গাইবান্ধা-১ আসন থেকে নির্বাচিত জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য। জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও অতিরিক্ত মহাসচিব। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি সম্পন্ন করার পর একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিজি সার্টিফিকেট অন ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি ল ডিগ্রি নেন। সিটি ইউনিভার্সিটির ইনস অব কোর্ট স্কুল অব ল (আইসিএসএল) থেকে বিভিসি (পিজি ডিপ্লোমা ইন প্রফেশনাল অ্যান্ড লিগ্যাল স্কিলস) করেছেন। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেন তরুণ এই সংসদ সদস্য। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এম মুসা।
কালবেলা : গত দুই জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, এবারের নির্বাচনেও একই পরিস্থিতি তৈরি হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন কী?
শামীম হায়দার পাটোয়ারী : বাংলাদেশে কখনো একটি নির্বাচনের প্রেক্ষাপট আরেকটি নির্বাচনের মতো হতে পারে না। ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির একটি অংশ নির্বাচন বর্জন করেছিল। তবে জাতীয় পার্টির বড় একটি অংশ নির্বাচনে ছিল। সেটার প্রেক্ষাপট ছিল এক রকম। ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রেক্ষাপট ছিল আরেক রকম। সেখানে সব দল অংশগ্রহণ করেছে। সেই নির্বাচন আরও ভালো হতে পারত, বিএনপি আরও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হতে পারত, নির্বাচন কমিশনসহ সরকারি স্টেকহোল্ডাররা আরও নিরপেক্ষ থাকতে পারতেন। কিন্তু হয়নি বা থাকেননি। সামনের নির্বাচনে সব দল অংশগ্রহণ করলে অবশ্যই ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন থেকে ভালো নির্বাচন হতে হবে। তবে ভোটে যদি একটা বড় দল অংশগ্রহণ না করে, তাহলে শুধু নির্বাচন কমিশন একা সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবে না। বিএনপিসহ সব দল অংশ নিলে সেটা একটা ভালো নির্বাচন হতে পারে। বিএনপিসহ অন্যান্য দল ভোটে অংশ না নিলে নির্বাচন শুরু হওয়ার আগে হোঁচট খাবে। এ জন্য বিএনপির সঙ্গে সরকারের কথা বলা উচিত, কিছু দাবি মেনে নেওয়া উচিত। বিএনপি যদি অযৌক্তিক কারণে ভোট বর্জন করে, তাহলে সেটার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দায় তাদেরই নিতে হবে। যৌক্তিক কারণে ভোট বর্জন করলে সেটার দায় সরকারকেই নিতে হবে। দেশের স্বার্থে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রয়োজন। এর জন্য দরকার একটু সুষ্ঠু পরিবেশ।
কালবেলা : বিএনপি বলছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া তারা নির্বাচনে যাবে না। আর আওয়ামী লীগ বলছে, তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় ফিরে যাবে না। এ ব্যাপারে আপনাদের অবস্থান কী?
