মুহাম্মদ ফয়জুল ইসলাম
প্রকাশ : ২৬ আগস্ট ২০২৩, ১২:৫৪ পিএম
আপডেট : ২৬ আগস্ট ২০২৩, ০১:১০ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
মুহাম্মদ ফয়জুল ইসলাম

পদ্মা সেতু বাংলাদেশের অর্থনীতিকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে

মুহাম্মদ ফয়জুল ইসলাম। ছবি : সৌজন্য
মুহাম্মদ ফয়জুল ইসলাম। ছবি : সৌজন্য

আট বছর ধরে নির্মাণযজ্ঞ চলার পর অবশেষে ২০২২ সালের ২৫ জুন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা বহুমুখী সেতুর উদ্বোধন করেন। অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে নির্মিত পদ্মা সেতু বিশ্বের ১২২তম বৃহত্তম বহুমুখী সেতু। পদ্মা নদীর ওপর মাথা উঁচু করে স্বগৌরবে দাঁড়িয়ে থাকা সেতুটির একেকটি পিলার পানির নিচে মাটির ১২২ মিটার পর্যন্ত গভীরে প্রসারিত। যা একটি বিশ্ব রেকর্ড। পদ্মা সেতুর ৪২টি পিলারের ওপর রয়েছে ৪১টি স্প্যান। উপরের কংক্রিটের রাস্তাকে ধরে রেখেছে এই স্প্যানগুলো। নদীর কিছু স্থানে জলপ্রবাহের পরিমাণ এতটাই বেশি, যার উপরে রয়েছে শুধু আমাজন নদী।

রাজধানী ঢাকাকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার সঙ্গে সংযুক্ত করে পদ্মা সেতু দেশের অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা অঞ্চলের প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করছে। এই সেতু রাজধানীর সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগের দূরত্ব উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দিয়েছে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, দক্ষিণাঞ্চল থেকে তাজা মাছ এবং অন্যান্য পচনশীল পণ্য এখন মাত্র ৬ ঘণ্টায় ঢাকায় পৌঁছে যাচ্ছে। আগে যে সময় লাগত দ্বিগুণেরও বেশি।

পদ্মা সেতুর অর্থনীতি

১। ৩০ হাজার কোটি টাকার খরচ কি খুবই অস্বাভাবিক?

ধরা যাক, পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় অস্বাভাবিক বেশি। তাহলে কী হতো? ক. বিশ্বব্যাংকের দাবি অনুযায়ী বিশ্বে অবকাঠামো নির্মাণে সবচেয়ে বেশি খরচ হয় বাংলাদেশে। চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেডকে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঠিকাদারি প্রদান করা হয়। যে সময় অন্য সব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওই কাজে অংশগ্রহণ থেকে বিরত ছিল।

খ. ভারতের ৯ কিমি দৈর্ঘ্যের ভূপেন হাজারিকার সেতু নির্মাণ খরচ হয়েছিল মাত্র ১৫৬ মিলিয়ন ডলার। ভূপেন হাজারিকা সেতুর নির্মাণ ব্যয়ের সঙ্গে পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় তুলনা করলে পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয়ে ভারতে ৩০টি ভূপেন হাজারিকা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব।

ইউক্রেনের মূল ভূখণ্ড থেকে ক্রিমিয়ার সংযোগ সেতু ‘ক্রিমিয়া সেতু’ নির্মাণে খরচ হয়েছিল ৩ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার। সেতুটির দৈর্ঘ্য ১৮ দশমিক ১ কিলোমিটার, যা পদ্মা সেতুর থেকে তিনগুণ বেশি দীর্ঘ। এ সেতুর পাইলের দৈর্ঘ্য পদ্মা সেতুর পাইলেরে দৈর্ঘ্যের সমান।

ধরা যাক, পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় অস্বাভাবিক বেশি নয়। তাহলে কী হতো?

