জলাবদ্ধতা জামালপুর পৌরসভার বাসিন্দাদের নিত্যসঙ্গী। আগে এটি মৌসুমি সমস্যা হিসেবে দেখা দিলেও— এটি এখন তাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একসময় যা ছিল বর্ষাকালের ঝামেলা, তা এখন সারা বছরের সংকটে রূপ নিয়েছে, হাজার হাজার মানুষ জমে থাকা পানিতে বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হয় প্রতিদিন।
জানা যায়, ১৮৭০ সালের ১ এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত হয় দেশের অন্যতম প্রাচীন জামালপুর পৌরসভা। দেড় শতাব্দীরও বেশি সময় আগে যাত্রা করা এ পৌরসভা শহরের নালা-নর্দমার মতো একটি মৌলিক সমস্যার সমাধান হয়নি। স্থানীয়দের অভিযোগ, নিয়মিতভাবে কর আদায় করা হলেও সমস্যার কার্যকর সমাধানে কোনো উদ্যোগ তারা দেখতে পায়নি।
শহরের পিটিআই এলাকার পশ্চিম ফুলবাড়িয়া রোডের বাসিন্দা সিনিয়র সাংবাদিক মোস্তফা মঞ্জু দুঃখ প্রকাশ করে কালবেলাকে জানান, তার বাসার আশপাশে এখনো এক ফুট উচ্চতার জলাবদ্ধতা রয়েছে। বেশি বৃষ্টি হলে দুই-তিন ফুট উচ্চতার জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। বছরের পর বছর ধরে ড্রেন পরিষ্কার করা হয় না, বারবার বলেও উল্লেখযোগ্য সমাধান পাওয়া যায়নি বলে জানান তিনি।
শহরের পালাশগড়ে ২০০-এর বেশি পরিবার প্রায় বিচ্ছিন্ন অবস্থায় বসবাস করছে। তাদের একমাত্র প্রবেশপথটি বছরের বেশিরভাগ সময় পানির নিচে থাকে। ফলে রোগী নেওয়া, বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানো কিংবা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস আনা-নেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। জমে থাকা পানিতে বিভিন্ন পানিবাহিত রোগেরও জন্ম দিচ্ছে, বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে।
গত এক দশকে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। অন্তত ১০০ হেক্টর উর্বর জমি এখন স্থায়ীভাবে পানির নিচে, কচুরিপানা ও অন্যান্য জলজ উদ্ভিদে ঢেকে গেছে। হ্যাচার, কাজির আখ ও পালাশগড়ে প্রায় ৩০০ একর আবাদি জমি আর চাষের উপযোগী নেই। একসময় এখানে ধান, পাট, আখ আর শাকসবজি চাষ করতাম, বলেন মনিরাজপুর গ্রামের কৃষক মঈন উদ্দিন। গত ১০ বছরে এক ফোঁটা ফসলও তুলতে পারেননি তিনি।
ফারহাদ হোসেন নামে এক কৃষক এর জন্য অপরিকল্পিত সড়ক নির্মাণকে দায়ী করেছেন। বাইপাস সড়ক হওয়ার পর আমাদের জমি জলাশয়ে পরিণত হয়েছে। রাস্তা যেন বাঁধের মতো কাজ করছে, প্রাকৃতিক নিষ্কাশন বন্ধ করে দিয়ে জমিতে পানি আটকে রাখছে, বলেন তিনি।
বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয়দের মতে, সমস্যার মূল কারণ হচ্ছে গোবা ও বানিয়াবাজার খাল নামে শহরের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া দুটি বড় খাল একসময় এগুলো ছিল শহরের প্রধান নিষ্কাশন পথ; কিন্তু ধীরে ধীরে খাল দুটির বেশি অংশ দখল ও ভরাট হয়ে যাওয়ায় অতিরিক্ত পানি বের হওয়ার আর কোনো পথ নেই।
অপরিকল্পিত নগরায়ণ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, শেখের ভিটার একটি কালভার্ট এখন আর কাজ করে না, কারণ কিছু লোক অবৈধভাবে মাটি ভরে তার ওপর স্থাপনা গড়ে তুলেছে। ফলে শান্তিনগরে ঘরেঘরে হাঁটুসমান পানি ঢুকে যায়, মানুষ পানির ভেতরেই বসবাস করতে বাধ্য হয়।
এভাবে চলতে থাকলে পরবর্তী সময়গুলোতে বর্ষায় পুরো শহর ভয়াবহ জলাবদ্ধতায় ডুবে যেতে পারে বলে মনে করেন জামালপুর নাগরিক ভয়েসের সভাপতি সাংবাদিক কাফি পারভেজ। শহরবাসীকে সচেতন হওয়া এবং পৌর কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা ছাড়া এ সমস্যার সমাধান হবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তবে কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, তারা সমাধানের পথে কাজ করছে। এ নিয়ে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরের প্রধানদের সঙ্গে আলোচনা করেছে বলে জানান তারা। দ্রুত সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছেন বলে দাবি কর্তৃপক্ষের। পানি উন্নয়ন বোর্ডও সেরকম পদক্ষেপ নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে। জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নকিবুজ্জামান খান বলেন, আমরা গোবা খাল খননের একটি প্রস্তাব প্রস্তুত করছি এবং তা উচ্চ কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাব; কিন্তু স্থানীয়দের আস্থা কম। তাদের মতে, অতীতের প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবে কোনো সমাধান আনেনি।
এদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক জাকিয়া সুলতানা প্রস্তাব দিয়েছেন, জমি যদি আর আবাদযোগ্য না থাকে তবে সেগুলোকে মৎস্য প্রকল্পে রূপ দেওয়া যেতে পারে—যদিও তা নির্ভর করবে জমির মালিকদের সম্মতির ওপর।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী জাহিদ পারভেজ বলেন, আমরা সবাই— জামালপুরের জেলা প্রশাসক, পৌরসভা প্রশাসন, স্থানীয় সরকার বিভাগ ও পানি উন্নয়ন বোর্ড—সম্মিলিতভাবে জলাবদ্ধতা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের পরিকল্পনা করছি; কিন্তু আপাতত পানি ক্রমেই বাড়ছে, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ঘরবাড়ি, স্বাস্থ্য ও জীবিকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জামালপুর জেলা প্রশাসনের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক ও জামালপুর পৌরসভার প্রশাসক এ কে এম আব্দুল্লাহ বিন রশিদ বলেন, ডিসি কাপ ফুটবলের ফাইনাল ম্যাচ তাই একটু ব্যস্ত আছি। এ বিষয়ে পরে কথা বলবেন বলে জানান তিনি।
মন্তব্য করুন