সাভারের দুই যুবদল নেতাসহ তিনজন গুমের শিকার হন ২০২৩ সালে। গুম হওয়ার ৬ দিন পর তাদের ফেরত দেওয়া হয়। পরিবার থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর ডিবি পুলিশ তাদের নাটকীয়ভাবে ঢাকা জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে হাজির করে বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে ঘটে যাওয়া ওই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে দোষীদের বিচারের দাবি জানিয়েছেন। শিগগির তারা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দেবেন বলেও জানিয়েছেন তারা।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ—গুমের পর অজ্ঞাত স্থানে তাদের অমানবিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে, প্রথম তিন দিন কাটাতে হয়েছে রহস্যময় ‘আয়নাঘরে’, যেখানে চোখ ও হাত বেঁধে রাখা হয়েছিল।
গুমের শিকার চারজন হলেন—সাভার থানা যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম, সাভার পৌর ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ও যুবদল নেতা সুরুজ্জামান, কাউন্দিয়া ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মোমিনুল ইসলাম এবং শহীদুল ইসলামের প্রাইভেটকার চালক সুজন আহমেদ।
২০২৩ সালের আগস্ট—দেশজুড়ে তখন ফ্যাসিস্টবিরোধী আন্দোলনের উত্তাপ। বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের অনেক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার এড়াতে ঢাকায় ভাড়া বাসায় অবস্থান করছিলেন। সাভারের শহীদুল ইসলামও ছিলেন তাদের একজন। তার পরিবারের ভাষ্য, ২০২৩ সালের ৫ আগস্ট বিকেলে প্রথমে শহীদুলের গাড়িচালক সুজনকে আটক করে নিয়ে যায় ঢাকা জেলা উত্তর ডিবি পুলিশ। এরপর ১২ দিন কোনো খোঁজ মেলে না। এ ছাড়া একই দিনে আদাবরের ভাড়া বাসা থেকে শহীদুল, সুরুজ্জামান ও মোমিনুল ইসলামকেও তুলে নিয়ে যায় ডিবির একই টিম।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ নিখোঁজের পরদিন থেকেই শুরু হয় মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। ভুক্তভোগী শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের চোখ ও হাত শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছিল। অন্ধকার ছোট ঘরে শুধু ফ্যানের শব্দ শোনা যেত। খাবার হিসেবে পেতাম শুধু পাউরুটি আর কলা। টয়লেটে যেতে হলে হাতে রশি বেঁধে নিয়ে যেত।’ তিনি আরও বলেন, ‘শিগগির আমরা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দাখিল করব।’
মোমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের মনে হয়েছে ওই ঘর ছিল আয়নাঘর—যেখানে প্রায়ই অন্য বন্দিদের চিৎকার শোনা যেত। শেষ তিন দিন ছিলাম এক অজ্ঞাত স্থানে, পরে বুঝতে পেরেছি সেটি ছিল ঢাকা জেলা উত্তর ডিবি কার্যালয়। কথোপকথন ও গাড়ির শব্দে জায়গাটা শনাক্ত করেছিলাম।’
পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, গুমের পরপরই ‘উদ্ধারের কথা বলে’ ভয়ভীতি দেখিয়ে বেশ কয়েক দফায় নগদ অর্থ আদায় করা হয়। শহীদুল ইসলামের স্ত্রী সুরাইয়া হোসেন বলেন, ‘পুলিশ বারবার বলেছে, এমন কোনো মানুষ তারা আটক করেনি। কিন্তু একই সঙ্গে গোপনে লোক পাঠিয়ে কয়েক লাখ টাকা নিয়েছে আমাদের কাছ থেকে। আমরা ভয়ে কিছু বলতে পারিনি।’
এদিকে ঘটনার ছয় দিন পর সংবাদ সম্মেলনে নিখোঁজ চারজনকে ঢাকা জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে উপস্থিত করা হয়। সংবাদ সম্মেলন করে তৎকালীন পুলিশ সুপার জানান, ‘আসামিরা ভয়ংকর নাশকতাকারী। তারা সাভার-আশুলিয়া অঞ্চলে পুলিশের মনোবল ভাঙতে একাধিক নাশকতা করেছে।’
তবে ভুক্তভোগীরা জানান, সংবাদ সম্মেলনে হাজির করার আগে কেরানীগঞ্জের একটি পাম্পে তাদের বহনকারী গাড়ি থামিয়ে তাদের পোশাক পরিবর্তন করানো হয়। শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ আমাদের সাজানো নাটকের চরিত্র বানিয়ে তুলেছিল। এসপির বক্তব্য ছিল মিথ্যা ও বানোয়াট।’
যুবদল নেতা সুরুজ্জামান বলেন, ‘আমাকে এমনভাবে নির্যাতন করা হয়েছিল যে, একাধিকবার জ্ঞান হারাই। পরে প্রাণভয়ে আদালতে মিথ্যা স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য হয়।’
ভুক্তভোগীরা মানসিক ও শারীরিকভাবে বিপর্যস্ত বলে জানান। এ ছাড়া তারা প্রশাসনের কাছে ঘটনার স্বচ্ছ তদন্ত ও দায়ীদের বিচারের দাবি জানিয়েছেন। শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা বেঁচে ফিরেছি ভাগ্যক্রমে; কিন্তু আজও সেই অন্ধকার ঘরের আতঙ্ক ভুলতে পারিনি। দেশের নাগরিক হিসেবে সত্য উদ্ঘাটনের দাবি জানাচ্ছি। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও নাগরিক অধিকার কখনো একে অপরের বিপরীতে দাঁড়াতে পারে না। গুম, নির্যাতন ও ভয়ভীতির সংস্কৃতি একটি গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। এই ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্তের মাধ্যমে সত্য উদ্ঘাটন এবং দোষীদের শাস্তিই হতে পারে আইনের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনার একমাত্র পথ।’
মন্তব্য করুন