লোহাগড়া (নড়াইল) প্রতিনিধি
প্রকাশ : ১৫ আগস্ট ২০২৩, ০৯:৩৯ পিএম
আপডেট : ১৬ আগস্ট ২০২৩, ০৮:৪৫ এএম
অনলাইন সংস্করণ

বঙ্গবন্ধুর জন্য ৩৫ বছর খালি পায়ে হাঁটেন ‘বেদুইন সাত্তার’

বেদুইন সাত্তার। ছবি: কালবেলা
বেদুইন সাত্তার। ছবি: কালবেলা

নড়াইলের কালিয়া উপজেলার বিষ্ণুপুর গ্রামের সাত্তার মোল্যা। বাবা নোয়াই মোল্যা ছিলেন স্থানীয় মাতব্বর ও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতা। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধুর ভক্ত হয়ে যান সাত্তার মোল্যা। ১৯৬০ সালে বঙ্গবন্ধু তাকে নড়াইল সদর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব প্রদান করেন। তখন থেকেই যেখানেই বঙ্গবন্ধুর সভা সেখানেই ছুটে চলা নড়াইলের সাত্তারের। সেটি হোক টেকনাফ কিংবা তেঁতুলিয়া, কোনো কিছুই তাকে থামিয়ে রাখতে পারত না।

সময়টা ১৯৭৩ সাল, খুলনার সার্কিট হাউস মাঠে স্বাধীন বাংলার নেতা বঙ্গবন্ধুর জনসভা। নেতাকর্মী আর সাধারণ মানুষের ভিড়ে ঠাঁসা জনসভাস্থল। জনাকীর্ণ সভা শুরু হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু স্থানীয় নেতাকর্মীদের কাছে জানতে চান- নড়াইলের সাত্তার আসেনি, সাত্তার কই? বঙ্গবন্ধু খুঁজছেন সাত্তারকে, উপস্থিত সবাই দেখিয়ে দেন কালিয়া থানা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মুক্তিযোদ্ধা সর্দার আব্দুস সাত্তারকে। তখন বঙ্গবন্ধু বলেন, এ সাত্তার নয়, আমার বেদুইন সাত্তার কই? উপস্থিত নেতাকর্মীরা বঙ্গবন্ধুর এই কথায় বিস্মিত হন। এ সময় তার সামনে এগিয়ে আসেন কালিয়া উপজেলার বিষ্ণুপুর গ্রামের ৬ ফুট উচ্চতার সুঠাম দেহী সাত্তার মোল্যা। এই তো বেদুইন সাত্তার, বলেন- তুই তো সব জায়গায় ঘুরে বেড়াস, আজ থেকে তোর নাম বেদুইন সাত্তার। সেই থেকে মোল্যা সাত্তার হয়ে যান ‘বেদুইন সাত্তার’।

বঙ্গবন্ধুর সেই বেদুইন সাত্তার নড়াইলের নিভৃত একজন রাজনীতিবিদ। ছোটবেলা থেকেই প্রতিবাদী সাত্তার অন্যায় দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়তেন। ১৯৭১ সালের যুদ্ধে বেদুইন সাত্তারকে হত্যার উদ্দেশ্যে বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেয় পাক হানাদার বাহিনী। ঘরে ঢুকে রাজাকাররা গুলি করে হত্যা করে আপন ছোটভাই গোলাম সরোয়ারকে। এ সময় বড়ভাই জাফর আহম্মেদ গুলিবিদ্ধ হন। পালিয়ে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাজ করতেন। পরে ভাইয়ের হত্যাকারী রাজাকার সদস্য মীরাপাড়া গ্রামের আজিজ ওরফে আদাড়েকে হত্যা করেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে এই কথা তিনি মহকুমা শহর নড়াইলে এসে জানতে পারেন ১৬ আগস্ট সকালে। প্রচণ্ড আঘাত পান মনে। পরদিনই পত্রিকায় সে খবর ছাপা হয়, তিনি জানতে পারেন নিজের বাড়ির সিঁড়িতেই ঘাতকের বুলেটে শহীদ হয়েছেন বঙ্গবন্ধু। সিঁড়িতে খালি পায়ে বঙ্গবন্ধুর লাশ পড়ে থাকার ঘটনা শুনে প্রতিজ্ঞা করেন জীবনে আর স্যান্ডেল পায়ে দিবেন না। যেমন প্রতিজ্ঞা তেমনই কাজ। এরপর থেকে খালি পায়ে বেড়াতেন বেদুইন সাত্তার। রোদ, বৃষ্টি কিংবা শীত সবই যেন সাত্তারকে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করাতে ব্যর্থ হয়। ব্যবহার করতেন না জুতা, ছাতা ও চাদর। ২০১০ সালে বঙ্গবন্ধুর ৫ খুনির ফাঁসি কার্যকরের খবর শুনে দীর্ঘ ৩৫ বছর পর পুরোনো ছাতা, আলমারিতে রাখা চাদর আর ছেলেদের দেওয়া নতুন স্যান্ডেল ব্যবহার করা শুরু করেন এই বঙ্গবন্ধু ভক্ত।