শামীম হায়দার পাটোয়ারী : ২০১৮ সালে বিএনপি যে প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে নির্বাচনে গিয়েছিল, ভোটের দিন তারা দেখে সেটা কার্যকর না। অনেক কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ শতভাগ ভোট পেয়েছে। অন্যদিকে বিএনপি কোনো কোনো কেন্দ্রে একটিও ভোট পায়নি। এত কম ভোট পাওয়ার দল বিএনপি না। বিএনপির উচিত ছিল ভোটের আগের দিন রাত থেকে কেন্দ্র পাহারা দেওয়া। আমরা নির্বাচন করলে রাতে কেন্দ্র পাহারা দিই। যদি সেখানে কোনো অনিয়ম পাওয়া যায়, তাহলে দ্রুত কিছু ব্যবস্থা নিই, যেমন—ঝগড়া করি, ভিডিও করি, গণমাধ্যমের সহায়তা নিই। বিএনপি সেটা করেনি। বিএনপি কখনোই সংসদ নির্বাচনে ছয়টি আসন পাওয়ার মতো দল না। বিএনপি সর্বশক্তি নিয়ে নির্বাচন করলে আরও অনেক আসন পেত। সরকারও এখানে বিএনপিকে অসহযোগিতা করেছে। আবার বিএনপিও পূর্ণশক্তি নিয়ে নির্বাচন করেনি। তারা কেন পূর্ণশক্তি নিয়ে ২০১৮ সালের নির্বাচন করেনি, সেটা একটা গবেষণার বিষয়। যখন আপনি ভোটের মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না, তখন সেখানে অনিয়ম হবে, সিল মারামারি হবে, জাল ভোট হবে, কেন্দ্র লুট হবে, রাতের ভোট হবে। প্রশ্ন হলো, এর জন্য বিএনপি কেন প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেয়নি। যেসব অভিযোগ উঠেছে, সেগুলো যদি সত্যি হয়ে থাকে, তবে এমন অভিযোগের ভোট আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারাও হয়তো চাননি। তবে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে না পারার দায় আওয়ামী লীগকেই নিতে হবে।
কালবেলা : ২০১৮ সালে আপনারা নির্বাচনে গিয়েছিলেন। এবার যে পরিস্থিতি হোক না কেন, নির্বাচনে যাবেন কী?
শামীম হায়দার পাটোয়ারী : ব্যাংক লুট, মানি লন্ডারিং, উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং দুর্নীতির জন্য আমরা তীব্রভাবে সরকারের সমালোচনা করছি। সরকার অনেক বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যার অনেকটি ছিল অপ্রয়োজনীয়। অকারণে প্রকল্প ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। এই অর্থ থাকলে আজ বাংলাদেশ যে কোনো সংকট মোকাবিলা করতে পারত। বিএনপির সঙ্গে আমাদের দুটো জায়গায় পার্থক্য আছে। একটা হচ্ছে বিএনপি এখন পর্যন্ত নির্বাচন বর্জন করে গেছে। আমরা এখন পর্যন্ত নির্বাচনের পথেই হাঁটছি, নির্বাচন বর্জনের কথা বলিনি। আমরা সিটি করপোরেশন নির্বাচনসহ সব নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছি; কিছু কিছু ভালো ফল পেয়েছি। সেদিক থেকে আমরা ভোটের রাস্তায় আছি, জাতীয় পার্টি নির্বাচন করতে চায়। তবে পুরো বিষয়টি নির্ভর করবে নির্বাচন কমিশন কতটুকু সক্ষমতা দেখাতে পারে তার ওপর। বর্তমান নির্বাচন কমিশন কিছু উদাহরণ তৈরি করেছে সত্য; যেমন—গাজীপুর ও রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন, গাইবান্ধা উপনির্বাচন। তাদের সরকার সহযোগিতা করলে নির্বাচনে সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব বলে আমার ধারণা। এখানেও সরকারের ওপর সবকিছু নির্ভর করছে।
কালবেলা : নির্বাচন কমিশন নাসিক ও গাইবান্ধা নির্বাচন সঠিকভাবে করলেও জাতীয় নির্বাচন কি সঠিকভাবে করতে পারবে?
