টঙ্গীর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের বেহাল দশা। মানবেতর জীবন পার করে এখানকার বন্দি ও কর্মরতরা। কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে ৭শ বন্দির জন্য আছে মাত্র একজন নার্স। নেই কোনো ডাক্তার।
১৮ বছরের মধ্যে কোনো শিশু-কিশোর অপরাধীকে আদালতের মাধ্যমে টঙ্গীর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে বন্দি রাখা হয়। বাংলাদেশের একমাত্র শিশু-কিশোর বন্দিশালা এটি। এই বন্দিশালার উদ্দেশ্য শিশু বা কিশোর বয়সের অপরাধীদের জীবনমানের উন্নয়ন করে নৈতিক শিক্ষা দিয়ে ভালো মানুষ হিসেবে সমাজে বেড়ে ওঠার সুযোগ দেওয়া।
কিন্তু টঙ্গীর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে বন্দি শিশু-কিশোররা মানবেতর জীবনযাপন করছে এমনকি তাদের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যরাও অমানবিকভাবে বসবাস করছেন। প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার ক্ষেত্রে সমাজসেবা অধিদপ্তরের লোকবলের সাথে আনসার সদস্যদের অভ্যন্তরীণ বিরোধে অনিরাপদ হয়ে যাচ্ছে বন্দি শিশু-কিশোররা।
প্রায় ৭শ বন্দির চিকিৎসার জন্য কোনো ডাক্তার নেই। আছে একজন নার্স মাত্র। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে এই সংশোধনী প্রতিষ্ঠানটি অনুপযোগী হয়ে যাবে শিঘ্রই এমন আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সোমবার (১৯ জুন) সরেজমিন টঙ্গীর কলেজগেট এলাকায় অবস্থিত টঙ্গী কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে গিয়ে এসব তথ্য পাওয়া যায়।
সরেজমিনে দেখা যায়, এই প্রতিষ্ঠানে সমাজসেবা অধিদপ্তরের লোকবল রয়েছে ৩৯ জন। এরমধ্যে ১০ জন মহিলা ও ২৯ জন পুরুষ। নিরাপত্তার জন্য আনসার রয়েছে ৫৪ জন। বর্তমানে বন্দির সংখ্যা ৬৯৮। কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে প্রবেশ করার সাথে সাথে আনসার সদস্যদের বিস্তর অভিযোগ পাওয়া যায়। আনসারদের ব্যারাকে গিয়ে দেখা যায়, জীর্ণ ভবনের পরিত্যক্ত রুমের ভেতরে আনসার সদস্যরা থাকেন। ছোট ছোট চৌকি রয়েছে কয়েকটি রুমে। বেশ কয়েকটি রুমে কোনো চৌকিও নেই। ফ্লোরে বিছানা করে বন্দিদের মতো থাকতে হচ্ছে আনসার সদস্যদের। আনসারদের থাকার অনেক রুমে পাওয়া যায়নি কোনো ফ্যান বা লাইটও। এই মানবেতর জীবনযাপনের ব্যাখ্যা দিয়েছেন অংখ্য আনসার সদস্য।
তাদের অভিযোগ, ‘কর্তৃপক্ষকে বারবার বলেও কোনো সুরাহা হয়নি। তারা আমাদের কোনো কথা বা দাবি শুনেন না।’
আনসার সদস্য আব্দুল কাইয়ুম জানান,‘কোনো বন্দির জন্য খাবার আসলে সিভিল নিরাপত্তাকর্মীরা খাবার রেখে দেয়। টাকা দিলে খাবার বন্দিদের ডেকে ডেকে দেওয়া হয়। যেসব বন্দির টাকা নাই, তাদের খাবার দেওয়া হয় না। এ ছাড়া কোন বন্দির পরিবারের লোকজন আসলে বিভিন্ন জিনিসপত্র নিয়ে আসে। ওইসব জিনিসপত্রের সাথে মাদক বা ক্ষতিকর কোন দ্রব্য আছে কি না তাও পরীক্ষা করা যায় না। কারণ সিভিল কর্মীরা আনসারদের সে দায়িত্ব পালন করতে দেয় না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের কাজ হলো বন্দিদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তল্লাশি করার পর বন্দি বা তাদের জিনিসপত্র প্রবেশ করতে দেওয়া। কিন্তু আমরা তা করতে পারছি না। কোনো বন্দি অসুস্থ হলে বন্দিদের কক্ষ থেকে নামিয়ে নিচে আনা আমাদের কাজ। এরপর কর্তৃপক্ষ চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে। কিন্তু কোনো বন্দি অসুস্থ হলে বারবার বলার পরও চিকিৎসা হয় না।’