দেশ স্বাধীনের আগে বড় জনসভা করতে পারত না আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধু নড়াইলে এলে তখনকার মহকুমা শহরের ডাকবাংলো মাঠে সভা করতেন। এর আগে দুইবার নড়াইলে এসেও সভা করতে না পেরে তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মোদাচ্ছের মুন্সি, নূর জালালদের সহায়তায় সভা করেছিলেন শহরের অদূরে নয়নপুর প্রাইমারি স্কুল মাঠে। সব সভাতেই তিনি কাছে ডাকতেন বেদুইন সাত্তারকে। প্রচণ্ড ভোজন রসিক সাত্তারকে বঙ্গবন্ধু কাছে ডেকে খাওয়াতেন। সাত্তারের স্ত্রীর নাম মমতাজ শুনে বঙ্গবন্ধু সাত্তার মোল্যার বড় ছেলের নাম জান্নাতুল ইসলাম পরিবর্তন করে রেখেছিলেন সুজাউদ্দৌলা।

নানা সংগ্রাম আর প্রতিবাদের মধ্যে কাটানো ৯৭ বছর বয়সী বঙ্গবন্ধুর বেদুইন সাত্তার বার্ধক্যজনিত কারণে নানা রোগে ভুগে অনেকটা স্মৃতিশক্তিহীন। ঘুমের ঘোরে আজও চারদিকে বঙ্গবন্ধুকেই খুঁজে ফেরেন এই মুক্তিযোদ্ধা। একা চলতে পারেন না। কখনো ছেলে কখনো ছেলের বৌয়ের হাত ধরে ঘরের বাইরে আসেন। খালি পায়ে চলা বঙ্গবন্ধুর বেদুইন সাত্তারের ভরসা এখন হুইল চেয়ার।

বয়সের ভারে নুইয়ে পড়া বেদুইন সাত্তারের দুর্বল স্মৃতিশক্তি, অগোছালো কথাবার্তা হলেও রসিকতা যেন একটুকুও কমেনি। গল্পের ছলে বলে বসেন, প্রধানমন্ত্রী হাসিনা তখন ছোট। আমি ডাকতাম রেনুর পোনা বলে, ভাবির (বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব) নাম রেনু সেটা মিলিয়ে বলতাম। আর নাসের ভাইয়ের এক পা খোঁড়া ছিল ওনাকে ডাকতাম তৈমুর লং বলে।

পাশের গ্রাম সরকেল ডাঙার ৭৮ বছর বয়সী বারিক মোল্যা বলেন, বঙ্গবন্ধুর খুলনার সমাবেশে সাত্তার মোল্যাকে আদর করে নাম দিয়েছিলেন বেদুইন সাত্তার। সেই থেকে তিনি এ নামেই পরিচিত। সাত্তার ভাই টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে প্রায়ই যেতেন। তার পরিবারের সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক ছিল সাত্তার ভাইয়ের। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর খবরে একনাগাড়ে কেঁদেছেন তিনি।