শামীম হায়দার পাটোয়ারী : নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে না করলে পরবর্তী সরকার অনেক বেশি প্রশ্নের সম্মুখীন হবে। ২০১৮ সালের আগে কাউকে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দেয়নি। পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কোনো কারণে বিতর্কিত হলে সরকারের ওপর চাপ বাড়বে, দেশ চালানো কঠিন হবে। তাই সরকারকে অবশ্যই সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। বাকিটা প্রার্থীরা মিলে করতে হবে। ইভিএম নিয়ে একটা বড় শঙ্কা ছিল, সেটা সরকার বাদ দিয়েছে। পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পুলিশ নিরপেক্ষ থাকলে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে। সেটার প্রস্তুতি এখন থেকেই নিতে হবে। সে জন্য কিছু প্রস্তাব থাকতে পারে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে নির্বাচনকালীন পুলিশ প্রশাসনের নিরপেক্ষতা এখন থেকেই যাচাই-বাছাই করতে হবে। তার অতীত দেখতে হবে। অতীতের কোনো নির্বাচনে কেউ কোনো পক্ষ নিয়ে থাকলে তারা যেন দায়িত্বে না থাকেন। জেলা ও উপজেলায় যেসব নির্বাচনী কর্মকর্তা থাকবেন, তাদের যাচাই-বাছাই করতে হবে, রিটার্নিং কর্মকর্তাদেরও এর আওতায় আনতে হবে। নির্বাচন কমিশনের একটি নিজস্ব বাহিনী থাকতে পারে— তারা একটি ইলেকশন স্ট্রাইকিং ফোর্স গঠন করতে পারে। বিভিন্ন জেলায় যারা দায়িত্বে থাকবেন, তারা নির্বাচন কমিশনের অধীনে চলবে। এসব প্রস্তাবের মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এখনই আলোচনা করা প্রয়োজন।
কালবেলা : ২০১৮ সালে জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করেছে। এবারও কি তাই করবে?
শামীম হায়দার পাটোয়ারী : ২০১৮ সালে আমাদের জোট হয়েছিল, কিন্তু দুটি আসন ছাড়া সব আসনে লাঙ্গল মার্কা নিয়ে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা নির্বাচন করেছেন। ২০১৪ সালেও একই ছিল। অন্যান্য বামপন্থি দল তাদের মার্কা বিসর্জন দিয়ে নৌকা মার্কা নিয়ে নির্বাচন করেছে। জাতীয় পার্টি এখনো নৌকা মার্কা নিয়ে নির্বাচন করেনি এবং সরকারের সমালোচনা করে স্বতন্ত্র অবস্থান বজায় রেখেছে। দেশ দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে—একটি নির্বাচন বর্জনকারী, অন্যটি নির্বাচন অংশগ্রহণকারী। ৩০০ আসনেই যদি নৌকা থাকে, তাহলে সেখানে নৌকা জিতবে বা জেতানো হবে। আওয়ামী লীগের এখন দেখানো দরকার যে নির্বাচন নিরপেক্ষ হয়েছে, বিরোধী দলের যথেষ্ট সংখ্যক এমপি পাস করেছে এবং নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়েছে। সেটার জন্য সবার ক্ষেত্রে একটা সহজ সমাধান হতে পারে যে আওয়ামী লীগ ১০০-১৫০টি আসনে নৌকা মার্কা রাখবে না। এ আসনগুলোতে স্বতন্ত্র, জাতীয় পার্টি, বিএনপি অথবা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী ভোটে পাস করে আসবে। আওয়ামী লীগের ৩০০ আসনে প্রার্থী থাকলে একটা আশঙ্কা থাকে। প্রশাসন, আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মীরা অতি উৎসাহী হয়ে কী করবে—সেই আশঙ্কা বিএনপির আছে, আমাদেরও আছে। সবকিছু ঠিক থাকলেও নির্বাচনের দিন কাঠামো ভেঙে পড়তে পারে। ২০১৮ সালে সেটিই হয়েছিল। তাই আগে থেকেই ব্যবস্থা নিতে হবে।
কালবেলা : রাজনৈতিক দলের অধীনে বর্তমান প্রশাসন দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বলে অভিযোগ করছে বিএনপি। আপনার মতামত কী?
শামীম হায়দার পাটোয়ারী : প্রশাসনিক কাঠামো ক্ষমতাসীন সব সরকারই নিজের মতো করে সাজিয়ে রাখে। কিন্তু সেটা নির্বাচনের সময় কাজ করে না। যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসে, তখন রদবদল করা হয়। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কথা বলে পুরো কাঠামোকেই বদল করা হয়। প্রশাসনের সবার নিরপেক্ষতার শপথ নেওয়া আছে। তারা চাকরি করে বলেই হয়তো সরকারের সঙ্গে অ্যালাইনড। কিন্তু তারা যখন দেখবে দেশ নিরপেক্ষতার দিকে যাচ্ছে, তখন তাদের একটা বড় অংশই নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখবে। ইতিহাস তাই বলে। স্বাভাবিক গতিধারার বাইরে গিয়ে প্রশাসন কাউকে সাহায্য করেছে এমনটা অতীত ইতিহাসে দেখা যায় না।
কালবেলা : এখন যদি প্রধানমন্ত্রী থাকেন বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার না থাকে, তাহলে কী হবে?
