বাংলার আকাশে মেঘের ভেলা ভাসছিল ১৯২৩ সালের ১০ আগস্টের সেই প্রভাতে, যখন নড়াইলের মাসিমদিয়া গ্রামে জন্ম নিলেন এক বিস্ময়শিশু— শেখ মোহাম্মদ সুলতান। ইতিহাস তাকে চিনল এসএম সুলতান নামে।
কৃষক পরিবারের সন্তান হয়েও তিনি হয়ে উঠেছিলেন ক্যানভাসের জাদুকর, যিনি তুলির আঁচড়ে রচনা করেছেন গ্রামীণ বাংলার মহাকাব্য—যেখানে শ্রম, প্রেম, সংগ্রাম ও সৌন্দর্য মিশে আছে একই স্রোতে।
শৈশবে স্কুলপাঠ তার মন টানেনি, বরং টেনেছিল বাবার সঙ্গে নির্মাণকাজে ব্যস্ত দিনগুলো— যেখানে তিনি শিখেছিলেন রেখা, অনুপাত আর কাঠামোর মেলবন্ধন। সেই বোধ থেকেই জন্ম নেয় তার শিল্পের ভিত্তি। পরে কলকাতার আর্ট স্কুলে পড়াশোনার সুযোগ পেলেও তার প্রকৃত শিক্ষা হয়েছিল মুক্ত আকাশের নিচে— শহর থেকে গ্রাম, পাহাড় থেকে সমতল ভ্রমণে, মানুষের মুখ আর মাটির গন্ধে। তিন বছরের মধ্যেই স্কুল ছেড়ে তিনি যাত্রা শুরু করেন নিজের শিল্প-তীর্থে।
সুলতানের শিল্প ছিল বাস্তবতার মূর্ত প্রতীক কিন্তু সেই বাস্তবতার ভেতরে লুকিয়ে ছিল দর্শনের গহ্বর। তার ছবিতে গ্রামীণ কৃষক-শ্রমিকদের দেহ বিশাল ও বলিষ্ঠ— চওড়া কাঁধ, দৃঢ় বাহু, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। এই অতিমানবীয় অবয়ব ছিল তার দৃষ্টিভঙ্গির প্রতীক। তিনি বিশ্বাস করতেন সভ্যতার প্রাণশক্তি শহরে নয়, গ্রামে; আর তার চালিকাশক্তি সেই কৃষক, যে ঘাম ঝরিয়ে জীবন সৃষ্টি করে। তার ‘পল্লি জীবন’ সিরিজ, ‘হার্ভেস্টিং’, ‘প্লাউইং’, কিংবা ‘ফার্মারস’— প্রতিটি ক্যানভাসে ফুটে উঠেছে গাঢ় সবুজের সমারোহ, সোনালি ধানের ঢেউ, আর কৃষকের হাসি।
তার শিল্পে রঙ কেবল দৃশ্যত নয়। সেখানে রঙ হয়ে উঠেছে ভাষা, আর ক্যানভাস হয়ে উঠেছে ইতিহাসের খতিয়ান। তিনি যেন মাটির গন্ধকে রঙে রূপান্তর করতেন, নদীর স্রোতকে তুলিতে বেঁধে রাখতেন। তার আঁকা কৃষকের হাতের রেখা যেন যুগের পর যুগের শ্রমের ছাপ বহন করে। এভাবেই তিনি শিল্পকে পরিণত করেছিলেন এক সামাজিক ও দার্শনিক উচ্চারণে।
সুলতানের জীবন ছিল সহজ-সরল, কিন্তু সংগ্রামী। আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে পিকাসো, দালি, পল ক্লির মতো বিশ্ববরেণ্য শিল্পীদের সঙ্গে তার কাজ স্থান পেয়েছিল; নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, শিকাগো, লন্ডন, করাচি— সবখানেই তার ক্যানভাস আলোড়ন তুলেছিল। তবুও তিনি খ্যাতির মোহে আটকে থাকেননি— ফিরে এসেছিলেন নড়াইলে, যেখানে গ্রামের মানুষ আর শিশুদের সঙ্গে কাটিয়েছেন জীবনের শেষদিনগুলো।
শিশুদের প্রতি তার ভালোবাসা ছিল অগাধ। তিনি বিশ্বাস করতেন, শিশুর হাতেই লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতের শিল্প ও সভ্যতা। এই বিশ্বাস থেকেই তিনি গড়ে তোলেন ‘শিশুস্বর্গ’ ও ‘চারুপীঠ’— যেখানে বইয়ের পাশাপাশি শিশুদের হাতে তুলে দিতেন রংতুলি, বাঁশি, খেলার মাঠ। তার কাছে শিক্ষা ছিল আনন্দের উৎসব, যেখানে শিশুমন মেলে ধরতে পারে সৃষ্টির আনন্দ।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও এসেছে তার দরজায়— ১৯৮২ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ঘোষণা করে ‘ম্যান অফ এশিয়া’। একই বছরে তিনি পান একুশে পদক, ১৯৮৬ সালে বাংলা চারুশিল্পী সংসদ পুরস্কার এবং ১৯৯৩ সালে স্বাধীনতা পদক। তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীর অতিথি, বিচারক আর বাংলাদেশের চারুকলার অন্যতম রত্ন। তরিকুল মাসুদের ডকুমেন্টারি আদম সরূপ (১৯৮৯) তাকে তুলে ধরে এক কৃষকপ্রাণ শিল্পী হিসেবে— যিনি শুধু আঁকেন না, বরং মানুষের আত্মাকে ক্যানভাসে বন্দি করেন।
১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর সুলতান বিদায় নিলেন এই পৃথিবী থেকে। কিন্তু তার আঁকা কৃষকের চোখ, সোনালি ফসলের ঢেউ আর নদীমাতৃক বাংলার সবুজে ভরা দৃশ্য আজও আমাদের মনে করিয়ে দেয়— আমাদের শিকড় মাটিতে, আমাদের মহিমা শ্রমে, আর আমাদের শিল্প সেই শিকড় ও শ্রমের জয়গান।
আজ তার জন্মদিনে আমরা তাকে স্মরণ করি এক অনন্ত কবি হিসেবে— যিনি তুলির ভাষায় লিখেছিলেন বাংলার মানুষের মহাকাব্য, যিনি প্রমাণ করেছিলেন শিল্প মানে কেবল সৌন্দর্যের অন্বেষণ নয় বরং মানবতার গভীরতম স্বরলিপি।
(লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়)
মন্তব্য করুন