ক. বিশ্বে পদ্মা সেতুর চেয়ে বড় সেতু রয়েছে। কিন্তু পদ্মা নদীর মতো গভীর এবং খরস্রোতা নদীর ওপর এমন কোনো সেতু নেই। শুধু পদ্মা নদীর দুদিকে নদী শাসনে বাংলাদেশেকে ব্যয় করতে হয়েছে ১ বিলিয়ন ডলার। যে ব্যয়কে মোট সেতু নির্মাণ ব্যয়ের সঙ্গে যোগ করতে হয়েছে।

খ. প্রাথমিক পর্যায়ে পদ্মা সেতু নির্মাণে বাজেট বরাদ্দ ছিল ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু পরে ধাপে ধাপে এই বাজেট তিনগুণ বেড়েছে। নির্মাণকাজের বিলম্ব হওয়ায় তা উল্লেখযোগ্যভাবে প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে। বিলম্বিত নির্মাণকাজ ২০১৫ সালের নভেম্বরে শুরু হয়েছিল এবং সেতুটি ২০২২ সালের জুনে সড়কের অংশ যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়।

২। দুর্নীতির অভিযোগ

প্রাথমিকভাবে বিশ্বব্যাংক ১ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ দিয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন করতে চেয়েছিল। তবে, দুর্নীতির আশঙ্কায় ২০১২ সালের জুনে ব্যাংকটি পদ্মা সেতুর ঋণ অনুমোদন প্রত্যাহার করে। কানাডার একটি কোম্পানি এসএনসি লাভালিনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ পাওয়ার চেষ্টার অভিযোগ করা হয়েছিল। তবে তথ্য প্রমাণ না পাওয়ায় তদন্ত প্রত্যাহার করে নেয় আদালত এবং মামলাটি খারিজ হয়ে যায়।

পদ্মা সেতু নির্মাণে দুর্নীতি এবং ঘুষ লেনদেন হয়েছে বলে ধরে নিলে, সেটির ফলাফল দুরকম হতে পারে। প্রথমত. অর্থনৈতিক সম্পদের ভুল বরাদ্দ এবং দ্বিতীয়ত, সরকারি খাত থেকে বেসরকারি খাতে অর্থনৈতিক সম্পদ হস্তান্তর করা। সুতরাং, এতে কোনো নিট ক্ষতি ছিল না।

৩। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের কস্ট-বেনিফিট অ্যানালাইসিস

এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) ২০০৯ সালে পদ্মা সেতুর সম্ভাবনা নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। যেখানে আগামী ৩০ বছরের মেয়াদে সেতুটি কী কী সুবিধা দেবে এবং সেই অনুপাতে পদ্মা সেতুর খরচকে বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়।

এডিবির বিশ্লেষণে বাংলাদেশে মূলধনের অর্থনৈতিক সুযোগ ব্যয়কে প্রতিফলিত করে ১২ শতাংশের প্রকৃত সুদের হার ধরা হয়। প্রস্তাবিত প্রকল্প বিনিয়োগের জন্য ফলাফলের অর্থনৈতিক সুযোগের অভ্যন্তরীণ হার (ইআইআরআর) অনুমান করা হয়েছে ২০ শতাংশ। যেহেতু ২০ শতাংশ ইআইআরআর ১২ শতাংশ বাস্তব সুদের সুযোগ ব্যয়কে অতিক্রম করেছে এবং এটি অর্থনীতির পাঠ্যপুস্তকের তত্ত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাই এডিবি প্রস্তাবিত পদ্মা সেতুকে অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক বলে মনে করেছে।

৪। পদ্মা সেতুর ৩ দশমিক ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের খরচ শিগগিরই সম্পূর্ণরূপে পুনরুদ্ধার করা যেতে পারে।

পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিকভাবে দুর্দশাগ্রস্ত দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ২ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে এবং জাতীয় জিডিপি ১ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, ২০২১ সালে বাংলাদেশের জিডিপি ছিল ৪১৬ বিলিয়ন ডলার। পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রাক্কলিত প্রস্তাব অনুযায়ী, পদ্মা সেতু থেকে বার্ষিক ৪ দশমিক ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের উৎপাদন সুবিধা পাবে বাংলাদেশ, যা বাংলাদেশের মোট জিডিপি ১ দশমিক ২ শতাংশ। ফলে পদ্মা সেতুর ৩ দশমিক ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের খরচ দ্রুতই তুলে আনতে করতে পারবে বাংলাদেশ।