শামীম হায়দার পাটোয়ারী : প্রধানমন্ত্রী একটি দরজা খুলেছেন যে তিনি নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের চিন্তা করছেন। সেটা কতজনের হবে এবং কারা কারা থাকবেন, তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। আমি মনে করি, সেখানে ৫০ শতাংশের বেশি মন্ত্রীদের বিরোধী দল থেকে থাকা উচিত। তাহলে একটা নিরপেক্ষতা আসবে। আইন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়সহ ৪-৫টি বড় মন্ত্রণালয়বিরোধী দলকে দেওয়া হলে অথবা সংসদের বাইরে কাউকে ১০ শতাংশ দেওয়া হলে একটি নিরপেক্ষ সরকার সৃষ্টি হবে। কোনো ব্যক্তি নিশ্চয়ই চাইবেন না তার সারাজীবনের অর্জন একটি নির্বাচনের মাধ্যমে ভূলুণ্ঠিত করতে। প্রশাসন তাকে সহযোগিতা না করলে তিনি পদত্যাগ করবেন। নির্বাচন কমিশনেরও সে সুযোগ আছে। তারা পদত্যাগ করলে সরকার বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যাবে। তাই সরকারকে তাদের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্নের বিষয়ে সহযোগিতা করতে হবে।
কালবেলা : বাইরের দেশগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে বেশ জোরালো ভূমিকা নিয়েছে। তাদের বিভিন্ন কর্মতৎপরতা দেখা যাচ্ছে। এ বিষয়ে আপনার অভিমত কী?
শামীম হায়দার পাটোয়ারী : তারা সব সময়ই সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলেছে। ২০১২ সালে তারা খুব সক্রিয় ছিল। কিন্তু সে সময় দেশের অর্থনীতি শক্ত ছিল, ২০১৮ সালেও দেশের অর্থনীতি অত্যন্ত শক্ত ছিল। কখনোই কেউ ভাবেনি যে নির্বাচনকে ঘিরে আলাদা বিধিনিষেধ দেওয়া হবে। যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বাংলাদেশের জন্য ভিসা নীতি ঘোষণার পরে দৃশ্যপট বদলে গেছে। আমাদের এই অঞ্চলে ভারত একটা বড় স্টেকহোল্ডার, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পশ্চিমা দেশগুলো ভারতের সঙ্গে আলোচনা করেছে নিশ্চয়ই। একটা কথা প্রচলিত ছিল যে ভারতকে এ অঞ্চলের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। সেখানে কিছু ছন্দপতন ঘটেছে বলে মনে হয়। কিন্তু তার পরও সামনের নির্বাচনে ভারত একটি বড় ভূমিকা পালন করবে। পশ্চিমা দেশগুলো সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চাইবে। তবে আগের মতো একই ধরনের ভোট হলে তারা আরও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। তার মধ্যে একটা হতে পারে আমাদের শান্তিরক্ষী মিশনে আঘাত। আরেকটা হতে পারে আমাদের বিভিন্ন ডোনেশন বন্ধ।
আমাদের জন্য আরও একটি চ্যালেঞ্জ হলো বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হচ্ছে। আমরা বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হব। বিশেষ করে আমাদের ওষুধ শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিদ্যমান সুবিধা প্রত্যাহার করা হলে ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে অধিক অর্থ ব্যয় করতে হবে। এতে ওষুধের দাম বেড়ে যাবে। বাংলাদেশ ২০৩২ সাল পর্যন্ত এ সুবিধা বহাল রাখার চেষ্টা করছে। এখন বাংলাদেশ যদি তাদের গণতন্ত্রের বাণী না শোনে, সুষ্ঠু নির্বাচন না করে তাহলে কেন তারা আমাদের এই সুবিধা দেবে? বাংলাদেশে যে কয়েকজন ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, সেটা আরও কয়েকজনকে দেওয়া হলেও দেশ চালানো সম্ভব। কিন্তু