ড. মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন
প্রকাশ : ১৬ নভেম্বর ২০২৩, ০৩:৩১ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

কৃষি-খাদ্যব্যবস্থায় সাকল্যে-শূন্য গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন বাংলাদেশে অর্জন সম্ভাবনা

ছবি : সৌজন্য
ছবি : সৌজন্য

কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তার রক্ষাকবচ এবং কৃষিদ্রব্য উৎপাদনে জলবায়ুর প্রভাব সবচেয়ে বেশি, বিশেষ করে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা। মানুষের ক্রিয়াকলাপের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। এর প্রধান সূচক বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি। আর তাপমাত্রার বৃদ্ধি ঘটছে পৃথিবীতে মোট কার্বনের অবস্থান পরিবর্তনের ফলে। ভূত্বক (c. ১০০০০০০০০ PgC), মহাসাগর (c. ৩৮০০০PgC), জীবাশ্ম জ্বালানি (c. ৪০০০PgC), মাটি (c. ১৫০০PgC), বায়ুমণ্ডল (c. ৭৫০ PgC), এবং বায়োমাস (c. ৫৬০PgC) হলো কার্বনের আধার।

এ কার্বন নানাবিদ প্রক্রিয়ায় মাধ্যমে এক আধার থেকে অন্য আধারে চলে যায় এবং বৈশ্বিক কার্বন চক্রে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করে। যেমন জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়ে সরাসরি কার্বনডাইঅক্সাইড হিসেবে আবার অ-কার্বনডাইঅক্সাইড, যেমন : মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড, হাইড্রোক্লোরোফ্লুরোকার্বন (HCFCs), হাইড্রোফ্লুরোকার্বন (HFCs) এবং ওজোন হিসেবে নিঃসরণ হয়।

কার্বন-ডাই অক্সাইড ছাড়া বাকিগুলো ইকুইভ্যালেন্ট কার্বন হিসেবে বায়ুমণ্ডলে নিঃসরণ হিসেবে গণনা করা হয়। এদের নাম গ্রিন-হাউস-গ্যাস। মাটি থেকে কার্বনের ক্ষয় সম্পাদন এবং তা বায়ুমণ্ডলে কার্বনের পরিমাণ বৃদ্ধি (উষ্ণায়নের দিকে পরিচালিত করে) করে এবং মহাসাগরগুলো (অম্লকরণের দিকে পরিচালিত করে) ও কিছু প্রধান প্রক্রিয়ায় বৈশ্বিক কার্বন চক্রে ভারসাম্যহীনতায় অবদান রাখে। তবে মানবসভ্যতা বিকাশের কাজে ব্যবহৃত জিবাশ্ম জালানি আশ্রিত শিল্পকারখানা, রাস্তাঘাট, খাদ্য উত্‌পাদন, জীবনপ্রণালি ও দ্রব্যাদি বৈশ্বিক উষ্ঞায়নে সর্বাপেক্ষা বেশি অবদান রাখছে।

মানুষের নানাবিদ উদ্ভাবনা ও তাদের অযাচিত প্রয়োগের জন্য জীবাশ্ম জালানির ব্যবহার অব্যাহতভাবে বাড়ছে, এতে বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে, ফলে উষ্ণায়নও থেমে নেই। দেখা গেছে, ২০১১-২০ সালে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ১৮৫০-১৯০০ সালের তুলনায় ১.১°C এর উপরে পৌঁছেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন তাপমাত্রা এভাবে বাড়তে থাকলে এ ধরিত্রী একসময় মানবজাতির বসবাসের জন্য অযোগ্য হয়ে উঠবে।

কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তন অভিঘাত তথা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের অভিঘাত খাদ্য নিরাপত্তার জন্য ভয়াবহ হুমকি, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো একটি কৃষিনির্ভর জনবহুল দেশের জন্য আরও বেশি উদ্বেগের বিষয়। পরীক্ষান্তে দেখা গেছে, বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা প্রতি ডিগ্রি-সেলসিয়াস বৃদ্ধির ফলে ধানের ফলন ৩.২%, গমের ফলন ৬%, ভুট্টা ৭.৪% হ্রাস পাবে এবং ডাল, তেল, সবজি, ফল, ও অন্যান্য ফসলের বেলায়ও তেমনটি ঘটবে, জৈববৈচিত্র্য কমে যাবে। বাংলাদেশ ভূপ্রাকৃতিক অবস্থানের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাতের নানামুখী প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হচ্ছে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে হিমালয়ের বরফ গলে দেশের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত এবং খাদ্য উত্‌পাদনে নেতিবাচক প্রভাব, বিশেষ করে উচ্চ তাপমাত্রায় অনেক ফসল তার স্বাভাবিক ফলন ক্ষমতা হারাতে পারে। আবার জলাবদ্ধতা, খরা, লবণাক্ততা, তাপমাত্রা স্বাভাবিক হতে চূড়ান্ত উঠানামা, অসময়ে বৃষ্টি ইত্যাদি, অনিয়মিতভাবে ঘটতে থাকবে এতে খাদ্য উত্‌পাদন চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। দেশে কিছু বিরূপ আলামত এখনই দেখা যাচ্ছে, যা অভূতপূর্ব।