৫। পাবলিক ফাইন্যান্স এবং সেতুর অর্থায়ন

প্রায় ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ের পদ্মা সেতু সম্পূর্ণরূপে অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহের মাধ্যমে নির্মাণ করা হয়েছে। একটি নিম্ন আয়ের অর্থনীতি কীভাবে বৃহৎ আকারের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো প্রকল্পের অর্থায়নের জন্য দেশীয় সম্পদকে সফলভাবে একত্রিত করতে পারে তার একটি আদর্শ নিদর্শন পদ্মা সেতু প্রকল্প।

৬। ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলোর শিল্পায়ন

বাংলাদেশের কল-কারখানা, অন্যান্য ব্যবসায়িক খাত এবং জনপ্রশাসন ব্যাপকভাবে রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক। ঢাকা পৃথিবীর সবচেয়ে ঘন বসতিপূর্ণ একটি শহর। একটি বিশাল সংখ্যক গ্রামীণ জনসংখ্যার স্থানান্তর ঘটেছে এ শহরে। রয়েছে নানা সংকট। ঢাকা শহর ব্যাপক শব্দ দূষণ, বায়ু দূষণ এবং যানজটের সম্মুখীন।

পদ্মা সেতু দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের শিল্পায়নে সহায়তা জোগাবে এবং এই অঞ্চলে পর্যটনের বিকাশ ঘটাবে, যা রাজধানী ঢাকা থেকে অভিবাসন হ্রাস এবং ঢাকাসহ অন্যান্য শহরগুলোর অতিরিক্ত নগরায়নের রাশ টেনে ধরবে।

৭। সম্প্রসারিত ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে সুবিধা

১৯৯৪ সালে উত্তর আমেরিকার মুক্ত বাণিজ্য এলাকা কার্যকর হওয়ার আগে কানাডা, মেক্সিকো এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুক্ত বাণিজ্য ছিল না। যদিও এই তিন দেশের মধ্যে যাতায়াতে উঁচু-নিচু পাহাড় কিংবা উত্তাল নদীর মতো কোনো প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা ছিল না তবুও শুল্কের মতো অর্থনৈতিক বাঁধা এই তিনটি দেশের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্যকে বাধাগ্রস্ত করেছিল।

১৯৯৪ সালের পরে যখন বেশিরভাগ শুল্ক বিলুপ্ত করা হয়েছিল, নাফটা সদস্যরা তাদের ব্যবসায়িক পণ্যগুলোর দাম কমাতে পারার সঙ্গে সঙ্গে উচ্চতর জীবনযাত্রা উপভোগ করেছিল।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সমুদ্রসাদৃশ পদ্মা নদী একটি ‘প্রাকৃতিক বাধা’ হিসেবে কাজ করেছে, যা মানুষ, পণ্য ও পরিষেবার অবাধ প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের ফলে যে সুফল পাওয়া যাচ্ছে তা অবাধ বাণিজ্য থেকে উদ্ভূত সুবিধার অনুরূপ।

৮। পদ্মা সেতু সেই সোনার হাঁস- যা ইতোমধ্যেই ডিম দিতে শুরু করেছে।

ক. যানবাহন এবং টোল : ২ জুলাই ২০২২ তারিখে টাইমস বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকা রিপোর্ট করেছে, ২০২২ সালের ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর থেকে এক দিনে সর্বোচ্চ পরিমাণ টোল আদায় হয়েছে ১ জুলাই (শুক্রবার)। এবং পদ্মা সেতু থেকে এক দিনে আদায় হওয়া এ টোলের পরিমাণ ছিল ৩ কোটি ১৬ লাখ ৫৩ হাজার ২০০ টাকা।

যোগাযোগের বিকল্প ভিন্ন উপায় না থাকায় এবং সবচেয়ে কম সময়ের মধ্যে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পদ্মা নদী অতিক্রম করায় মানুষের ব্যাপক আগ্রহ ছিল। অর্থনীতি শাস্ত্রে বলা হয়, অস্থিতিস্থাপক চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে যদি টোলহার বেশি হয় তাহলে এটি সরকারের জন্য আরও বেশি রাজস্ব তৈরি করে।

