আমাদের পশ্চিমা বন্ধু যারা আছেন, যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, মানবাধিকার এবং বাগস্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন তারা ধারাবাহিকভাবে সরকারকে চাপ দিচ্ছেন—যাতে বাংলাদেশে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন হয়। গুম,খুনসহ মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতির জন্যও তারা বারবার বলে আসছে।
সর্বশেষ ছয়জন কংগ্রেসম্যান স্বাক্ষরিত মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিংকেনকে লেখা চিঠিতে বলা হয়েছে—‘মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাবের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপকে আমরা স্বাগত জানিয়েছিলাম। এ পদক্ষেপ নেওয়া সত্ত্বেও দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশে নিপীড়ন কমেনি। মানবাধিকার সংস্থা অধিকার তাদের ২০২২ সালের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, সে বছর ৩১টি বিচারবহির্ভূত হত্যা, ২১টি বলপূর্বক গুম এবং কারাগারের ৬৮ জনের মৃত্যু ঘটেছে। সাংবাদিকদের ওপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হামলার ঘটনা ঘটেছে ১৮৩টি; এসব হামলায় জড়িত ছিল র্যাব, ডিবি ও ডিজিএফআই। এসব ঘটনার প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন। বরং এসব তথ্য-উপাত্তকে দেশবিরোধী অপপ্রচার বলেও তারা দাবি করেন। এমনকি অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের পুরস্কার ও পদোন্নতিও দেওয়া হচ্ছে।’
সরকার এসব চিঠিকে গুরুত্ব দিচ্ছে না বলে গণমাধ্যমকে জানালেও তারা বিভিন্ন ব্যবস্থা নিচ্ছে। সরকার যদি মনে করে বাংলাদেশ গ্লোবাল ভিলেজ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো দেশ, যেই দেশের নির্বাচন নিয়ে কারও মাথাব্যথ্যা নেই, নির্বাচন কেলেঙ্কারির খবর কেউ জানে না তাহলে সেটি খুব ভুল হবে। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে বাংলাদেশে কী ধরনের কলঙ্কিত নির্বাচন হয়েছে সেটা সারা বিশ্ব জানে। কীভাবে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলায় সাজা দেওয়া হয়েছে, জেল খাটানো হয়েছে, এটাও পুরো বিশ্ব দেখেছে। কীভাবে আমাদের নেতাকর্মীদের একটার পর একটা মিথ্যা মামলা এবং রাজনৈতিক মামলায় গণগ্রেপ্তার করা হয়েছে, সেটাও সারা বিশ্ব জানে। সরকার কিছুদিন আগে পর্যন্তও আমাদের কোথাও সমবেত হতে দেয়নি। ঘরোয়া সমাবেশ করতে পর্যন্ত দেয়নি। এটাও বিশ্ব জানে। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ব্যবহার করে যেভাবে আমাদের মুখ বন্ধ রাখার চেষ্টা করা হয়েছে, নাগরিক সমাজকে অত্যাচার করা হয়েছে, সেটাও সারাবিশ্ব জানে। ঠিক সেভাবে জানে—গুম, বিচার বহির্ভূত হত্যার মতো ভয়ংকর ঘটনাগুলোতে কীভাবে রাষ্ট্রীয় বাহিনী, ডিজিএফআই, ডিবি, জড়িত।
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্ট সদস্যদের চিঠি—সবকিছু একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। সরকার মনে করেছিল হয়তো ২০২১ সালে র্যাবের ওপর একটা স্যাংশন এসেছে তারপরে আর কোনো পদক্ষেপ তারা নেবে না। কিন্তু সরকারের চিন্তাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করে দিয়ে ধারাবাহিকভাবে একটির পর একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে পশ্চিমা বিশ্ব। এটি তাদের সফট ম্যাসেজ বলে আমি মনে করছি। সরকার এরপরও তাদের ও আমাদের ন্যায্য দাবিকে অগ্রাহ্য করে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে যেতে থাকে এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি না মেনে নেয় তবে আরও কঠিন ব্যবস্থা তারা নিতে পারে। আমরা দেখেছি গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশকে দাওয়াত দেওয়া হয়নি। এটি একটি বার্তা, সরকার সেটিও আমলে নেয়নি। এরপর একের পর কংগ্রেসম্যানরা যুক্তরাষ্ট্রের সরকারকে চিঠি দিচ্ছেন এবং বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও রাজনীতির সুষ্ঠু চর্চা নিশ্চিত এবং সুষ্ঠু নির্বাচন ও মানবাধিকার রক্ষায় ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানাচ্ছে। ছয়জন মার্কিন কংগ্রেসম্যান জো-বাইডেনকে চিঠি দিয়েছে, যেটা বাংলাদেশ সরকার চাপা দিয়ে রেখেছিল। প্রথম দিকে তারা একে মিথ্যা বলে উপহাসও করেছে। পরে দেখা গেছে সবগুলো চিঠি সত্য।
