মিঠু দাস জয় ও শহিদুল ইসলাম সাজু, সিলেট
প্রকাশ : ০২ জুলাই ২০২৫, ০৬:০৩ পিএম
আপডেট : ০২ জুলাই ২০২৫, ০৭:৫৮ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
জুলাই আন্দোলনে নিহত

ছেলের মুখে বাবা ডাক শোনা হলো না তারেকের

শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে আদর করছেন তারেক আহমদ। পুরোনো ছবি
শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে আদর করছেন তারেক আহমদ। পুরোনো ছবি

আরিয়ান আহমদ রাফির বয়স এখন দেড় বছর। মুখে কেবল কথা ফুটতে শুরু করেছে। আধো আধো বোলে এরই মধ্যে ‘বাবা, বাবা’ ডাক শুরু করেছে। কিন্তু অবুঝ এই শিশু জানে না, বাবা বলার আগেই সে তার বাবাকে হারিয়ে ফেলেছে।

ফুটফুটে এই শিশুটির বাবা তারেক আহমদ (২৯) গত বছরের ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিজয়োৎসব করতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন। সিলেটের বিয়ানীবাজার পৌরশহরে বিকেলে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তিনি। রেখে যান ৪ মাসের ছেলে শিশু আরিয়ান ও স্ত্রী ছামিয়া আক্তারকে।

তারেক আহমদের বাড়ি বিয়ানীবাজার উপজেলার মোল্লাপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ নিদনপুর গ্রামে। তার স্ত্রী ছামিয়া আক্তারের পৈতৃক নিবাস ব্রাক্ষণবাড়িয়া হলেও জন্মসূত্রে সপরিবারে বিয়ানীবাজারের মোল্লাপুর গ্রামে বসবাস করতেন তারা। পাশাপাশি এলাকায় হওয়ায় তারেক ও ছামিয়ার মধ্যে গড়ে ওঠে প্রেমের সম্পর্ক এবং এক পর্যায়ে উভয় পরিবারের সম্মতিতেই তারেক মৃত্যুর দুই বছর আগে ছামিয়াকে বিয়ে করেন।

বিয়ের দুই বছরের মধ্যেই তাদের কোলজুড়ে আসে ফুটফুটে শিশু আরিয়ান। ছেলেকে ঘিরে দেখেছিলেন ছোট ছোট স্বপ্ন। তারেক আহমদের মৃত্যুর মাস দেড়েক পর থেকে পারিবারিক ঝামেলা তৈরি হওয়ায় তার স্ত্রী ছামিয়া আক্তার ছেলে আরিয়ানকে নিয়ে মায়ের কাছে চলে যান। এরপর থেকেই শ্বশুরবাড়ির কারও সঙ্গেই নাকি তার কোনো যোগাযোগ নেই।

কালবেলার সঙ্গে কথা হয় তারেক আহমদের স্ত্রী ছামিয়া আক্তারের। মাত্র ২২ বছর বয়সে স্বামী হারিয়ে দেড় বছরের ছেলেকে নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন ছামিয়া আক্তার। তিনি বলেন, আমার স্বামী অনেক ভালো মানুষ ছিল। দুই বছরের সংসারে সে কখনো আমার সঙ্গে একটা খারাপ কথাও বলেনি। মৃত্যুর দিন সকাল বেলা আমার ও আমার ছেলের সঙ্গে হাসিখুশি হয়ে কথা বলেছে। বিকেলে শুনি আমার স্বামীকে পাওয়া যাচ্ছে না, রাতেই শুনি তিনি আর দুনিয়াতে নাই। কথাগুলো বলতে বলতেই আবেগাপ্লুত হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

ছামিয়া আক্তার বলেন, আমার স্বামীকে নিয়ে আমি অনেক গর্ব করি। আমার স্বামী দেশের জন্য শহীদ হয়েছেন। আমার ছেলে বড় হলে তার বাবার সম্পর্কে গর্ব করে বলতে পারবে।

সরকারি কোনো সহযোগিতা পেয়েছেন কিনা জানতে চাইলে ছামিয়া আক্তার জানান, জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ টাকা এবং সিলেট জেলা পরিষদ থেকে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকার আর্থিক অনুদান পেয়েছি। তবে আমার খুব একটা চাওয়া নেই, একটা থাকার ব্যবস্থা, ছেলের ভরণপোষণ- ব্যস এতটুকুই। যদি আমাকে কেউ একটা থাকার ব্যবস্থা ও একটা ছোটখাটো চাকরি ম্যানেজ করে দিতে পারেন- তাহলে আমি আমার ছেলেকে নিয়ে জীবনের বাকিটা পথ কাটিয়ে দেব।

এখন কীভাবে চলছেন জিজ্ঞেস করতেই তিনি জানান, আমার মায়ের আশ্রয়েই আছি ছেলেকে নিয়ে। মা যতদিন বেঁচে আছেন, ভালো থাকব। কিন্তু মা না থাকলেই আমার ও আমার ছেলের কী হবে সেটা ভেবেই আমি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় থাকি।

ছামিয়া আক্তার আরও জানান, আমার স্বামীর বাড়িতে তার দুই ভাই ও দুই বোন আছেন। তাদের মা থাকলেও বাবা মারা গেছেন। বর্তমানে শ্বশুরবাড়ির কারও সঙ্গেই আমার যোগাযোগ নেই।

