে কালোবাজারি রোধ করতে সহজ হবে। এবার ঈদযাত্রায় কালোবাজারিসহ সার্বিক পরিস্থিতি সুশৃঙ্খল রাখতে পুলিশ তৎপর রয়েছে।
এদিকে চট্টগ্রাম রেলওয়ে থানার ওসি এস এম শহীদুল ইসলাম জানিয়েছেন, ৫০টি নম্বরে যাদেরই ফোন করা হয়েছে তারাই টিকিট কাটার ব্যাপারে কিছুই জানে না বলে জানিয়েছে। পুলিশের ফোন পেয়ে কিংবা জিজ্ঞাসাবাদে অনেকেই ঘাবড়ে গেছেন। তবে তদন্তে কালোবাজারিরা ডিজিটাল জালিয়াতি কীভাবে ঘটাচ্ছে তা শনাক্তে সফল হয়েছে পুলিশ।
ওসি এস এম শহীদুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, আসলে সাধারণ মানুষ আইনি ঝামেলা এড়িয়ে চলতে চাই । আমরা যখন তাদের নম্বর ব্যবহার করে টিকিট কালোবাজারির বিষয়টি জানিয়েছি অনেকেই ঘাবড়ে গেছেন। দীর্ঘ তদন্তের পর আমরা বিষয়টি শনাক্তে সম্ভব হয়েছি।
পুলিশের তিন দফা সুপারিশ : ঈদযাত্রায় ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি রোধে তিন দফা সুপারিশ করা হয়েছে চট্টগ্রাম রেলওয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে। গত ফেব্রুয়ারিতে এ সুপারিশের পর চলতি মার্চে এবারের ঈদযাত্রায় ওটিপি চালু করেছে রেলওয়ে। পাশাপাশি রেলওয়ের টিকিট কাটায় সংযোজিত হয়েছে নতুন নিয়ম।
পুলিশের সুপারিশগুলো হলো, যে মোবাইল ব্যবহার করে টিকিট কাটা হবে, সেই নম্বরে ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড (ওটিপি) ব্যবস্থা করা। টিকিট কেনার সাথে সাথে রেজিস্ট্রেশন করা নম্বরে এসএমএস করা যেতে পারে এবং যে নম্বর দিয়ে সিম কেনা হয়েছে সেই নম্বরটি রেলওয়ের টিকিট কেনার রেজিস্টেশন সম্পন্ন করার সময় এনআইডি নম্বরও যুক্ত করা যেতে পারে। সুফল মিলতে শুরু করেছে
গত ফেব্রুয়ারিতে চট্টগ্রাম রেলওয়ে পুলিশের দীর্ঘ তদন্তে ডিজিটাল জালিয়াতির ঘটনাটি উঠে আসার পর চলতি মার্চে ঈদযাত্রার ট্রেনের টিকিট কাটতে ওটিপি চালু করেছে রেলওয়ে। রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এরপর থেকে কালোবাজারি কিছুটা কমতে শুরু করেছে। পাশাপাশি রেলকে ব্যবহার করে অপরাধমূলক কাজ কেউ করতে চাইলে তাও রোধ করা সম্ভব হবে। এরই ধারাবাহিকতায় গত বৃহস্পতিবার ওটিপির সাহায্যে ঢাকা থেকে পালিয়ে আসা স্কুলপড়ুয়া দুই কিশোর-কিশোরীকে আটকের পর, পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হয় পুলিশ।
ওসি এস এম শহীদুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ঢাকা থেকে পালিয়ে দুজন কিশোর-কিশোরী চট্টগ্রামে এসেছিল। কক্সবাজার এক্সপ্রেসে তাদের উদ্দেশ্য ছিল কক্সবাজারে। কিন্তু যখন তারা ঘর ছেড়ে পালায় তখন বাবার নম্বর ব্যবহার করে কিশোরটি ট্রেনের টিকিট কেটেছিল। তখন বাবার কাছে ওটিপি যেতেই পরিবার বুঝতে পেরেছে তারা ট্রেনে করে কোথাও যাচ্ছে। বিষয়টি ৯৯৯ এর মাধ্যমে আমাদের জানানো হলে আমরা ট্রেনে অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করতে সক্ষম হই এবং পরিবারের হাতে তুলে দিয়েছি। তাছাড়া ওটিপি চালু হওয়ার কারণে টিকিট কালোবাজারি একেবারেই কমে গেছে।
মন্তব্য করুন