খ. পটুয়াখালীর মৎস্য শিল্পের উন্নতি : বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণ উপকূলে অবস্থিত পটুয়াখালীতে বছরে প্রায় ১ দশমিক ২৩ লাখ টন মাছ উৎপন্ন হয়। যার মধ্যে ৩৬ হাজার টন স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে এবং বাকিটা দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি হয়। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে সরাসরি ও দ্রুত মাছের চালান পাঠানো সম্ভব হয়েছে। তারা উচ্চ চাহিদা, দাম এবং লাভের প্রত্যাশায় মাছ চাষ সম্প্রসারণ করেছেন।

গ. পদ্মা সেতু-সম্পর্কিত অর্থনৈতিক সুবিধা বিভিন্ন খাতে প্রবাহিত হওয়ার সম্ভাবনা : কিছু সমালোচক যুক্তি দিয়েছিলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য বাংলাদেশি করদাতাদের কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগের পরিবর্তে, পেনশন এবং শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য সামাজিক কর্মসূচিতে ব্যয় করা উচিত। কিন্তু পদ্মা সেতু অর্থনীতিবিদদের দীর্ঘদিনের সেই ধারণাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করেছে। রাস্তা, মহাসড়ক এবং বন্দরসহ ভৌত অবকাঠামোতে বিনিয়োগ একটি দেশের অর্থনীতির সকল স্তরের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করে। যার ফলে একটি অর্থপূর্ণ অর্থনৈতিক উন্নয়নের সূচনা হয়। পদ্মা সেতু নির্মাণে বিনিয়োগ একটি ভালো অর্থনৈতিক উদাহরণ। টোল ও ট্যাক্সের আকারে পদ্মা সেতু থেকে প্রাপ্ত অর্থনৈতিক লাভ প্রয়োজনীয় এবং অতিরিক্ত সামাজিক কর্মসূচির অর্থায়নে ব্যবহার করা যেতে পারে।

পদ্মা সেতুর প্রভাব

১। বিশ্বব্যাংকের তহবিল বাতিল এবং শেখ হাসিনা সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু : ২০১২ সালে বিশ্বব্যাংকের তহবিল বাতিল এবং শেখ হাসিনা সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত ১৯৯৭ সালে মালয়েশিয়ার মাহাথির মুহাম্মদের সরকারের আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের প্রত্যাখ্যানের প্রতিধ্বনি হিসেবে দেখা যেতে পারে। যেমন আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে দুর্নীতির অভিযোগে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের ঋণ বাতিল করে। এডিবি এবং জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)সহ অন্যান্য দাতা সংস্থাগুলোও বিশ্বব্যাংকের এই সিদ্ধান্ত অনুসরণ করে।

বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব তহবিল থেকে প্রকল্পে অর্থায়নের সিদ্ধান্ত নেয়। এমনকি চীনের ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা প্রকল্প ব্যয়ের ৭০ শতাংশ বিনিয়োগ করে একটি বিল্ড-ওন-ট্রান্সফার (বিওটি) ভিত্তিতে সেতু নির্মাণের প্রস্তাবও বাংলাদেশ সরকার প্রত্যাখ্যান করে।

বাংলাদেশের পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত, বাংলাদেশ কর্তৃক অন্যান্য ঋণদাতাদের বিশেষ করে বিশ্বব্যাংকের প্রত্যাখ্যানকে চপেটাঘাত করে। একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে। তখন দক্ষিণ কোরিয়া রাজধানী সিউলের সঙ্গে প্রধান বন্দর শহর বুসানের সংযোগকারী একটি এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। বিশ্বব্যাংক এবং ঋণদাতারা এই উদ্যোগ প্রত্যাখ্যান করার পর কোরিয়া নিজ অর্থায়নেই এই সড়ক নির্মাণে এগিয়ে যায়। কোরিয়া সেই প্রকল্প নির্ধারিত সময়ের অর্ধেক সময়ে এবং অনেক কম খরচে সম্পন্ন করে ফেলে।

২। বাংলাদেশের সাহায্য-নির্ভরতার কলঙ্ক চিরতরে মুছে গেছে : নিজস্ব অভ্যন্তরীণ সম্পদ দিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য বাংলাদেশের সংকল্প দেশের ‘হ্যান্ডআউট নির্ভরতার কলঙ্কিত চিত্র’ চিরতরে মুছে দিয়েছে। ঋণদাতারা এখন বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে।