বিশ্বব্যাপী এটা সকলের নজরে এসেছে, গ্রিন হাউস গ্যাস নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। ফলে প্যারিস জলবায়ু সম্মেলন (COP-21) থেকে নেটশূন্য বা সাকল্যে-শূন্য কার্বন নিঃসরণ ধারণার উদ্ভব হয়। গ্লাসগো জলবায়ু সম্মেলন এবং মিসরের শারম আল শেখ সম্মেলনেও সাকল্যে-শূন্য কার্বন নিঃসরণের বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে। বিজ্ঞানীদের ধারণা ২০৩০ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে কোনো এক সময় শূন্য নিঃসরণ প্রয়োজন। সাকল্যে-শূন্য কার্বন গণনায় গ্রিন-হাউস-গ্যাস হতে নির্গত কার্বন বা সমতুল্য কার্বন ও অপসারিত কার্বন সমান হয়। এ ধারণা বাস্তবায়ন করতে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সব দেশ একমত পোষণ করেছে, বাংলাদেশও তার অংশীজন।

খাদ্য ও কৃষিব্যবস্থা থেকেও কার্বন-ডাই অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড এবং ফ্লোরিনেটেডগ্যাসসমূহ (F-গ্যাস) নিঃসরণ হয়। বর্তমানে কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থা হতে বিশ্বব্যাপী প্রায় ২০ গিগাটন কার্বনডাইঅক্সাইড সমতূল্য গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গত হয়। যা মোট নির্গমনের প্রায় ৩৫ ভাগ এবং বাংলাদেশেও তা ৩৫-৩৮ ভাগ।

দেশের কৃষি-খাদ্যব্যবস্থা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মোট নির্গমনের ৩০-৩৫ ভাগ আসে ধান চাষে, কৃত্রিম রাসায়নিক সার ৭ ভাগ, ফসলের অবশিস্টাংশ ৫ ভাগ, জৈব উপায়ে ফসল চাষ ৪ ভাগ, ফসলের অবশিষ্টাংশ পোড়ানো ১ ভাগ, মাটিতে জৈবসার প্রয়োগে ২ ভাগ গ্রিন-হাউন-গ্যাস নির্গমন হয়। এ ছাড়া গবাদিপশুর অন্ত্রের গাঁজন ৩২ ভাগ, মাটিতে জৈব বা গোবর প্রয়োগ ২ ভাগ, জৈব সার ব্যবস্থাপনায় ৩ ভাগ নিগর্মন হয়। অধিকন্তু খাদ্য প্রক্রিয়া, পরিবহন, বর্জ্য খাত মিলে আরও ৯-১০ ভাগ নিঃসরণ হয়। ভূমির ব্যবহার ও জমির ব্যবহার পরিবর্তনে ১৪-১৬ ভাগ, এভাবে কৃষি খাদ্যব্যবস্থা থেকে মোট পরিমাণ ১৪০-১৫০ মিলিয়ন টন গ্রিন-হাউস-গ্যাস নিঃসরণ হয়। বৈশ্বিক বাস্তবতায় তা খুবই সামান্য হলেও তবে দেশের অভ্যন্তরে সবো‍র্চ্চ। খাদ্যব্যবস্থা হতে নিগর্ত গ্রিন-হাউস-গ্যাসসমূহের মধ্যে মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইডের পরিমাণ বেশি, যার উত্‌স ধান উত্‌পাদন, কৃষিজাত বর্জ্য ও গবাদিপশু। এ খাত থেকে বিগত ৩০ বছরের পরিমাণে নির্গমন প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে, তবে তার প্রবৃদ্ধি অন্য খাতগুলোর চেয়ে কম।

প্রকৃতিতে গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন অনিবার্য এবং জলবায়ু পরিবর্তনও তাই, তবে মোট গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনের চেয়ে কোনো গ্যাসটি বৈশ্বিক উষ্ণায়নে অবদান রাখছে, কী পরিমাণ অবদান রাখে, তার উৎস, তা দিয়ে ক্ষতি বা লাভ তা নির্ধারণ করা জরুরি। যেমন বৈশ্বিক উষ্ণায়ন সম্ভাবনা (GWP) গ্যাসের ইনফ্রারেড বিকিরণ শোষণ করার ক্ষমতা, তরঙ্গদৈর্ঘ্য যা গ্যাস বিকিরণ শোষণ করে এবং গ্যাসের বায়ুমণ্ডলীয় জীবনকাল দ্বারা নির্ধারিত হয়। তবে সময়কাল পরিমাপক সূচকের গুরুত্বই বেশি, তা ২০ (স্বল্পস্থায়ী), ১০০ (দীর্ঘস্থায়ী) ও ৫০০ (দীর্ঘস্থায়ী) বছরব্যাপী আছে, এর মধ্যে ১০০ বছরকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নির্গত গ্রিন-হাউস-গ্যাসের স্থায়ীত্বকাল ১০০ বছর বা ততোর্দ্ধ, অন্যদিকে কৃষি-খাদ্য সংশ্লিষ্ট গ্যাস (মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড) স্বল্প স্থায়ী এবং পূর্ণব্যবহার যোগ্য (বায়োজেনিক বা জৈব-রাসায়নিক) কার্বন চক্রে জৈব-রাসায়নিক কার্বন (ফসলের অবশিষ্টাংশ পচে, বা মাটির শ্বসন প্রক্রিয়ায় নির্গত অর্থাৎ জৈব উৎস থেকে নির্গত কার্বন) ও অ-বায়োজেনিক (লক্ষ লক্ষ বছরব্যাপী সংবন্ধিত জীবাশ্ম পুড়ে নির্গত কার্বন, যেমন কয়লা, তেল) দু-ধরনের কার্বন নিঃসরিত হয়।

