বাংলাদেশে বসবাসকারী উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীকে নিয়ে পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিনের দেওয়া বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে ৩০ জন বিশিষ্ট নাগরিক বিবৃতি দিয়েছেন। শনিবার (৩ মে) গণামাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ কথা জানা গেছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান সৃষ্টির আগে ও পরে উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীর পূর্বসূরীরা ভারতের উত্তর প্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ইত্যাদি রাজ্য থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জেলায় বসতি স্থাপন করেন। সেই সময় তারা পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসী হিসেবে মর্যাদার সঙ্গেই বসবাস করতেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে থেকেই তাদের কয়েকটি প্রজন্ম এ ভূখণ্ডে স্থায়ীভাবে বসবাস করে আসছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে আন্তর্জাতিক কমিটি ফর রেড ক্রসের (আইসিআরসি) সহায়তায় এ জনগোষ্ঠীকে দেশের বিভিন্ন জেলার ১১৬টি ক্যাম্পে বসবাসের সুযোগ করে দেওয়া হয়। ২০০১ সালের ৩৮৩১ নম্বর এবং ২০০৭ সালের ১০১২৯ নম্বর রিট পিটিশনের যুগান্তকারী রায়ে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ বাংলাদেশের উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীর নাগরিকত্বের প্রশ্নের মীমাংসা করেন এবং এই জনগোষ্ঠীর সদস্যদের জাতীয় পরিচয়পত্র দিতে ও ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করতে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ করেন। ওই রায়ের আলোকে বাংলাদেশের উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীর সদস্যদের নাম যথাযথভাবে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া হয়।
ভোটার তালিকা আইন, ২০০৯-এর ৭ ধারা এবং জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০১০ এর ৫ ধারা অনুযায়ী, কেবল বাংলাদেশি নাগরিকরাই ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার এবং জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়ার যোগ্য। সুতরাং, দেশের উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীর সদস্যদের নাগরিকত্বের প্রশ্ন দ্ব্যর্থহীনভাবে মীমাংসিত। কিন্তু গত ১৭ এপ্রিল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে অনুষ্ঠিত এক দ্বিপক্ষীয় পরামর্শ সভায় (এফওসি) বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্বকারী পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিন পাকিস্তান সরকারের প্রতিনিধিকে বাংলাদেশে ‘আটকে পড়া পাকিস্তানিদের’ প্রত্যাবাসন শুরু করার জন্য অনুরোধ জানান।
একই দিনে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, সচিব বলেন, ‘যারা বাংলাদেশে থাকতে চেয়েছিলেন, তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছে। কেউ কেউ পাকিস্তানে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। এখন পর্যন্ত ২৬ হাজার ৯৪১ জন ‘আটকে পড়া পাকিস্তানিকে’ পাকিস্তানে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। আমাদের তথ্য অনুসারে, ১৪টি জেলার ৭৯টি ক্যাম্পে আরও প্রায় ৩ লাখ ২৪ হাজার ১৪৭ জন ব্যক্তি রয়েছেন।’
এ বক্তব্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের সমগ্র উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীকে ‘আটকে পড়া পাকিস্তানি’ হিসেবে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এমনকি ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ-পাকিস্তান-ভারতের মধ্যে স্বাক্ষরিত ত্রিপক্ষীয় চুক্তির আলোকেও বাংলাদেশের বর্তমান উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীকে ‘আটকে পড়া পাকিস্তানি’ বলার সুযোগ নেই। বাংলাদেশের উর্দুভাষী জনগোষ্ঠী এবং তাদের পূর্বপুরুষরা পাকিস্তান থেকে অভিবাসিত হননি; তারা দীর্ঘকাল এই ভূমির বাসিন্দা এবং জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক। শুধু মাতৃভাষার ভিত্তিতে তাদের ‘আটকে পড়া পাকিস্তানি’ হিসেবে উল্লেখ করে দেওয়া বক্তব্য এক প্রকার ঘৃণামূলক ও মানহানিকর এবং তাদের মৌলিক মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
নাগরিক সমাজের দেওয়া বিবৃতিতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত নাগরিক উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীকে ‘আটকে পড়া পাকিস্তানি’ হিসেবে উল্লেখ করা কেবল ভুল নয় বরং ন্যায়বিচারের নীতিরও লঙ্ঘন। অধিকন্তু তা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান প্রতিশ্রুত মৌলিক অধিকার, বিশেষত অনুচ্ছেদ ২৭-এর অধীন আইনের দৃষ্টিতে সমতা; অনুচ্ছেদ ২৮-এর অধীন ধর্ম, জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ বা জন্মস্থানের ভিত্তিতে বৈষম্য না করা; এবং অনুচ্ছেদ ৩১-এর অধীন আইনের সুরক্ষা পাওয়ার অধিকারের লঙ্ঘন। ওই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ২৩ এপ্রিল উর্দুভাষী কমিউনিটির পক্ষে পররাষ্ট্র সচিব বরাবর ব্যাখ্যা চেয়ে একটি লিগ্যাল নোটিশ পাঠানো হয়েছে। কিন্তু ওই নোটিশের প্রেক্ষিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এখনো কোনো উত্তর পাঠানো হয়নি।
নাগরিক সমাজের দাবি, পররাষ্ট্র সচিব তথা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই বিবৃতি থেকে ‘আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবাসনের দাবি’ অবিলম্বে প্রত্যাহার করা হোক এবং ভবিষ্যতে বাংলাদেশের উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীকে ‘আটকে পড়া পাকিস্তানি’ শব্দবন্ধে অভিহিত করা বন্ধ করা হোক।
মন্তব্য করুন