বাংলাদেশ কখনোই বিদেশি ঋণদাতা এবং আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়নি। সে হিসেবে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং প্রশংসনীয়। উপরন্তু, পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের জন্য বাংলাদেশের ‘ডু-ইট-অ্যালোন’ কৌশল বাংলাদেশের প্রতি ঋণদাতাদের দৃষ্টিভঙ্গি উল্টে দিয়েছে। ঋণদাতারা এখন বাংলাদেশকে ঋণ প্রদানে আগ্রহ প্রকাশ করছে।

৩। বিদেশে বাংলাদেশি প্রকৌশলীদের কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা বেড়েছে : পদ্মা সেতু নির্মাণে নিয়োজিত ৪ হাজার প্রকৌশলীর মধ্যে এক তৃতীয়াংশই ছিলেন বাংলাদেশি। তারা পদ্মা সেতু নির্মাণে প্রয়োগ করা অত্যাধুনিক প্রযুক্তি থেকে উচ্চ ও প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। এসব বাংলাদেশি প্রকৌশলীর বিদেশে চাকরি পাওয়ার সুযোগ বেড়েছে।

এখানে দক্ষিণ কোরিয়ার উদাহরণ উল্লেখ করা প্রয়োজন। বিশ্বব্যাংক এবং ঋণদাতাদের অমান্য করে নির্মিত সিউল-বুসান এক্সপ্রেসওয়ে শুধু দুটি প্রধান জনসংখ্যা কেন্দ্রের মধ্যে করিডোর তৈরি এবং এ কেন্দ্রীক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে উৎসাহিত করার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। বরং এই অবকাঠামো কোরিয়া প্রজাতন্ত্রের জনগণের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষারও সুযোগ করে দিয়েছিল। এখান থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতা ও সক্ষমতা দক্ষিণ কোরিয়ার নির্মাণ কোম্পানিগুলোকে মধ্যপ্রাচ্যে বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্পে কাজ করতে সক্ষম করে তুলেছিল। এটি ছিল দক্ষিণ কোরিয়ার বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎস। আজ কোরিয়া প্রজাতন্ত্র অবকাঠামো নির্মাণে একটি আইকন হিসেবে স্বীকৃত।

৪। পদ্মা সেতু ও এশিয়ান হাইওয়ের সংযোগ : এশিয়ান হাইওয়ে-১, যা সিলেট-ঢাকা-নড়াইল-যশোর হয়ে আসামকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করেছে। এই হাইওয়ের দুটি মিসিং পয়েন্ট ছিল : পদ্মা সেতু এবং নড়াইলের কালনা সেতু। এশিয়ার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানো এবং মহাদেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান উন্নত করার জন্য পদ্মা সেতু একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করবে। পদ্মা সেতু ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে (টিএআর) নেটওয়ার্কের জন্য একটি নতুন রুট তৈরির পথও প্রশস্ত করবে। উন্নত বাণিজ্য ও ব্যবসার জন্য সংযোগ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

৫। বিদ্যমান ভৌত অবকাঠামোর সক্ষমতা ব্যবহার : পদ্মা সেতুর সম্প্রসারিত সংযোগের ফলাফল দেশের বিদ্যমান অবকাঠামোর সম্প্রসারিত ব্যবহারকে সহজতর করবে। উদাহরণস্বরূপ- পায়রা, মংলা এবং বেনাপোল বন্দরকে শিল্পায়নে পিছিয়ে থাকা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধিতে ব্যবহার করা যেতে পারে।

৬। পদ্মা সেতু এবং চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ : পদ্মা সেতু চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেডের প্রযুক্তিগত এবং প্রকৌশলগত সহযোগিতায় নির্মিত। বেইজিং এটিকে চীন-বাংলাদেশ সহযোগিতার জন্য একটি মাইলফলক হিসেবে দেখে। চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম এটিকে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনফ্রাস্ট্রাকচারের (বিআরআই) অংশ হিসেবে চিত্রিত করেছে।

এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, চীনের (বিআরআই) হলো, ক. অর্থনৈতিক নির্ভরতা তৈরি করে দক্ষিণ এশিয়ায় পা বাড়াতে তার একটি নব্য-ঔপনিবেশিক কৌশল। চীন যেমনটি করেছিল শ্রীলঙ্কায়। খ. ভারতের নিরাপত্তা এবং কৌশলগত স্বার্থকে ক্ষুণ্ন করা খেলার একটি অংশ।

