প্রাকৃতিক দুর্যোগে ধসে পড়া যোগাযোগ ব্যবস্থাই হয়ে দাঁড়ায় সবচেয়ে বড় বাধা। সেই বাধা পেরিয়ে অসংখ্য জীবন বাঁচাতে এক যুগান্তকারী প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বিজ্ঞানী ড. এ এফ এম শাহেন শাহ। তুরস্কের ইলদিজ টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক ও ‘এআই অ্যান্ড নেক্সট জেনারেশন ওয়্যারলেস কমিউনিকেশন ল্যাব’-এর পরিচালক হিসেবে তিনি তৈরি করেছেন মাল্টি-ড্রোনভিত্তিক এক ভ্রাম্যমাণ নেটওয়ার্ক, যা ভূমিকম্প, বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের সময়েও মোবাইল সংযোগ চালু রাখতে সক্ষম।
২০২৩ সালের কাহরামানমারাস ভূমিকম্পের অভিজ্ঞতা থেকেই এ প্রযুক্তির জন্ম। ড. শাহেন শাহ বলেন, দুর্যোগে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় তুরস্কে হাজারো প্রাণ ঝরে যায়। বাংলাদেশেও একই অবস্থা দেখেছি। তখনই ভাবলাম, প্রযুক্তিকে মানবিক প্রয়োজনে কাজে লাগাতে হবে।
আকাশে ভাসমান মোবাইল টাওয়ার
এই প্রযুক্তির মূল আকর্ষণ হলো—আকাশে উড়তে থাকা ড্রোনগুলো মোবাইল বেস স্টেশনের মতো কাজ করে। নিচে সব মোবাইল টাওয়ার অচল হলেও, এই বুদ্ধিমান ড্রোন নেটওয়ার্ক আকাশ থেকে সংযোগ দেয় মোবাইল ফোনে। ফলে দুর্গত মানুষ তাদের অবস্থান জানাতে পারে, সাহায্যের জন্য আবেদন পাঠাতে পারে।
শুধু তাই নয়, এই ড্রোন সিস্টেমে রয়েছে ফাইভ-জি ও পরবর্তী প্রজন্মের প্রযুক্তির সমন্বয়। ড্রোনগুলো নিজে নিজেই স্থান পরিবর্তন করে নেটওয়ার্ক কাভারেজ নিশ্চিত করতে সক্ষম। এটি এক ধরনের স্বচালিত ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও আগ্রহ
ড. শাহেন শাহের এই গবেষণা ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী ‘ড্রোনস জার্নাল’-এ প্রকাশিত হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংস্থাগুলো থেকে শুরু করে জাতিসংঘের কিছু সংস্থাও এই প্রযুক্তিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
তিনি বলেন, এটি এখন আর পরীক্ষাগারে সীমাবদ্ধ নয়—বাস্তবায়নের দ্বোরগোড়ায়।
বাংলাদেশেই প্রথম প্রয়োগের আশা
বাংলাদেশে প্রতি বছরই বন্যা, ঘূর্ণিঝড়সহ নানা দুর্যোগ দেখা দেয়। এই প্রযুক্তি যদি বাস্তবায়ন করা যায়, বহু প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হবে, বলেন ড. শাহেন শাহ। তিনি চান বাংলাদেশ সরকার, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এবং প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো যেন এ উদ্যোগে এগিয়ে আসে।
মানবিক প্রযুক্তির পক্ষে এক বিজ্ঞানীর অবস্থান
একাধারে শিক্ষক, গবেষক ও উদ্ভাবক এই বিজ্ঞানী বলেন, প্রযুক্তি শুধু বাণিজ্যিক বা সামরিক প্রয়োজনে নয়, মানবিক প্রয়োজনে ব্যবহৃত হলে তার সত্যিকারের মূল্যবোধ প্রকাশ পায়। তার নেতৃত্বাধীন গবেষণাগারে কাজ করছে আন্তর্জাতিক টিম—বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের গবেষক ও শিক্ষার্থীরা মিলেই এগিয়ে নিচ্ছে এই মানবিক উদ্যোগ।
স্বীকৃতি ও স্বপ্ন
ড. শাহেন শাহ ২০২১ সালে আইটেক্স-এ আন্তর্জাতিক স্বর্ণপদক অর্জন করেন। পাশাপাশি তিনি রয়েছেন বিশ্বের শীর্ষ ২ শতাংশ গবেষকের তালিকায়। আইইইই-এর সিনিয়র সদস্য ও বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের আজীবন সদস্য হিসেবেও তিনি সুপরিচিত। তুরস্কে কর্মরত হলেও তার মন পড়ে থাকে বাংলাদেশের জন্য।
তিনি বলেন, আমি চাই আমার গবেষণা দেশের মানুষের কল্যাণে ব্যবহৃত হোক। বাংলাদেশ আমার শিকড়, আমার পরিচয়।
একজন বাংলাদেশিই দিয়েছে নতুন আলো
দুর্যোগ যেন মৃত্যুর সমার্থক না হয়—এই ভাবনা থেকেই ড. শাহেন শাহের গবেষণা। তার ড্রোন প্রযুক্তি শুধু উদ্ধার নয়, ফিরিয়ে দিতে পারে জীবনের স্বপ্ন, আশ্রয় ও আশ্বাস। একদিন হয়তো এই ড্রোন উড়বে বাংলাদেশের দুর্যোগকবলিত আকাশে, আর তখন আমরা গর্ব করে বলব— ‘একজন বাংলাদেশিই দিয়েছে নতুন আলো।’
মন্তব্য করুন