যোগাযোগ না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি জানান, আমার স্বামীর মৃত্যুর পর শ্বশুরবাড়ির সবাই বাইরের লোকজনদের কাছ থেকে আমি ও আমার ছেলেকে আড়ালে রাখেন। কেউ কোনো সহায়তা করলে আমি ও আমার ছেলে যাতে কোনো ভাগ না পাই, সে কারণে তারা আলাদা করে রাখত।’

কোনো সরকারি সহযোগিতা পেয়েছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, না, এখনো কোনো সরকারি সহযোগিতা পাইনি। আর বিভিন্ন দল কিংবা ব্যক্তি কর্তৃক সহযোগিতা পেলেও সেটা আমার শাশুড়ি ভালো বলতে পারবেন, তবে আমি পাইনি।

তারেকের মা ইনারুন বেগম ও বড়বোন মর্জিনা বেগম বলেন, ৫ আগস্ট বিয়ানীবাজার পৌরশহরে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ চলে। তারেকও আন্দোলনে সক্রিয় ছিল। পরিচিতজন জানান, ওইদিন দুপুরের কোনো একসময় পুলিশ তারেককে ধরে নিয়ে যায়। সারাদিন পুলিশ-জনতার সংঘর্ষ চলায় পুলিশের সঙ্গে আমরা কোনো যোগাযোগ করতে পারিনি। ঘটনার দিন সন্ধ্যার দিকে পুলিশ আর আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষে রায়হান ও ময়নুল নামের দু’জন মারা যাওয়ার খবর সমগ্র উপজেলাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। এই সংবাদে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে আমার পরিবার।

রাতের দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তারেকের খোঁজ নেন আত্মীয়-স্বজন। অনেক জায়গায় খোঁজাখুঁজির পর ৬ আগস্ট ভোরে বিয়ানীবাজার থানার সীমানা দেয়ালের কাছে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তারেককে পাওয়া যায়। তারেকের কপালে একটি এবং দুই পায়ে গুলির চিহ্ন ছাড়াও শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন ছিল। পরে তাকে উদ্ধার করে বিয়ানীবাজার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে দায়িত্বরত চিকিৎসকরা তারেককে মৃত ঘোষণা করেন।

এদিকে, তারেক আহমদ নিহত হওয়ার ঘটনায় গত বছরের ২০ আগস্ট বিয়ানীবাজার থানায় মামলা করেন মা ইনারুন বেগম। পরবর্তীতে মামলা দায়েরের দু’দিন পর তিনি আদালতে মামলা প্রত্যাহারেরও আবেদন করেন।

তবে এসবের সঙ্গে নিজেকে জড়াতে চান না বলে জানান শহীদ তারেকের স্ত্রী ছামিয়া আক্তার। তিনি বলেন, যারা আমার স্বামীকে গুলি করেছে, তাদের বাদ দিয়ে অন্যদের নামে মামলা-মোকদ্দমা করে কী লাভ?

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

‘আমার লক্ষ্য কেবল নির্বাচন নয়, জনগণের অধিকার নিশ্চিত করা’

চাঁদপুরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হত্যা মামলার আসামি গ্রেপ্তার

ঘুষ লেনদেনের ভিডিও ভাইরাল, এসআই প্রত্যাহার

বন্ধুর ছুরিকাঘাতে বন্ধু খুন

ইসরায়েলের পতাকা হাতে ভিডিও ভাইরাল, মিস ইন্দোনেশিয়া থেকে তরুণী বাদ 

ইরানের পাঁচশ মিসাইলের মধ্যে ২০০টি ঠেকিয়ে ইসরায়েলের খরচ গেল কত?

নির্বাচিত সরকার ছাড়া মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে না : লায়ন ফারুক

জনগণকে ভোটাধিকার বঞ্চিত রাখার চক্রান্ত রুখে দেয়া হবে : মুরাদ

সদস্যপদ নবায়ন কার্যক্রম গতিশীল করতে বৈঠক বিএনপির

জবাবদিহিমূলক সরকার গড়বে বিএনপি : আমিনুল হক

১০

স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে ডিএসসিসির সঙ্গে এনজিও’র সমঝোতা সই

১১

যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে জামায়াত নেতৃবৃন্দের অংশগ্রহণ

১২

বৈষম্যবিরোধী-এনসিপির আন্দোলনের মুখে পটিয়া থানার ওসিকে প্রত্যাহার

১৩

এনসিপির কার্যালয়ের সামনে ফের ককটেল বিস্ফোরণ 

১৪

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চিত্র প্রদর্শনী উদ্বোধন / শেখ হাসিনার চাইতে নির্দয় নারী ঘাতক আর আসবে কিনা সন্দেহ আছে : এবি পার্টি

১৫

ঢাকায় মানি এক্সচেঞ্জ কর্মীর পরিকল্পনায় ৫ লাখ রিয়াল ছিনতাই

১৬

৭ জেলেসহ বঙ্গোপসাগরে ট্রলার ডুবি, অতঃপর...

১৭

সিলেটে জেলা প্রশাসকের অপসারণ চাইলেন সাবেক মেয়র আরিফুল

১৮

প্রবাসীদের বড় সুখবর দিল সরকার 

১৯

সাবেক এমপি নাঈমুর রহমান দুর্জয় গ্রেপ্তার

২০
X