বুধবার, ২৭ আগস্ট ২০২৫, ১২ ভাদ্র ১৪৩২
ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ
প্রকাশ : ০১ নভেম্বর ২০২৩, ০২:০৩ পিএম
আপডেট : ০১ নভেম্বর ২০২৩, ০৭:০৫ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত নতুন উপাচার্য কি প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম হবেন?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত নতুন উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল। ছবি : সৌজন্য
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত নতুন উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল। ছবি : সৌজন্য

মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও চ্যান্সেলরের অনুমোদনক্রমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের ১৫ অক্টোবর তারিখের এক প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রো-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামালকে উপাচার্য পদে সাময়িকভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনি ২০২৩ সালের নভম্বরের ৪ তারিখ থেকে বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানের স্থলাভিষিক্ত হবেন।

এ নিয়োগের বিষয়টি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে অনেকে একধরনের আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। অনেকের আশা উপাচার্য হিসেবে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণাকে অন্যতম উচ্চতায় নিতে সক্ষম হবেন। এর পেছনে মূল কারণ প্রো-উপাচার্য (শিক্ষা) থাকাকালীন শিক্ষক নিয়োগে তার বলিষ্ঠতার প্রমাণ রাখা এবং নিরপেক্ষতা বজায় রাখার চেষ্টা করা। তাছাড়া তিনি একজন উঁচুমানের শিক্ষক এবং বিশ্বমানের গবেষক। সর্বোপরি দলমত নির্বিশেষে তিনি একজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব।

তবে এ ধরনের আশাবাদ আগেও কিছুটা ব্যক্ত হয়েছে। বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান যখন ২০১৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর এরকম একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম ‍স আরেফিন সিদ্দিকের স্থলাভিষিক্ত হন, তখনও একধরনের আশার সঞ্চার হয়েছিল। কিন্তু সে আশা কতটুকু পূরণ হয়েছে তা বিচারের ভার পাঠকের ওপর ছেড়ে দিলাম। দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক ও রেষারেষির সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক অবস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতির বিষবাষ্পে তিনি এ আশা পূরণে কতটুকু সক্ষম হবেন তা নিশ্চয় বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

কোনো প্রতিষ্ঠানকে সামনে এগিয়ে নিতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা অর্জনের কোনো বিকল্প নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা নির্ভর করে ছাত্র, শিক্ষক এবং প্রশাসনের সক্ষমতার ওপর।

দেশের মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হলেও ইদানীংকালে বেশিরভাগেরই একাডেমিক পড়াশোনায় মনোযোগ নেই। এর মূল কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের হল এবং ক্যাম্পাসে পড়াশোনার উপযুক্ত পরিবেশের অভাব, লেজুড়ভিত্তিক দলীয় ছাত্র রাজনীতির বিষবাষ্প এবং দেশে উপযুক্ত কর্মসংস্থানের অভাবে সরকারি চাকরিমুখিতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে এবং ক্যাম্পাসে পড়াশোনার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির সুযোগ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের হাতে বেশ কিছুটা আছে। আশা করি তিনি এ ব্যাপারে যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন। কিন্তু, লেজুড়ভিত্তিক দলীয় ছাত্র রাজনীতির লাগাম টেনে ধরা কিংবা সরকারি চাকরির পাশাপাশি দেশে উপযুক্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করার বিষয়গুলো জাতীয় ইস্যু, এখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের তেমন হাত নেই।

শিক্ষা ও গবেষণার উপযুক্ত অর্থায়ন এবং প্রণোদনার তীব্র অভাব এবং দলীয় লেজুড়ভিত্তিক শিক্ষক রাজনীতিতে জড়িয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেশিভাগই তাদের সক্ষমতার অর্ধেকও ব্যবহার করতে পারেন না। তাই শিক্ষকদের গবেষণামুখী করতে গবেষণার জন্য ডিপার্টমেন্ট/ইনস্টিটিউটভিত্তিক উপযুক্ত অর্থায়ন পদ্ধতি চালু করতে হবে।

