সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রকাশ : ২০ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:৪২ পিএম
আপডেট : ২০ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:৪৫ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

ঝুরিপিঠা তৈরি করেই জীবন চলে ভাঙন কবলিতদের

ঝুরিপিঠা বানিয়ে শুকাতে দিয়েছেন ভাঙন কবলিতরা। ছবি : কালবেলা
ঝুরিপিঠা বানিয়ে শুকাতে দিয়েছেন ভাঙন কবলিতরা। ছবি : কালবেলা

গ্রামীণ মেলায় মণ্ডা-মিঠাইয়ের পাশাপাশি সাদা ঝুরিপিঠাও দেখা যায় অহরহ। মেলায় আসা মানুষগুলো বুন্দিয়া, জিলাপি ও বিভিন্ন রকমের মিষ্টির পাশাপাশি কিনে নিয়ে যান সুস্বাদু ঝুরিপিঠা। মেলা ছাড়াও বর্তমানে সারা বছরই হাটে-বাজারে ঝুরিপিঠার চাহিদা রয়েছে।

গ্রামবাংলার নারী ও শিশুদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় এই ঝুরিপিঠা তৈরি করেই জীবিকা নির্বাহ করছেন সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার কৈজুরী ইউনিয়নের হাটপাচিল গ্রামের যমুনার ভাঙন কবলিত কয়েকশ পরিবার।

এক সময় ঘর ছিল, বাড়ি ছিল, ছিল জমিজমাও। এখন তাদের এতটুকু আশ্রয়ও নেই। বাঁধের কিনারেই ঝুপড়ি ঘর তুলে সেখানেই বসবাস করেন যমুনার ভাঙনে সর্বস্ব হারানো অসহায় মানুষগুলো। কেউবা অন্যের জমি ভাড়া নিয়ে সেখানেই ছোট্ট একটি ঘর তুলে বসবাস করছেন। আয়ের অন্য কোনো পথ না থাকায় তারা চালের কুঁড়োয় ঝুরিপিঠা বানিয়েই জীবিকা নির্বাহ করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিদিন ভোররাতে বাঁধের প্রতিটি ঝুপড়ি কুঁড়েঘরে নারীদের কর্মযজ্ঞ শুরু হয়। বড় বড় পাতিলে পানি গরম করার পর তাতে আতপ চালের কুঁড়ো ও লবণ দিয়ে সিদ্ধ করেন তারা। এরপর সেগুলো থেকেই তৈরি হয় খামির। খামিরটাকে ছোট ছোট গোলাকৃতি করে রাখা হয়। ভোরে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে গোলাকৃতির খামিরগুলো মাটি কিংবা স্টিলের তৈরি ছাঁচ অথবা ঝাঁঝরের ভেতরে দিয়ে ঘষা দিলেই ছিদ্র দিয়ে লম্বা লতার মতো ঝুরিপিঠা বের হয়। পিঠাগুলো তিন, চার, পাঁচ দিন রোদে শুকানোর পর মাটির পাত্রে বালু গরম করে ভেজে নিতে হয়। এভাবেই তৈরি হয় সুস্বাদু ঝুরিপিঠা।

কথা হয় ঝুরি তৈরির সঙ্গে জড়িত একাধিক নারী-পুরুষের সঙ্গে। তারা বলেন, বর্তমানে ঝুরিপিঠার চাহিদা রয়েছে। এই পিঠা তৈরিতে নারী-পুরুষ সবাই মিলে কাজ করেন তারা। রাত-দিন পরিশ্রম করে পিঠা বানানো হয়। তাদের তৈরি ঝুরিপিঠা দেশের বিভিন্ন এলাকায় চলে যায়। শীতকালে গ্রামীণ মেলা, ধর্মীয় সভা থাকায় ঝুরিপিঠার চাহিদা আরও বেড়ে যায়।

জোবেদা খাতুন, টিয়া খাতুন, আমেনা বেগমসহ ঝুরি তৈরির সঙ্গে জড়িত বেশ কয়েক নারী বলেন, আমরা এখানে সবাই নদীভাঙন কবলিত। বাড়িঘর সব হারিয়ে কেউ ওয়াপদার ঢালে, আবার কেউ অন্যের জমি ভাড়া নিয়ে ঝুপড়ি ঘর তুলে বসবাস করি। আমাদের আয়ের অন্য কোনো উৎস না থাকায় ঝুরিপিঠা বানিয়ে জীবিকা নির্বাহ করি।

আব্দুল মোত্তালেব বলেন, নদীতে বাড়িঘর ভাইঙ্গা গেছে, বাঁধের ওপর বাড়ি করেছি। এখন বাঁধের ওপর থেকেও উচ্ছেদ করে দিয়েছে। আমরা অন্যের জমি ভাড়া করে ঝুরি বানিয়েই জীবিকা নির্বাহ করছি।

আব্দুর রশিদ বলেন, এক বস্তা আটার ঝুরি তৈরি করতে ৪ হাজার টাকা খরচ হয়। বিক্রি হয় ৪ হাজার ২শ থেকে ৪ হাজার ৩শ টাকায়। যদি আকাশের অবস্থা খারাপ হয় তাহলে নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকে।