এমন কিছু নিষেধাজ্ঞা আছে, যেটি দেওয়া হলে দেশের অর্থনীতির ক্ষতি হবে, তাহলে দেশ চালানো কঠিন হয়ে পড়বে। তবে আমি সরকারকে ধন্যবাদ জানাতে চাই যে তারা এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনার চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে এমন পরিস্থিতিতে ছয় দেশের রাষ্ট্রদূতদের নিরাপত্তা প্রটোকল সরিয়ে নেওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। আমরা অতিথিপরায়ণ দেশ, বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের অতিরিক্ত প্রটোকল দিলেও তাতে আমাদের রাষ্ট্রের কোনো ক্ষতি হবে না। বরং আরও দেশের রাষ্ট্রদূতকে এই প্রটোকল দেওয়া যেতে পারে। এর মাধ্যমে আমরা আতিথেয়তার সুবাতাস দিতে পারি। কেউ হয়তো সরকারকে উপদেশ দিচ্ছে যে এর মাধ্যমে আমরা একটি প্রতিবাদ (reaction) দেখাতে পারি, যার কোনো প্রয়োজন ছিল না। আমাদের গার্মেন্টস, রেমিট্যান্স, ভিসা-মাস্টারকার্ড ও ব্যাংকিং চ্যানেল সবকিছুতেই তাদের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের মতো একটি উদীয়মান অর্থনৈতিক দেশের অতিসাহসী হওয়ার সুযোগ নেই। এতে জনগণের ক্ষতি হতে পারে। আমরা অতিসাহসী হতে পারতাম, যদি আমাদের অভ্যন্তরীণ ঐকমত্য থাকত।
কালবেলা : বাংলাদেশের মানুষ এখন ডলার সংকট, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, কর্মহীনতাসহ নানা সংকটে রয়েছে। অর্থনীতিও টালমাটাল। এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক সংঘাত দেখা দিলে জনজীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। এটি এড়ানোর কি কোনো ব্যবস্থা নেই?
শামীম হায়দার পাটোয়ারী : সরকারের উচিত দ্রুত বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় বসা। আলোচনাকালীন বিএনপি সংঘর্ষাত্মক কর্মসূচি বন্ধ রাখবে। তাদের কিছু দাবি মানা উচিত। বিএনপিরও দেশের স্বার্থে সরকারের সঙ্গে খোলামনে আলোচনা করা উচিত। ধরে নিন সরকার ব্যর্থ হলো, পশ্চিম দেশগুলো যদি বাংলাদেশকে স্যাকশন দিয়ে আলাদা করে দেয়, তাহলে বিএনপি কোন দেশে রাজনীতি করবে, দেশের অর্থনীতি কোথায় চলে যাবে। ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে বাংলাদেশের রিজার্ভ নেমে গেছে ৩১ বিলিয়ন ডলারে। রিজার্ভ আরও কমে গেলে কোনো রাজনৈতিক দলই সেটি সামাল দিতে পারবে না। এ পরিস্থিতিতে ঐকমত্য তৈরি করে দেশটাকে বাঁচাতে হবে। দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়লে আমরা একটা বড় বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ব। শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের উদাহরণ আমি দেব না। তাদের থেকে আমরা যে খুব বেশি দূরে আছি, বিষয়টা কিন্তু তাও না। চীনের ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু করতে হলে অর্থনীতি চাপে পড়বে। রাজনৈতিক সংঘাতের কারণে আমাদের রপ্তানিকারকরা রপ্তানি করতে না পারলে অর্থ আসবে না। নানা কারণেই আমাদের দেশে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, তখন আরও বাড়বে। কিন্তু মানুষের আয় বাড়ছে না। তখন একটা জটিল পরিস্থিতি তৈরির শঙ্কা রয়েছে। সেটি এড়াতেই আলোচনা করতে হবে।
কালবেলা : শ্রীলঙ্কা-পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশেও অর্থনৈতিক সংকট থেকে রাজনৈতিক সংকট দেখা দেবে কিনা?
