সোহেল রানা ডন। এই ‘ডন’ পরিচিত ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম মেম্বার ও রাজশাহী সিটির সাবেক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের ‘কথিত পুত্র’ হিসেবে। লিটনের স্ত্রী শাহীন আক্তার রেণীর সঙ্গেও ছিল অনেকটা মা-ছেলে সম্পর্ক। ডন রাজশাহীতে পরিচিত ছিলেন আওয়ামী লীগের অর্থদাতা হিসেবে। রয়েছে প্রশ্নফাঁসের মতো ভয়াবহ জালিয়াতির অভিযোগ। জুলাই আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলার অভিযোগে মামলাও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সেই মামলায় সম্প্রতি জেল খেটেও বের হয়েছেন তিনি।
আওয়ামী লীগের এই ‘দোসর’ ‘ডন’ রয়েল মেডিকেল ভর্তি কোচিং ও বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং ‘ইউসিসি’-এর রাজশাহী শাখার মালিক। তবে সম্প্রতি ডন তার ব্যবসা বাঁচাতে ‘ইউসিসি’ কোচিং সেন্টারের রাজশাহী শাখার ব্যবস্থাপক পদে নিয়োগ দিয়েছেন ছাত্রদলের রাজশাহী নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজ শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক ওয়াসিফ আব্দুল্লাহকে।
অভিযোগ রয়েছে, একসময় সোহেল রানা ডন রাজশাহীর সাবেক সিটি করপোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের বড় মেয়ে আনিকা ফারিহা জামান অর্ণাকে প্রাইভেট পড়াতেন। সেই সুবাদে পরে তিনি রাজশাহী ওয়াসায় চাকরি পান। সাবেক মেয়রের স্ত্রী শাহীন আখতার রেনী রাজশাহী ওয়াসার পরিচালনা বোর্ডের সদস্য ছিলেন। তিনি সোহেল রানা ডনের মাধ্যমেই পুরো ওয়াসা নিয়ন্ত্রণ করতেন। সরকারি চাকরিতে যোগদানের আগে থেকেই ডন কোচিং ব্যবসায় জড়িত ছিলেন।
কোচিং ব্যবসায় জড়িত থাকার সুবাদে ২০১৬ সালে প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে সোহেল রানা ডনসহ ১১ জনকে গ্রেপ্তার করেছিল ডিবি পুলিশ। সেসময় তাদের কাছ থেকে জব্দ করা মোবাইল ও ল্যাপটপে বিভিন্ন প্রশ্নপত্র পাঠানোর আলামত পাওয়া যায়। কয়েক মাস জেলে থাকার পর তিনি প্রভাবশালী মহলের সহযোগিতায় মুক্তি পান এবং চাকরিতেও বহাল হন।
জানা গেছে, সোহেল রানা ডন ওয়াসার প্রকৌশলীর পাশাপাশি সুলতান ডাইনসের রাজশাহী শাখার মালিক। ওয়াসার ঠিকাদারি কাজেরও একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল তার হাতে। পুরো ওয়াসাই ছিল ডনের হাতের মুঠোয়। অনেক সিনিয়রদের বাদ দিয়ে রাজশাহী ওয়াসার ১০০ কোটি টাকার প্রকল্পের পরিচালকের দায়িত্বও নেন ডন। পুরো প্রকল্পে ব্যাপক লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে।
সূত্র জানায়, রাজশাহীতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন ডন। ৫ আগস্ট রাজশাহী নগরীর আলুপট্টিতে আন্দোলনের ওপর হামলাকারী ছাত্রলীগ-যুবলীগের অস্ত্র ও অর্থ জোগান দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। রাজশাহী আদর্শ কারিগরি ও বাণিজ্যিক কলেজের শিক্ষার্থী রক্তিম ইসলাম রিমন বাদী হয়ে নগরীর বোয়ালিয়া থানায় একটি মামলা করেন। সেই মামলার এজাহারে ৪ নম্বরে সোহেল রানা ডন ও ৫ নম্বরে ছিল তার স্ত্রী সায়েরা বানুর নাম। এই মামলায় গত ৯ ডিসেম্বর তিনি গ্রেপ্তার হয়ে জেলহাজতে ছিলেন।
সম্প্রতি তিনি জেল থেকে বের হয়ে সখ্য গড়েন স্থানীয় সুবিধাভোগী বিএনপির একটি গ্রুপের সঙ্গে। বিএনপির এই গ্রুপটি প্রত্যেক মাসে তার থেকে মোটা অঙ্কের মাসোহারা নেন। বিনিময়ে ‘ডন’ এর সেফটি ও তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কোনো ক্ষতি হবে না তার গ্যারান্টি দিচ্ছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির এক নেতা বলেন, এই ডন রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের অস্ত্র ও অর্থযোগান দাতা। ওয়াসার শতকোটি টাকা প্রকল্পের পিডি ছিলেন। সেই প্রকল্প হরিলুট করে তিনি নিজের ও লিটনের স্ত্রীর পকেট ভরেছেন। এখন এই ডনকে বিএনপির একটি গ্রুপ মোটা টাকার বিনিময়ে সাপোর্ট দিচ্ছেন। বিএনপির ওই গ্রুপ জুলাই বিপ্লব ও দলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। যা মেনে নেয়া যায় না।
মহানগর যুবদলের এক নেতা বলেন, ডন বিএনপির একটি গ্রুপের ছত্রছায়ায় আবারো আবারও ‘ডন’ হয়ে উঠেছেন। সম্প্রতি ইউসিসি কোচিং সেন্টার রাজশাহী শাখায় ছাত্রদলের এক নেতাকে ব্যবস্থাপক পদে নিয়োগ দিয়ে তার ব্যবসার বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
ডনের ইউসিসি কোচিং সেন্টারের ব্যবস্থাপক পদে যোগদানের বিষয়ে ছাত্রদল নেতা ওয়াসিফ আব্দুল্লাহ কালবেলাকে বলেন, এটি সম্পূর্ণ অসত্য। আমাকে আসলে কিছুদিন থেকে একটি আমার নামে মানুষের কাছে মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে হেয়প্রতিপন্ন করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলেছে। আমাকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হামলাকারী বানাতেও ও গ্রুপটি পিছপা হয়নি। আমি ২০১৬ সাল থেকে ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আমি ডনের কোচিং সেন্টারের সঙ্গে জড়িত নই।
ছাত্রদলের এই নেতা ডনের ইউসিসি কোচিং সেন্টারের ব্যবস্থাপক পদে থাকার কথা অস্বীকার করলেও ইউসিসি কোচিং সেন্টারের পরিচালক কামাল উদ্দিন পাটোয়ারি বলেন, রাজশাহীতে ওয়াসিফ আব্দুল্লাহ নামের একজন ইউসিসি রাজশাহী শাখার ব্যবস্থাপক।
সার্বিক বিষয়ে কথা বলতে সোহেল রানা ডনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তা রিসিভ হয়নি। ফলে তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
মন্তব্য করুন