যাইহোক, লন্ডনভিত্তিক চ্যাথাম হাউস এবং সিডনিভিত্তিক লোওয়ে ফাউন্ডেশনের মতো স্বাধীন গবেষণায় চীনের এমন কোনো উদ্দেশ্যের প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

উপসংহার

৩ দশমিক ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রকল্পটির নির্মাণকাজ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তত্ত্বাবধান করেছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২৫ জুন ২০২২ তারিখে চালু হওয়ার সময় তিনি পদ্মা সেতুকে ‘বাংলাদেশের গর্ব, সম্মান এবং ক্ষমতার প্রতীক’ হিসেবে অভিহিত করেন। জাতীয় শহীদ স্মৃতিসৌধ এবং শহীদ মিনারের পাশাপাশি পদ্মা সেতু আমাদের জাতীয় চেতনার স্মৃতিস্তম্ভ হিসাবে যুক্ত হয়েছে।

পদ্মা সেতুর আয় দিয়ে শুধু এর নির্মাণব্যয় উঠে আসবে না বরং এই সেতু বিশেষ করে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এবং পাশাপাশি পুরো দেশের অর্থনৈতিক দৃশ্যপটকেও পরিবর্তন করবে। প্রতিবেশী দেশগুলোও পাবে পদ্মা সেতুর সুফল।

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর, বাংলাদেশ সফলভাবে একটি তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে দক্ষিণ এশীয় অর্থানীতির বিস্ময়ে রূপ নিয়েছ। যেখানে পদ্মা সেতু একটি নির্মাণ স্বারক।

মুহাম্মদ ফয়জুল ইসলাম : নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, বোস্টন, ম্যাসাচুসেটস থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকারে পঁচিশ বছরের বেশি সময় ধরে কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে চার দশকেরও বেশি সময় ধরে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। তিনি মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে (গ্লোবাল ক্যাম্পাস) শিক্ষকতা করেন। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের একজন আন্তর্জাতিক বিজনেস রিভিউয়ার এবং সাবেক ফুলব্রাইট স্কলার ছিলেন।

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বিএনপি যা চেয়েছে তাই হয়েছে : এ্যানি

আ.লীগের সাবেক এমপিসহ গ্রেপ্তার ৭

সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে যেসব জেলায় হতে পারে বজ্রবৃষ্টি

সীমান্তে কঠোর অবস্থানে বিজিবি-পুলিশ

কমেছে সোনার দাম, কার্যকর আজ

রংপুরে আবহাওয়া পর্যবেক্ষণে নতুন দিগন্তের সূচনা

যশোরে দুগ্রুপের সংঘর্ষে বিএনপি কর্মী নিহত

আ.লীগ নিষিদ্ধের খবরে জাবিতে মিষ্টি বিতরণ

বিশ্লেষণ / যুদ্ধে ভারতের ক্ষতি ৮৩ বিলিয়ন, পাকিস্তানের কত? 

আ.লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণায় আখাউড়ায় মিষ্টি বিতরণ

১০

বগুড়ায় মহিলা আ.লীগের ২ নেত্রী গ্রেপ্তার

১১

আবদুল হামিদ ফ্যাসিবাদের প্রতিনিধি ছিলেন : রিজভী

১২

চোখ রাঙাচ্ছে ঘূর্ণিঝড় ‘শক্তি’

১৩

ভারতে যাওয়ার সময় আ.লীগ নেতা গ্রেপ্তার

১৪

বান্দরবানে নানা আয়োজনে বুদ্ধপূর্ণিমা উদযাপন

১৫

নাটোরে ট্রেনে কাটা পড়ে বৃদ্ধের মৃত্যু

১৬

আ.লীগ পালিয়েছে বলায় বিএনপির ৪ কর্মীকে কুপিয়ে জখম

১৭

টেস্ট থেকে অবসরের সিদ্ধান্তে অনড় কোহলি

১৮

‘প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ঘাড়ে চড়ে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন পূরণ হবে না’

১৯

অস্ত্রসহ ইউপিডিএফের কর্মী জীবন গ্রেপ্তার 

২০
X