শামীম হায়দার পাটোয়ারী : অর্থনৈতিক সংকট সরকার অনেকটা সামাল দিয়েছে। কিন্তু রাজনীতি সামাল দিতে না পারলে বা রাজনীতি অর্থনীতিতে আঘাত করলে রাজনীতি ও অর্থনীতি দুটোই বেসামাল হয়ে পড়বে। বিরোধী দলের আন্দোলনের কারণে গার্মেন্টস পণ্যের গাড়িগুলো যদি ঠিকমতো বন্দরে যেতে না পারে; রপ্তানির চেইনটা যদি নষ্ট হয়ে যায়, ডলার আসতে যদি দেরি হয়, তাহলে দেশ ও অর্থনীতি বিপদে পড়বে। সরকার বিদ্যুৎ খাত ও ব্যাংক খাতকে বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে গেছে। সব মিলিয়ে অর্থনীতি ঝুঁকির মধ্যে আছে। কিন্তু এখনো এ ঝুঁকি থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। তবে এর সঙ্গে যদি রাজনৈতিক ঝুঁকিও যুক্ত হয়, তাহলে এটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
কালবেলা : বাংলাদেশে অর্থনৈতিক সংকট কেন তৈরি হলো?
শামীম হায়দার পাটোয়ারী : জাতীয় সংসদকে গুরুত্ব না দেওয়া বাংলাদেশে সংকট তৈরি হওয়ার একটি বড় বিষয়। সংসদে বিরোধীদলীয় নেতারা যে কথাগুলো বলেছেন, সেগুলো শুনলে অনেক বিপর্যয় সরকার এড়াতে পারত। সরকারের সদিচ্ছা ছিল না, সেটা বলব না; তবে অতি উৎসাহ ছিল, অপেশাদার উৎসাহ ছিল এবং সঠিক অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ ছিল না। সরকার বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে, যার অনেকটির এ মুহূর্তে প্রয়োজন ছিল না। শিল্পকারখানা নির্মাণে ঋণ প্রদানের মতো অর্থ ব্যাংকের কাছে নেই। সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে অথবা যারা টাকা নিয়েছে, তারা ঋণ শোধ না করে বিদেশে পাচার করে দিয়েছে। সরকার যদি নিজের হাতে অর্থ রাখত অথবা মানুষকে চাল-ডালের সাপোর্ট দিত, তাহলে দেশটা আরও ভালো পর্যায়ে থাকত। আমি আবারও বলব, সরকার অর্থনৈতিক সংকট মোটামুটি নিয়ন্ত্রণ করেছে। কিন্তু রাজনীতির সংকট থেকে গেলে সেটা অর্থনৈতিক সংকট নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।
কালবেলা : দেশের টাকা কেন বাইরে পাচার হচ্ছে?
শামীম হায়দার পাটোয়ারী : অসৎ রাজনীতিবিদ, ব্যবসাতন্ত্র ও আমলাতন্ত্র—এ তিনটি ফ্যাক্টর এক হয়ে একটা নব্য ব্যবসাতন্ত্র তৈরি হয়েছে। তারা সংসদে ও সংসদের বাইরে বিভিন্ন বলয় তৈরি করেছে। তারা সেভাবেই রাষ্ট্রকে পরিচালনা করেছে, যেভাবে তাদের অসৎ টাকা আয়ের সুবিধা হবে। এর ফলে মানুষের দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। কারণ এই দায়গুলো মানুষের ও রাষ্ট্রের। অভ্যন্তরীণ ব্যাংক ও বিদেশ থেকে ঋণ নিয়ে বড় বড় প্রজেক্ট করাতে সরকারের আগ্রহ ছিল বেশি। এর মধ্যে কারও কারও দুর্নীতির প্রবণতাও ছিল। সেগুলো চিহ্নিত করা দরকার। খেলাপি ঋণ বেড়েছে। অনেকে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বাইরে পাচার করেছে। এসব রোধে বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো দায়িত্ব নিতে পারেনি, যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ দেওয়া-না দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা পালন করে না। কিন্তু বাণিজ্যিক ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু তারা সেটা করেনি।
যারা অর্থ পাচার করছে বা দুর্নীতি করে অর্থ বানিয়েছে, তারা কি চাইবে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে অন্য সরকার ক্ষমতায় আসুক? অন্য সরকার ক্ষমতায় এলে তাদের দুর্নীতি ফাঁস হয়ে যেতে পারে এবং তাদের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে...