আজকে ছয়জন কংগ্রেসম্যান চিঠি দিয়েছেন এন্টনি ব্লিংকেন। এর আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে দেখেছি—সেখানেও ছয়জন পার্লামেন্টেরিয়ান চিঠি লিখেছেন এবং বাংলাদেশের মানবাধিকার ও ভোটের অবস্থা নিয়ে তথ্য প্রকাশ করেছেন। আমরা দেখেছি—হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জাতিসংঘকে বলছে যাতে পিচকিপিং মিশনে বাংলাদেশে র্যাব বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো সদস্যকে যাচাইবাছাই ছাড়া না নেওয়া হয়।
সুতরাং এটা একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার অংশ এবং কেউ যদি মনে করে, লবিস্ট দিয়ে এগুলো করা যায় তাহলে সরকারের হাতে লবিস্ট নিয়োগের শক্তি অনেক বেশি। সরকার যদি মনে করে সবকিছুই লবিষ্ট করে তাহলে তারা পারলে নিজেদের পক্ষে এরকম চিঠি নিয়ে আসুক, বাংলাদেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে, সুষ্ঠু নির্বাচন হচ্ছে বাংলাদেশে।
এই চিঠিগুলো আসার আগে থেকে বলছি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কোনোভাবেই দশম বা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো হতে পারবে না। এটা অসম্ভব। সরকার ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যতদ্রুত পরিস্থিতি অনুধাবন করবে তত ভালো। আন্তর্জাতিক চাপ ও দেশের অভ্যন্তরে জনগণের আন্দোলনই সরকারকে বাধ্য করবে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিতে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলনের মধ্যে আছে। ন্যায্য অধিকার আদায়ে সারা বিশ্বেই নিপীড়িত মানুষের পাশে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তিরা দাঁড়িয়েছে।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও বিদেশি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও কংগ্রেসম্যানরা বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে সরকারকে চিঠি দিয়েছে একাত্মতা প্রকাশ করে। সেটি ছিল আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ। সেটিতে আমরা জয় লাভ করেছি। এবার আমাদের যুদ্ধ মানুষের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার, গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার,রাজনীতিকে সুষ্ঠু ধারায় পরিচালনার, গুম-খুন-হত্যাসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বন্ধ করার। বিদেশিরা আমাদের আন্দোলনে পাশে আছে বলে চিঠি ও বিবৃতি প্রদানের মাধ্যমে সরকারকে সতর্ক করছে।
বাংলাদেশের গণতন্ত্রের পক্ষে যারা কথা বলবে,বিশ্বের যে প্রান্ত থেকে যারাই কথা বলবে, বাংলাদেশের ভোটের অধিকার নিয়ে যারা কথা বলবে, মানবাধিকার নিয়ে যারা কথা বলবে,আমাদের বাগস্বাধীনতা নিয়ে যারা কথা বলবে তাদের সঙ্গে আমাদের একাত্মতা রয়েছে। সরকার বলছে,অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের নাক গলানো ঠিক না। এই নাক গলানোর সুযোগ তো সরকারই করে দিয়েছে।
সরকার মুখে যাই বলুক না কেন তারা ভীত। সরকার ভীত বলেই প্রধানমন্ত্রী বারবার বলছেন আমেরিকা না গেলেও কিছু হবে না। সরকার ভীত বলেই প্রধানমন্ত্রী বলছেন, আমেরিকা থেকে আমরা কিছু কিনব না। সরকার ভীত বলেই প্রধানমন্ত্রী নানাভাবে তার নেতাকর্মীদের সাহস দেওয়ার চেষ্টা করছেন। সরকার ভীষণ ভীত এবং আন্তর্জাতিক চাপের সঙ্গে আমাদের আন্দোলন—দুটো মিলেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন একাদশ বা দশম সংসদ নির্বাচনের মতো হতে পারবে না। জনগণের দাবি অনুযায়ী সুষ্ঠু অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করতে হবে। নতুবা সরকার আরও চাপে পড়বে।
রুমিন ফারহানা : বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য ও হুইপ এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী
মন্তব্য করুন