নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, সরকারের জটিল সমস্যাগুলো জনসাধারণের কাছে ব্যাখ্যা করা খুবই কঠিন। এমনকি সরকার যখন ভালো করে তখনও তারা জনসাধারণের কাছে তাদের নীতি-পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করতে চান না। কিন্তু যতক্ষণ সরকারের ওপর জনগণের আস্থা থাকবে, ততক্ষণ সাধারণ নাগরিক বলবে, ‘সরকার কী করতে চাইছে তা আমি ভালোভাবেই জানি, তাই আমার কাছে সরকারের সবকিছু ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই।’
বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের আগে অনেক উন্নত অর্থনীতির দেশে এমনটাই ছিল- তখন অর্থনৈতিক নীতির দিকনির্দেশনা নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে ঐকমত্য ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন নিয়ন্ত্রণহীন, উন্মুক্ত নীতি এবং বাণিজ্য সম্প্রসারণের ওপর বেশি জোর দিয়েছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন তখন বাজার সংহতকরণ নিয়েই উদ্বিগ্ন ছিল। সাধারণভাবে সেখানে উদারপন্থি গোঁড়ামিই প্রাধান্য পেয়েছে।
বিশ্বব্যাপী আর্থিক সংকট প্রচলিত সে ঐকমত্য এবং জনগণের আস্থা উভয়কেই ভেঙে দিয়েছে। সে উদারপন্থি গোঁড়ামির নীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সবার জন্য ভালো ফল বয়ে আনেনি। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিযোগিতায় চীনের কাছে আমেরিকার মধ্যবিত্ত উৎপাদন কর্মীরা ব্যাপকভাবে ধাক্কা খেয়েছেন।
অভিযোগ করা হয়েছে, নীতিনির্ধারক অভিজাতরা বাজারকে একেবারে নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে দিয়েছে। কিন্তু তাদের বন্ধু এবং পরিবারবর্গ সুরক্ষিত অর্থনৈতিক পরিষেবাতে চাকরি করছে। চীন থেকে সস্তায় আমদানি করা পণ্য থেকে তারা ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমেরিকার স্থানীয় মধ্যম সারির উদ্যোক্তারা। সুতরাং বাণিজ্য নীতি তৈরিতে নীতিনির্ধারকদের আর বিশ্বাস করা যায় না।
সমগ্র ইউরোপীয় ইউনিয়নজুড়ে একটি একক বাজার হওয়ায় তাদের মধ্যে পণ্য, পুঁজি, পরিষেবা এবং জনগণের অবাধ চলাচল সুবিধার ফলে অন্য যে কারও চেয়ে বেশি সুবিধা পেয়েছে ব্রাসেলসে ইইউ-এর অনির্বাচিত আমলারা।
বাজার একেবারে উন্মুক্ত করে দেওয়ার সেই গোঁড়ামি নীতি অকার্যকর হওয়ার পর এর প্রবক্তারা জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। জনপ্রিয় বিশ্বাসের দরজা ব্যর্থ হয়েছে। নীতিনির্ধারকদের বিশ্বাস করে তাদের ওপর সবকিছু ছেড়ে দেওয়ার ফলাফল ভালো হয়নি। এই বিশ্বাসের মধ্যেই নিহিত রয়েছে ভ্রান্ত জনপ্রিয় নীতির শিকড়।
যদি সরকারকে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হয়, তাহলে শ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য বাজারের ওপর শুল্ক আরোপ করা হবে না কেন? যদি সরকারকে খরচ করতে হয়, তাহলে কেন টাকা ছাপানো হবে না? উদার অর্থনীতির দেশগুলো যদি তাদের উৎপাদনকে পুনরুজ্জীবিত করতে চায়, তাহলে কেন চীনের ওপর নির্ভর করাকে বিপদ হিসেবে দেখা হবে না? কেন স্থানীয় শিল্প এবং সংস্থাগুলোকে বাঁচাতে ভর্তুকি এবং অন্যান্য প্রণোদনা দেওয়া হবে না? যদি আর্থিক ব্যবস্থাকে আরও নিরাপদ করতে হয়, তাহলে কেন ব্যাংকগুলোতে মূলধনের প্রয়োজনীয়তা বাড়ানো হবে না?