এ রকম একটা মহল থাকে, তারপরও পটপরিবর্তন হয়। কোনো না কোনো সময় দুর্নীতির বিচার হবেই। নিষেধাজ্ঞার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে সে দেশ নিষেধাজ্ঞা দেবে, সেই দেশে দুর্নীতিবাজদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে। দুর্নীতিবাজ এসব ব্যক্তির অনেকেরই যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা বা অন্যান্য দেশে সম্পত্তি রয়েছে। এখন এসব সম্পদ বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে। এমনকি ভিসা-মাস্টারকার্ড বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ওই দেশে তারা প্রবেশও করতে পারবে না। নিষেধাজ্ঞার পর দেশে অর্থ পাচার কমার কথা, কমেছে কিনা আমি জানি না। দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ হঠাৎ করে বাড়তেও পারে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো আগের দফার নিষেধাজ্ঞার পরে গুম-খুন এবং ক্রসফায়ার অনেক কমে গেছে। সরকার চেষ্টা করছে, এটা একটা ভালো দিক।
কালবেলা : জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে, সেখান থেকে উত্তরণে আপনার পরামর্শ কী?
শামীম হায়দার পাটোয়ারী : সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনকে পূর্ণ ক্ষমতা দিতে হবে। প্রিসাইডিং অফিসার কিন্তু সরাসরি নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা না। সেখানে নিরপেক্ষ লোকজন বেছে নিতে হবে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, স্ট্রাইকিং ফোর্স নির্বাচন কমিশনের হাতে না। দেশে এখন ভোটের একটা উদ্দীপনা দরকার। সব দলকে ভোটের দৌড়ে থাকতে হবে। ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগ ভোটে অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিল; কিন্তু যখন এরশাদ সাহেবের নমিনেশন বাতিল হয়ে যায়, তখন সবাই মিলে ভোট বর্জন করে। তাই নির্বাচনের দৌড়ে না থাকলে শুধু অঙ্ক কষে বা নিষেধাজ্ঞায় দেশে অনেক কিছু হয়ে যাবে—ব্যাপারটা এত সরল নয়। এটা অভ্যন্তরীণ সমস্যা, বাইরের দেশকেও এটা বুঝতে হবে। আমরা কতটুকু তাদের সম্মান দেব এবং কতটুকু তাদের কথা শুনব, সেটার একটা সীমা আছে। জনগণকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া বা কাউকে ভিসা না দেওয়া জাতি হিসেবে আমাদের জন্য সম্মানজনক কোনো বিষয় না। আজ এটা ভারতে হলে জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি হয়ে যেত। কিন্তু আমাদের দেশে সেটা হয়নি। সেই ঐকমত্য কেন হয়নি, সেটাও সরকারি দলকে চিন্তা করতে হবে।
আমরা এখন সংকটে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। সমস্যার সমাধান করার জন্য অবশ্যই আমাদের জাতীয় ঐকমত্য লাগবে। অথচ আমাদের মধ্যে ঐক্য নেই। জাতীয় ঐক্য থাকলে এমন সংকট হতো না। ভুলে গেলে চলবে না, ভেনেজুয়েলা একটা সময় পৃথিবীর চতুর্থ বড় অর্থনীতির দেশ ছিল। তাদের মাথাপিছু আয় ছিল বিশ্বের মধ্যে চতুর্থ সর্বোচ্চ। আজকে সেখানে ৯৭ শতাংশ মানুষ দরিদ্র, শুধু যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে।
মন্তব্য করুন