৮০ বছর বয়সী বীর মুক্তিযোদ্ধা সারোয়ার শেখ বলেন, বঙ্গবন্ধু যেখানে মিটিং করত সেখানেই হাজির থাকত বেদুইন সাত্তার। বঙ্গবন্ধু মারা যাবার পরে তিনি খালি পায়ে হেঁটেছেন বহুদিন। কিছু বললে বলত, জুতা-স্যান্ডেল পায়ে বঙ্গবন্ধুর রক্তের ওপর দিয়ে হাঁটতে পারব না। এমনকি গায়ে চাদর দিতেন না, ছাতা মাথায় দিতেন না। আমরা দীর্ঘদিন ওনাকে এভাবে দেখেছি। এ ছাড়া আগরতলা মামলার সময় আমাদের এলাকা থেকে চাঁদা তুলে তা বঙ্গবন্ধুর কাছে পৌঁছে দিতেন।

বেদুইন সাত্তারের সেজ ছেলে সিরাজুল বলেন, ছোট বেলা থেকে বাবার মুখে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের অনেক গল্প শুনেছি। বুঝতে শিখেছি যখন বাবাকে দেখছি চাদর, ছাতা ব্যবহার করতেন না। মাইলের পর মাইল খালি পায়ে হাঁটতেন। জুতা-স্যান্ডেল কিনে দিলেও পায়ে দিতেন না। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসি হওয়ার পর আব্বা বললেন, আমার মনে আর কোনো ব্যথা নাই, আমার ভাই হত্যার বিচার হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আব্বা অনেকবার একাই গিয়েছেন। ২০১৬ সালে আমি গণভবনে গিয়ে বললাম আপা আমার আব্বার নাম বেদুইন সাত্তার। আপা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, কাকা কেমন আছেন? ওনার শরীরের অবস্থা কেমন? কথা প্রসঙ্গে আপা আন্তরিকতার সঙ্গে বলে বসলেন বেদুইন কাকা তো বঙ্গবন্ধুর ভাই ছিলেন, আর আমি তো মেয়ে। ফেরার পথে প্রধানমন্ত্রী আব্বার জন্য অনেক উপহার দিলেন, আব্বার যত্ন নিতে বললেন।

নড়াইল জেলা মুক্তিযোদ্ধা সাবেক ডেপুটি কমান্ডার অ্যাডভোকেট এস এ মতিন বলেন, সাত্তার ভাই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ একজন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে তিনি বহুদিন জুতা/স্যান্ডেল পায়ে দেননি। তিনি একজন প্রকৃত শেখ মুজিবপ্রেমী।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বিপিএল মাতানো ক্রিকেটারকে ‘মুক্তি’ দিলেন আইপিএল খেলা ক্রিকেটার

ইরান ও পাক সেনাপ্রধানের ফোনালাপ, আলোচনায় ছিল যেসব বিষয়

বাচ্চা পটি করতে চাইছে না? জেনে নিন কী করবেন

সিলেটে পাথরকাণ্ডে এবার মাঠে নেমেছে সিআইডি

ভূমি অফিসের দায়িত্বে ঝাড়ুদার 

আর চাপ সহ্য করতে পারলেন না ডলি

তত্ত্বাবধায়ক বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতি 

এক নজরে দেখে নিন এশিয়া কাপে অংশগ্রহণকারী ছয় দলের স্কোয়াড

জনবল সংকট আর ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে ধুঁকছে স্বাস্থ্যসেবা

কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ

১০

পলক-আনিসুল-সালমান-কামরুলসহ ৬ জন নতুন মামলায় গ্রেপ্তার 

১১

জেনে নিন বাড়তি আয়ের ৫টি চমৎকার উপায়

১২

সীমানা পুনর্নির্ধারণ: ইসিতে চতুর্থ দিনের শুনানি চলছে

১৩

ডাকসুর ভিপি প্রার্থী জালালের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা মামলা

১৪

আইপিএল থেকে অবসরের ঘোষণা তারকা স্পিনারের

১৫

শাহবাগ মোড় অবরোধ করে প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

১৬

শাহরুখ-দীপিকার বিরুদ্ধে এফআইআর

১৭

বিদ্যুতায়িত মাকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ গেল মেয়েরও

১৮

শান্তিরক্ষা মিশনে যোগ দিতে কঙ্গো গেলেন পুলিশের ১৮০ সদস্য

১৯

স্কিন ক্যান্সারে আক্রান্ত সাবেক তারকা ক্রিকেটারের আবেগঘন বার্তা

২০
X