গোটা বছর কেটে গেছে। ভাঙ্গার শহীদ পরিবারগুলো আজও কাঁদছে, বুকে চাপা আক্ষেপ আর চোখের জলে। শহীদ খালিদ হাসান সাইফুল্লাহ, শহীদ শিশু আহাদ ও শহীদ তামিম শিকদার—তিনটি তরতাজা প্রাণ, তিনটি অসমাপ্ত গল্প, তিনটি তাজা কবর।
আর সেই কবরগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে এখনো প্রতিটি দিন কাটাচ্ছে তিনটি পরিবার—একটি অভিন্ন প্রশ্ন তাদের তাড়া করে ফেরে, আমাদের সন্তানকে গুলি করল কারা? কেন তারা এখনো ধরা পড়েনি?
শহীদ খালিদ সাইফুল্লাহ : ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই, আসরের নামাজ পড়ে বাসায় ফিরছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র খালিদ হাসান সাইফুল্লাহ। আজিমপুর সরকারি আবাসিক এলাকার পাশে পড়ে থাকতে দেখা যায় তার নিথর দেহ। বন্ধুরা তখনো ভাবছিল, বাঁচিয়ে তোলা যাবে। তাকে নিয়ে যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে; কিন্তু সব শেষ হয়ে গিয়েছিল।
রাত ১১টার পরে খবর পেয়ে বাবা ডা. কামরুল হাসান ছুটে যান ইমার্জেন্সিতে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা খোঁজার পর রাত ১টায় লাশের স্তূপের ভেতর ছেলের গুলিবিদ্ধ দেহ খুঁজে পান তিনি। খালিদের বুকে ছিল ৭০টি বুলেটের দাগ। শুধু একজন ছাত্রকে হত্যার জন্য—৭০টি গুলি! চার দিন পর্যন্ত বাবা ছেলের লাশ পাননি।
তিনি জানালেন, ‘সাবেক লালবাগ থানার ওসি খন্দকার হেলাল উদ্দিন খালিদকে গুলি করার প্রকাশ্যে হুকুম দেয়। আমি নিজ চোখে দেখিনি; কিন্তু ছেলের বন্ধুরা, প্রত্যক্ষদর্শীরা জানে—ওসি হেলালই হুকুমদাতা। অথচ সেই হেলাল উদ্দিন আজও বহাল তবিয়তে চাকরি করছেন। তিনি মহালছড়ি ব্যাটালিয়নে পোস্টেড!’
ডা. কামরুল হাসান আরও বলেন, ‘আমি এক মুহূর্তের জন্য লাশের পাশে থেকে সরিনি, কারণ ওসি হেলাল লাশটাও গুম করতে চেয়েছিল। আমার কল্পনা হয় না—চার দিন পর গলিত লাশ হাতে পেয়েছিলাম। মামলা করেছি ১৯ আগস্ট, শেখ হাসিনা, হেলাল উদ্দিনসহ ৫২ জন এবং ২৫০ অজ্ঞাত ব্যক্তির বিরুদ্ধে। কিন্তু এখনো কেউ ধরা পড়েনি। তাহলে কীসের বিচার হলো?’
শহীদ আহাদ : গত বছরের ১৯ জুলাই শনির আখড়ায় এক মর্মান্তিক দৃশ্য; সাত তলা ভবনের বারান্দায় বাবা আবুল হাসান শান্তর কোলে দাঁড়িয়ে ছিল ছোট্ট আহাদ। হঠাৎ মাথায় গুলি লাগে। ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকরা বলেন, সব শেষ।
আহাদের বাবা শান্ত বলেন, ‘আমার ছেলে মাথায় গুলি খেয়েছে, সামনে তার মা ছিল, আমি কোলে নিয়েছিলাম। তবু কারা গুলি করল, পুলিশ বলতে পারল না? মামলাও খারিজ হয়ে গেছে। তারা বলেছে, খুনি শনাক্ত করা যায়নি। আমি বিশ্বাস করি, আল্লাহ বিচার করবেন। কিন্তু রাষ্ট্র কিছুই করবে না?’
এখনো শান্তর পরিবার থাকে পুখুরিয়ার সেই ঘরে, যেখানে ঘরের এক কোণায় ছোট্ট আহাদের কবরে প্রতি সন্ধ্যায় মা ও দাদি আগরবাতি জ্বালিয়ে বসে থাকেন।
শহীদ তামিম শিকদার : ১১ বছরের শিশু তামিম, বনশ্রীর ফরাজি হাসপাতালের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় ১৯ জুলাই বিকেল ৫টায়। মা-বাবার স্বপ্ন ছিল, তাদের ছেলে একদিন বড় অফিসার হবে। ফরিদপুরের খাপুরা গ্রামের দিনমজুর বাবা জুয়েল শিকদার সেই স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন। এখন সেই স্বপ্ন ভেঙে গেছে। তামিমের লাশ পরদিন মোল্লাবাড়ি কবরস্থানে দাফন করা হয়।
তামিমের বাবা জুয়েল বলেন, ‘আমার একমাত্র ছেলে। তাকে মানুষ করতেই শহরে গিয়েছিলাম। এখন ছেলেই নেই, ঢাকায় থেকে কি করব? ফিরে এসেছি গ্রামে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা করেছি। এখন নতুন সরকার এসেছে। ইউনূস সরকারকে বলতে চাই, আমার ছেলের বিচার যেন দ্রুত পাই।’
তিনটি পরিবার, তিনটি কবর, তিনটি জীবন থেমে গেছে; কিন্তু সাবেক লালবাগ থানার ওসি খন্দকার হেলাল উদ্দিন এখনো চাকরিতে বহাল। তদন্ত কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর সাজ্জাদ হোসেন বলেছেন, ‘মামলায় ওসি হেলালের নাম নেই। তবে তদন্তে তার ভূমিকা পাওয়া গেলে তাকে আসামি করা হবে।’
কিন্তু ডা. কামরুল হাসান বলেছেন, ‘তিনি ৫২ নম্বর আসামি। তাহলে নাম নেই বলে তদন্ত কর্মকর্তা কী বলছেন?’
শহীদদের পরিবার শুধু ক্ষতিপূরণ চায় না, চায় বিচার : তিন পরিবারই জানিয়েছে, তারা ৫ লাখ টাকা করে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে এবং ১০ লাখ টাকা করে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের সঞ্চয় স্কিমে পেয়েছে। কিন্তু তাতে কী ক্ষতিপূরণ হয় সন্তানহীনতার?
একটি বাবার চোখের পানি, একটি মায়ের হৃদয়ের আর্তনাদ—কোনো টাকায় সে মুছে যাবে?
শুধু প্রশ্ন রয়ে যায়, ‘রাষ্ট্র কি শুধু পুষে রাখবে খুনিদের, আর শহীদের পরিবারের জন্য রাখবে দীর্ঘশ্বাস?’ এ দীর্ঘশ্বাসই কী একদিন জ্বলে উঠবে আরও বড় অভ্যুত্থানের? তার আগে, রাষ্ট্র কি শুনবে এ তিন কবরের কান্না?
মন্তব্য করুন