এ ক্ষেত্রে বিআইডিএসের মতো পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে। তাছাড়া ইন্টারন্যাশনাল রাঙ্কিং জার্নালে পাবলিকেশন করলে মালয়েশিয়ার মতো জার্নালের রাঙ্ক অনুযায়ী আর্থিক প্রণোদনা দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করা। পাশাপাশি প্রতিটি ডিপার্টমেন্ট/ ইনস্টিটিউটে রিসার্চ অধ্যাপক এবং রিসার্চ এবং সহযোগী অধ্যাপকের একাধিক পদ সৃষ্টি করা। ইন্টারন্যাশনাল রাঙ্কিং জার্নালে পাবলিকেশনের সংখ্যার ভিত্তিতে এ সকল পদে পদায়ন করতে হবে। প্রণোদনা হিসেবে তাদের গবেষণার জন্য বাড়তি ফান্ড প্রদান, টিচিং লোড কমানো এবং দ্বিগুন স্যালারি প্রদান করা। এ পদে যারা অধিষ্ঠিত হবেন তারা গবেষণা মেন্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। তাছাড়া, জুনিয়র এবং মিড্-লেভেল শিক্ষকদের ১-২ বছরকালীন পোস্ট-ডক্টরাল বা গবেষণা ফেলোশিপ প্রদানেরের ব্যবস্থা করা যেন তারা উন্নত বিশ্বের শিক্ষকদের সান্নিধ্যে এসে নিজেদের গবেষণার দক্ষতা বাড়াতে পারে।

এ ক্ষেত্রে স্বনামধন্য বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে আমাদের সমঝোতা চুক্তি করতে হবে। পাশাপাশি আমাদের শিক্ষা এবং গবেষণার মান বাড়াতে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত স্বনামধন্য বাংলাদেশি শিক্ষকদের ১-২ বছরের জন্য ভিসিটিং ফ্যাকাল্টি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রচলিত মৌখিক পরীক্ষার পাশাপাশি প্রার্থীর টিচিং দক্ষতা যাচাইয়ের জন্য নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর পাবলিক লেকচার পদ্ধতি চালু করা।

প্রতিটি বিভাগ এবং ইনস্টিটিউটে টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট এবং রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট পদ সৃষ্টি করে যোগ্যদের নিয়োগ দেওয়া। পরবর্তীতে কর্মদক্ষতা অনুযায়ী তাদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া। প্রভাষক হিসেবে যোগদানের পরে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলকভাবে এমফিল সম্পন্ন করার ব্যবস্থা রাখা। সর্বোপরি, বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষা এবং মূল্যায়ন পদ্ধতিতে যুগোপযোগী পরিবর্তন আনা অপরিহার্য। এসব ব্যবস্থা গ্রহণ করলে হয়তো শিক্ষকরা তাদের পুরো সক্ষমতা ব্যবহারে উদ্যোগী হবে এবং লেজুড়ভিত্তিক দলীয় রাজনীতির বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে সচেষ্ট হবে। কিন্তু, এ পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের চেষ্টার পাশাপাশি সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।

এসব ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উপাচার্য এবং দুই প্রো-উপাচার্যকে পারস্পরিক বিশ্বাস এবং আস্থার সাথে একনিষ্ঠভাবে টিম-স্পিরিট বজায় রেখে কাজ করতে হবে। কিন্তু একাডেমিক এক্সেলেন্সের বদলে প্রায়ই দলীয় বিবেচনায় নিয়োগের ফলে এ রকম গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পরেও তাদের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস এবং আস্থার যথেষ্ট অভাব পরিলক্ষিত হতে দেখা যায়। বরং ভবিষ্যতে আরও উঁচু পদে যাওয়ার জন্য নিজের উপদলীয় রাজনৌতিক বলয় বজায় রাখতে সচেষ্ট থাকে এবং রেষারেষিতে ব্যাস্ত থাকে। ফলে এই তিনজনের মধ্যে টিম-স্পিরিট বজায় রেখে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এগিয়ে আসতে সাধারণত দেখা যায় না। বরং কেউ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ভূমিকা নিলে অন্যরা তাকে কোনঠাসা করতে ব্যস্ত থাকেন।