বানু বেগম বলেন, চালকল থেকে আটা ভাঙিয়ে পানি গরম করে তাতে আটা দিয়ে ঘোঁটা হয়। তারপর ঝাঁঝর দিয়ে ঝুরি তৈরি করা হয়। এরপর পাঁচ দিন ধরে শুকানো হয়। শুকানোর পর গরম বালুতে ঝুরি ভেজে ঝুরি প্রস্তুত হয়। এরপর পাইকাররা এসে ঝুরি কিনে নিয়ে যান।

প্রধান শিক্ষক লোকমান হোসেন সরকার বলেন, হাটপাচিল গ্রামের এটাকে কুটিরশিল্প বলব। চালের কুঁড়ো থেকে সুস্বাদু খাবার তৈরি হচ্ছে। সারা বাংলাদেশের মধ্যে সুস্বাদু খাবার। খোলামেলা জায়গায় তৈরি হয়। নদীভাঙন কবলিত খেটে খাওয়া মানুষগুলো ভোররাত থেকে শুরু করে দিনভর পরিশ্রম করে।

তিনি বলেন, সব খাদ্যেই কোনো না কোনো ভেজাল থাকে। কিন্তু এই খাদ্যে কোনো ধরনের কেমিক্যাল বা ভেজাল নেই। সরকারিভাবে আর্থিক প্রণোদনা বা সহযোগিতা থাকলে এই কুটিরশিল্পটি বিকশিত হবে।

পাইকারি ঝুরি ব্যবসায়ী লোকমান হোসেন বলেন, সাত বছর ধরে আমি এখান থেকে ঝুরি পাইকারি কিনে বিভিন্ন গ্রামের জলসায়-মেলাতে বিক্রি করছি। নানা পালা-পার্বণে, উৎসবে, গ্রামীণ মেলায় ঐতিহ্যবাহী মুখরোচক খাবার হিসেবে ঝুরি পিঠার দেশব্যাপী ব্যাপক চাহিদা আছে। ঝুরি তৈরি করে বিক্রিতে কোনো কষ্ট করতে হচ্ছে না। লাভও একেবারে কম হচ্ছে না।

চালকল মালিক আইয়ুব আলী বলেন, ঝুরি তৈরিকে কেন্দ্র করে গ্রামটিতে এখনো চারটি চালকল আছে। ঝুরি তৈরির জন্য এসব চালকল থেকেই আতপ চালের গুঁড়া নিয়ে থাকেন প্রস্তুতকারকরা। অনেককে বাকিতেও দেওয়া হয়।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ কামরুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, হাটপাচিলে ভাঙন কবলিত মানুষগুলো ঝুরিপিঠা তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করে আমি শুনেছি। তবে তারা কেউ আমাদের কাছে আসেনি। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর ও কর্মসংস্থান ব্যাংকের মাধ্যমে স্বল্পকালীন প্রশিক্ষণের আওতায় এসব গ্রামীণ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে বলে আমরা জানি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

১০ বছরে পাঠাও, রয়েছে মাসজুড়ে অফার

রাকসু নির্বাচন / জিএস প্রার্থী সালাহউদ্দিন আম্মারের ‘ভোট চাইছেন’ শেখ হাসিনা!

এখন পরনির্ভর হয়ে আছি, আমাদের স্বনির্ভর হতে হবে : প্রধান উপদেষ্টা

দুদকের মামলায় সাবেক এমপি বদির বিরুদ্ধে আরও দুজনের সাক্ষ্যগ্রহণ

শহিদুল আলমদের জাহাজসহ ফ্রিডম ফ্লোটিলার সব নৌযান আটক

বানরের আক্রমণে শতাধিক ছাত্রী আহত

মুখ খুললেন রাশমিকা মান্দানা

গুমের শিকার বিশেষ বন্দিদের ‘মোনালিসা’ নামে ডাকা হতো

রাজশাহীতে হাজার ছাড়িয়েছে সাপে কাটা রোগী, মৃত্যু ৩৮

মানসিক স্বাস্থ্য বৃদ্ধি করে যে ১০ খাবার

১০

চট্টগ্রামের সিকো অ্যারেনাতে ১০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় পাবেন রবি এলিট গ্রাহকরা

১১

বিমানবন্দর থেকে ফিরিয়ে দেওয়া সেই ডেপুটি গভর্নর এবার যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন

১২

প্রথম ফুটবলার হিসেবে নতুন ইতিহাস গড়লেন রোনালদো

১৩

বাংলাদেশি শাড়ির জাদুতে মুগ্ধ তুরস্ক

১৪

কতদিন পর পর তোয়ালে ধুচ্ছেন? সঠিক সময় ও পদ্ধতি জেনে নিন

১৫

বজ্রপাতে প্রাণ হারানো রাসেদকে ‘চিরঞ্জীব সভাপতি’ ঘোষণা

১৬

ইতালি সফরে যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা

১৭

ফিলিস্তিনি শরণার্থী পরিবারে জন্ম নেওয়া ওমর পেলেন নোবেল

১৮

ডোবায় মিলল অজ্ঞাত যুবকের মরদেহ

১৯

চাকসু নির্বাচনে ছাত্রদল ও শিবিরের ইশতেহার ঘোষণা

২০
X