জনসাধারণের চোখে মুক্তবাজার নীতি ব্যর্থ হয়েছে এবং এই নীতির দুর্বলতাগুলো মানুষের সামনে আবার আবির্ভূত হয়েছে। কিন্তু অতীতে যতই অযৌক্তিক বা ব্যর্থ হোক না কেন, একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ পপুলিস্ট নীতির প্রয়োজনীয়তা স্পষ্টতই সত্য বলে মনে হয়।
যেমন : বিখ্যাত আমেরিকান প্রাবন্ধিক এইচ এল মেনকেন বলেছিলেন, ‘প্রতিটি জটিল সমস্যার জন্য একটি উত্তর আছে যা খুবই পরিষ্কার, সহজ এবং ভুল।’
সর্বোপরি, আমদানি শুল্ক অন্তত কিছু অভ্যন্তরীণ চাকরির ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। যদিও ইস্পাত শিল্পে নতুন শুল্ক আরোপ করলে অভ্যন্তরীণভাবে গাড়ি তৈরির খরচ বাড়বে, যা সেই শিল্পে সম্ভাব্য চাকরির ক্ষেত্রকে ক্ষতির দিকে পরিচালিত করতে পারে। এর জন্য একটি অতিরিক্ত পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন যা সম্ভাব্য ক্ষতিকে তুলে ধরবে।
একইভাবে, চীনকে সরিয়ে একটি বন্ধুপ্রতীম দেশের সঙ্গে সরবরাহ চুক্তি করলে তা সেই চেইনকে আরও স্থিতিস্থাপক করে তুলবে। এটি চীন-মার্কিন দ্বন্দ্বকে উসকে দিতে পারে।
আবার এটি নিরাপত্তার একটি মিথ্যা ধারণাও তৈরি করতে পারে। কারণ পশ্চিমের যেসব বন্ধুদেশের সঙ্গে তারা সরবরাহ চুক্তি করবে তারা অনেকেই আবার কাঁচামাল বা মূল ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশের জন্য চীনের ওপর নির্ভরশীল।
বিংশ শতাব্দীর উদারপন্থি ফরাসি সাংবাদিক ফ্রেডেরিক বাস্তিয়াতের মতে, একজন খারাপ অর্থনীতিবিদ এবং একজন ভালো অর্থনীতিবিদের মধ্যে একটিই পার্থক্য রয়েছে। তাহলো, খারাপ অর্থনীতিবিদ নিজেকে দৃশ্যমান প্রভাবের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেন। পক্ষান্তরে ভালো অর্থনীতিবিদ দৃশ্যমান প্রভাবগুলোর পাশাপাশি সেগুলোর বিবেচনা করেন যেগুলোর পূর্বাভাস দেওয়া উচিত।
কিন্তু নীতিনির্ধারকদের প্রতি যখন মানুষের আস্থা থাকে না, তখন নীতিনির্ধারক এবং অর্থনীতিবিদদের অদেখা সেই দ্বিতীয় দফা প্রভাব সম্পর্কে সতর্কবার্তা মানুষ বিশ্বাস করে না।
ভারত সম্প্রতি কম্পিউটার আমদানি করতে লাইসেন্সের বাধ্যবাধকতা দিয়েছে। ভারত মনে করছে, এটি ভারতের নিজস্ব কম্পিউটার উৎপাদন শিল্পকে সহযোগিতা করবে এবং আংশিকভাবে চীনা আমদানির ওপর নির্ভরতা কমাবে। কিন্তু ভারতের রপ্তানি আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস আইটি পরিষেবা রপ্তানি এবং ভারতীয় ব্যবসার জন্য এই কম্পিউটার আমদানির লাইসেন্সের বাধ্যবাধকতা নেতিবাচক পরিণতি বয়ে আনবে।
বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে হতাশাবাদী না হওয়াই কঠিন। শিল্পন্নোত দেশগুলোতে মুক্তবাজারের গোঁড়ামির প্রতি অত্যধিক বিশ্বাস থেকে তারা পপুলিস্ট নীতি বিশ্বাসের দিকে ঝুঁকেছে। যতক্ষণ না পর্যন্ত তাদের দুর্বলতাগুলো আবারও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ততক্ষণ তারা উদারতাবাদী নীতিতে অন্ধ বিশ্বাস রেখেছে। আমরা যেটা আশা করতে পারি সেটা হলো, আমরা উদারবাদী অর্থনীতিতে যেতে গিয়ে জনপ্রিয়তার ফাঁদে পড়ব না।
রঘুরাম জি রাজন : আমেরিকার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এবং রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার সাবেক গভর্নর
ভাষান্তর : মুজাহিদুল ইসলাম
মন্তব্য করুন