তাই আগামী ৪ নভেম্বর থেকে প্রো-উপাচার্য (শিক্ষা)-এর পদটি খালী হচ্ছে সে পদে এমন কাউকে নিযুক্ত করা উচিত যিনি নবনিযুক্ত উপচার্যের সাথে পারস্পরিক বিশ্বাস এবং আস্থার ভিত্তিতে একনিষ্ঠ হয়ে কাজ করবেন। উল্লেখ্য, প্রো-উপাচার্য (শিক্ষা) পদটি নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ।

এই পদে এমন কাউকে নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন যিনি সততা, নায়নিষ্ঠতা ও বলিষ্ঠতার সাথে তদবির মোকাবিলা করে নিরপেক্ষভাবে উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগে সচেষ্ট হবেন। উল্লেখ্য, দেশের বর্তমান বাস্তবতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ‍সকল নিয়োগের ক্ষেত্রেই অনেক শক্তিশাল ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের তদবির মোকাবিলা করতে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ পদটি সৃষ্টি হওয়ার পরে যে দুজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তারা একাডেমিক বিবেচনায় এগিয়ে থাকার পাশাপাশি নিরপেক্ষতাও ধরে রাখতে অনেকটা সক্ষম হয়েছে। তাই আশা করি সরকার আবারো এ পদে এমন কাউকে নিয়োগ দিবেন যিনি একাডেমিক এক্সেলেন্সে এগিয়ে থাকার পাশাপাশি সততা, নায়নিষ্ঠতা ও বলিষ্ঠতার সাথে সকল তদবির মোকাবিলা করে শিক্ষক নিয়োগে নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা এবং গবেষণার মান বাড়াতে সচেষ্ট হবেন।

আশা করি নবনিযুক্ত উপাচার্য মহোদয় দুই প্রো-উপাচার্য মহোদয়কে সাথে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত সমস্যা মোকাবিলা করতে সঠিক নেতৃত্ব দিবেন। তাই যদি হয় তাহলে যে সব আশাবাদ ব্যক্ত হচ্ছে তা পূরণে অনেকটা এগিয়ে যাবেন।

ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

হবিগঞ্জ জেলা বিএনপির সম্মেলন ৬ সেপ্টেম্বর

ডাকসুর ভিপি প্রার্থী জালালের বিরুদ্ধে ছুরিকাঘাতের অভিযোগ

ডাকসু নির্বাচন / ছাত্রলীগ সম্পৃক্ততার দায়ে বাদ জুলিয়াস সিজার

ধর্ষণসহ হত্যায় ফুফাতো ভাইয়ের যাবজ্জীবন

কাজী নজরুলের কবিতা দেশের মুক্তিকামী মানুষকে সাহস যুগিয়েছে : তারেক রহমান

‘রোহিতকে সরানোর জন্যই ব্রঙ্কো টেস্ট এনেছে বিসিসিআই’

অভিনেত্রী হিমুর আত্মহত্যা, প্রেমিক রাফির বিচার শুরু

ভারতে প্রয়াত ক্রিকেটারদের স্ত্রীরা পাবে অনুদান

রাজধানীতে একক ব্যবস্থায় বাস চলবে : প্রেস উইং

ভিনিকে বিক্রি করে দিতে বললেন রিয়াল কিংবদন্তি

১০

নতুন বিচারপতিদের মধ্যে সংখ্যালঘু নেই, ঐক্য পরিষদের ক্ষোভ

১১

বিসিবির হাতে বিপিএলের স্পট ফিক্সিং তদন্ত প্রতিবেদন

১২

ফেসবুকের বিরুদ্ধে জিডি করেছেন মাওলানা মামুনুল হক

১৩

চুল পড়া রোধ করবে যে জিনিস

১৪

ডাকসু নির্বাচনে সাত সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন

১৫

সাদাপাথরকাণ্ডে এবার পুলিশে বড় রদবদল

১৬

৪৫ বছর ধরে ঝুপড়ি ঘরে থাকা সেই দম্পতির পাশে ইউএনও

১৭

শুনানিতে বিএনপি-এনসিপির মারামারির ঘটনায় ইসির জিডি

১৮

পাঁচ মাসে ১২ হাজার ২০০ কোটি টাকার প্রস্তাব পেল বিডা

১৯

নির্বাচন পিআর পদ্ধতিতেই হতে হবে : চরমোনাই পীর

২০
X