রংপুরের প্রবেশদ্বার মর্ডান মোড় সংলগ্ন এক কৃষ্ণচূড়ার গাছে হাজার হাজার চড়ুই পাখির মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য বলে প্রকাশ করতে পারছেন না পথচারীরা। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা পাখিগুলোর কিচিরমিচির শব্দে আনন্দে আপ্লুত হয় পথিকদের ক্লান্ত মন। সন্ধ্যা হলেই পাখিগুলোর কিচিরমিচির শব্দ শুনে ও সৌন্দর্য দেখে থমকে দাঁড়ায় তারা। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে গাছের দিকে। কৃষ্ণচূড়ায় যেন পাখির মেলা বসেছে। পাখিগুলো দেখে মনে হয় কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে যেন থোকায় থোকায় ফল এসেছে। এমন দৃশ্য ধরে রাখার জন্য ছবি না তুলে আর থাকতে পারেন না পথিকরা। ক্যামেরা কিংবা মোবাইলে ফ্রেমবন্দি করে রাখতে দেরি করেন না তারা।
প্রতিদিন যখন পূর্ব আকাশে সূর্য ওঠে, দিনের আলো ফোটে; ঠিক তখনই চড়ুই পাখিগুলো কিচিরমিচির শব্দে গান করতে করতে খাবারের সন্ধানে ছুটতে থাকে। সারাদিন বিভিন্ন জায়গায় উড়ে উড়ে হাজারো বিপদকে অতিক্রান্ত করে খাবার সংগ্রহ করতে থাকে। অনেক পাখি মাইলের পর মাইল ছুটে চলে খাবারের সন্ধানে। খাবার শেষে গোধূলীলগ্নে একে একে ছুটে আসে নিরাপদ আশ্রয়ে। কিচিরমিচির শব্দে চড়ুই পাখিগুলো এক ডাল থেকে অন্য ডালে উড়ে বসে। যেন তাদের আনন্দের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। দেখে মনে হয় যেন তারা সুখ-দুঃখের গল্প করছে একে অপরের সঙ্গে।
চড়ুই পাখি দেশের সর্বত্র দেখা গেলেও রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরে মডার্ন মোড়ের অর্জন নামক স্মৃতিস্তম্ভের পশ্চিমে বেশ পুরোনো একটি কৃষ্ণচূড়া গাছে দেখা যাবে এক নতুন অভিজ্ঞতা। প্রায় ৫-৬ হাজার চড়ুই পাখির বসবাস। হঠাৎ করে হাজারো চড়ুই পাখি দেখে মনে হবে এগুলো পাখি নাকি অন্যকিছু। কারণ ডালে ডালে এত বেশি পাখি, যা সত্যিই অবাক করার মতো। এই সৌন্দর্য দেখে বিমোহিত হয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসা পথিকরা।
শহর থেকে চড়ুই পাখি বিলুপ্তির কারণে বাসার জানালা বা ছাদগুলোতে চড়ুই পাখির ডাকাডাকির মতো দৃশ্য এখন অপরিচিত হয়ে উঠেছে। কেননা, কংক্রিটের এই জঙ্গল থেকে চড়ুই খুব দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া গাছের পরিমাণ ব্যাপক মাত্রায় হ্রাস পাওয়া, বাসা তৈরির উপযোগী পরিবেশের অভাব, দেশীয় গাছের অনুপস্থিতি, ঝোঁপ-জঙ্গলের অভাব, আধুনিক সুপার শপ, শিকারির পরিমাণ বেশি ও কুসংস্কারের কারণে চড়ুই পাখি হারিয়ে যাচ্ছে। অনেকেই বিশ্বাস করে যে চড়ুই পাখির মাংস যৌন উদ্দীপক। এই কুসংস্কারের কারণে মানুষও চড়ুই পাখি শিকার করে। এটি চড়ুই পাখিকে আরও বেশি হুমকি মুখে ঠেলে দিয়েছে। এমতাবস্থায় মর্ডান মোড়ের এই কৃষ্ণচূড়া গাছের চড়ুই পাখি সংরক্ষণ একান্ত জরুরি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে রাতে আলোয় ঝলমল করে মুনির ফল ভাণ্ডার নামের এক ফলের দোকান। পাখিগুলো সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে ফল ব্যবসায়ী মুনির কালবেলাকে বলেন, ‘আমার দোকান দেওয়ার বয়স ৬ বছর। তখন থেকে দেখি গাছে চড়ুই পাখিরা ভিড় করে। এর আগে গাছটি ছোট থাকায় তেমন পাখি ছিল না। পাখিগুলো শুধু রাতের বেলায় থাকে এবং সূর্যোদয় হলে খাওয়ার সন্ধানে চলে যায়। গোধূলীলগ্ন হলেই পাখিগুলো গাছে আসা শুরু করে। শীতকাল হলে পাখিগুলো কোথায় যেন চলে যায় আবার গরম শুরু হলে চলে আসে। সব মহান আল্লাহর ইচ্ছা।
পাখিগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কাউকে পাখি ধরতে দেওয়া হয় না এবং গাছের ডালগুলো বড় হয়ে নিচে নেমে আসলে তা ছেঁটে দেওয়া হয়।
কৃষ্ণচূড়া গাছের পাশের হোটেলের মালিক ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘চড়ুই পাখিগুলোর সৌন্দর্য বলে প্রকাশ করার মতো না। যানবাহনের উচ্চ আওয়াজে মনের মধ্যে বিরক্তি নিয়ে আসেন পথিকরা। কিন্তু পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ তাদের বিরক্তি অনেকটা দূর করে দেয়। অনেকেই আসেন পাখিগুলো দেখতে। পাখিগুলোর খাবার ও নিরাপদ বাসস্থান নিয়ে কারও কোনো মাথা ব্যথা নেই। এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। যদি বন বিভাগ পাখিদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিতো তাহলে অনেক ভালো হতো।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রংপুর বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোল্লা মোহাম্মদ মিজানুর রহমান কালবেলাকে বলেন, বিষয়টি আমার অবগত ছিল না। কিছুদিনের মধ্যেই এটা তদন্তের জন্য লোক পাঠানো হবে এবং তার আলোকেই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
পাখি রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পাখি সংরক্ষণের জন্য আমাদের ক্রাইম কন্ট্রোল ইউনিট কাজ করে। কেউ বন্য প্রাণী শিকার করলে তার আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এ ছাড়া প্রতি বছরের ২০ মার্চ আন্তর্জাতিক পাখি দিবস পালন করা নেচার ফরএভার সোসাইটির একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। সারা বিশ্বেই চড়ুই পাখি এবং মানুষের কাছাকাছি বসবাস করা অন্যান্য পাখির সংরক্ষণ নিয়ে সচেতনতার জন্য এ দিনটি পালিত হয়।
মন্তব্য করুন