আনসার সদস্য খায়রুল ইসলাম বলেন, ‘কোনো বন্দি ব্লেড কিংবা অন্য কোনো জিনিস পেয়ে গেলেও আমরা কিছু করতে পারি না। কারণ তাদের ও তাদের জিনিসপত্র পরীক্ষা করতে দেওয়া হয় না আমাদের। কোনো বন্দি অসুস্থ হলে তাকে নাপা ও প্যারাসিটামল ছাড়া আর কোনো ওষুধ দেওয়া হয় না।
কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের গেটে অপেক্ষমাণ ফেনী সদর থানার রামপুর গ্রামের ইদ্রিস আলীর ছেলে রায়হান মিয়া জানান, ‘গেল শনিবার তার আত্মীয় রুবেল হোটেল থেকে ছিনতাইয়ের অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়ে এই কেন্দ্রে বন্দি আছে। আজকে তার জামিনের জন্য ওকালতনামা নিয়ে এসেছি। কিন্তু কাউকে পাচ্ছি না অনেকক্ষণ ধরে।’
রায়হানের মতো অসংখ্য বন্দির আত্মীয়স্বজন নানা কারণে এসেছেন। কিন্তু কেউ তাদের সহযোগিতা পর্যন্ত করছেন না। ফলে দীর্ঘক্ষণ তারা দাঁড়িয়ে আছেন অসহায়ের মতো।
টঙ্গী কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের ভেতরে বাইরে ও একাধিক গোপন সূত্র জানায়, ‘কোনো বন্দি অসুস্থ হলে কমপক্ষে ৪-৫ ঘণ্টা পর তার চিকিৎসা শুরু হয়। বন্দিদের প্রতিটি কক্ষে একজন করে ক্যাপ্টেন ও একজন করে সহকারী ক্যাপ্টেন রয়েছে। মোট ৬ জন ক্যাপ্টেন ও ৬ জন সহকারী ক্যাপ্টেন আছে। ক্যাপ্টেনরা বন্দিদের মারধর করে। টাকা না দিলে মোবাইল ফোনে পরিবারের সাথে কথাও বলতে দেয় না। এমনকি খাবার ও অন্যান্য জিনিসপত্র যা পরিবারের লোকজন দিয়ে যায় তাও দেওয়া হয় না বন্দিদের। বন্দিদের সাথে অমানবিক আচরণ করা হয়। এই প্রতিষ্ঠানের তিন সদস্যের একটি সিন্ডিকেট সব নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে এই প্রতিষ্ঠান অনিয়মের কাছে জিম্মি হয়ে গেছে।
টঙ্গী কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের আনসারদের প্রধান (পিসি) তোফাজ্জেল হোসেন জানান, ‘আমাদের কিছু সমস্যা আছে। গতকাল (রোববার) বেতনের জন্য আমরা দাবি করেছিলাম। আমাদের বেতন দেওয়া হয়েছে। আরও কিছু সমস্যা আছে। আমি নতুন এসেছি। আস্তে আস্তে সব বিষয় জানতে পারব।
সার্বিক বিষয় সম্পর্ক জানতে ২০১৯ সালের ১ আগস্ট যোগদান করা টঙ্গী কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক মোহাম্মদ এহিয়াতুজ্জামানের সাথে দেখা করলে তিনি ক্যামেরার সামনে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। তবে ক্যামেরার বাইরে মৌখিকভাবে তিনি জানান, আনসারদের অভিযোগসহ সব অভিযোগ মিথ্যা। তবে আনসারদের আবাসন সমস্যা সমাধানের জন্য চিঠি লেখা হয়েছে। প্রায় ৭শ বন্দির চিকিৎসার জন্য একজন নার্স মাত্র স্বীকার করে তিনি বলেন, আরও পোস্ট আছে। লোক নেই। ডাক্তারও নেই।
এ অবস্থায়, বাংলাদেশের একমাত্র কিশোর সংশোধনাগার টঙ্গী কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের অনিয়ম উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত করে ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের বিপদ ডেকে আনতে পারে বলে আশঙ্কা ভুক্তভোগীসহ সংশ্লিষ্টদের।
মন্তব্য করুন