জৈব রাসায়নিক কার্বনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এরা গাছের জন্য সহজেই গ্রহণীয় এবং কার্বন চক্র সম্পাদন করতে কম সময় নেয় ও এবং বায়ুমণ্ডলে এ জাতীয় কার্বন ডাইঅক্সাইডের ঘনত্ব বাড়লে ফসলের সালোকসংশ্লেষণ ও পানি ব্যবহার দক্ষতা বাড়ে এবং উত্‌পাদনও বাড়ে। অন্যদিকে জীবাশ্মের কার্বনের দীর্ঘ সময় লাগে, ফলে জৈব রাসায়নিক কার্বনকে মাটিতে ও জৈব-বস্তুতে সংবন্ধনের কাজে লাগানোর সম্ভাবনা আছে। জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত আন্তঃসরকার প্যানেল (IPCC) অনুয়ায়ী, জৈব-রাসায়নিক উৎস থেকে সমতূল্য CO2 নির্গমন কার্বন-নিরপেক্ষ হিসেবে বিবেচিত এবং জলবায়ুগত দৃষ্টিকোণ থেকে GHG নির্গমনে অবদান রাখে না।

বিশ্বের কোনো দেশে জৈব-বন্তু পোড়ানোর জন্য কার্বন-ট্যাক্স প্রয়োগ করা হয় না। তাহলে আইপিসিসি মতানুসারে জৈব-রাসায়নিক নিঃসরণ বৈশ্বিক উষ্ণায়নের অবদান রাখে না এবং সে পরিমাণ নিঃসরণ বাদ দেওয়া যায়। কিন্তু বর্তমান সময়ে কৃষিখাত সবচেয়ে বেশি গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ করছে এমন প্রচারণা ফলাও করে সবসময় করা হয়। কেন করা হয় তা অনুসন্ধান করা জরুরি এবং তা করা দুরূহ নয়। একটা সরলী উদাহরণ হলো, উন্নত রাষ্ট্রগুলো তাদের বিজ্ঞান প্রযুক্তি উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি জীবাশ্ম জালানি ব্যবহার করে, যার GWP খুবই উচ্চ, সে কার্যক্রম আড়াল করার জন্য তারা কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থায় বেশি বেশি GHG নিঃগর্মনের কথা বেশি প্রচার করে একটা ধূম্রজাল তৈরি করে।

জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে পৃথিবীর মোট খাদ্যের ৭০-৮০ ভাগ ক্ষুদ্র খামারিরা জোগান দেয়। এদের ইতিবাচক কার্যক্রমকে নেতিবাচক তথ্য দিয়ে উপস্থাপন করে তাদের মর্যাদা ও মহিমাকে অবমূল্যায়ন করাও একটা লক্ষ্য। এমনকি তথ্য তৈরি করার ক্ষেত্রেও চাতু‍র্য্যপনা আছে, যেমন তারা ধানের জমিতে প্রকৃত মিথেন নিঃসরণ অপেক্ষা বেশি বলছে, যা বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণ আছে। আবার ফ্রিজিয়ান জাতের তুলনায় বাংলাদেশের স্থানীয় জাতের গবাদি পশুর অন্ত্রের গাঁজনে নাইট্রাস অক্সাইড কম উৎপাদন হয়, কিন্তু উপস্থাপন করা হচ্ছে গড়ে।

বৈশ্বিক উষ্ণায়নের GHG-এর অবদান নানা মাত্রায় চিহ্নিত করা গেছে। কৃষি-খাদ্য খাতে জীবাশ্ম জালানি ব্যবহার হয় কৃত্রিম রাসায়নিক উপকরণ উৎপাদন ও ব্যবহারে, তা পরিবহন ও প্রক্রিয়াকরণে। যেমন ইউরিয়া সার উৎপাদনে কার্বনডাইঅক্সাইড ও নাইট্রোজেন ব্যবহার হয়, কিন্তু তা কৃষি জমিতে ব্যবহারে উভয়ই নির্গত হয়। IPCC বলছে কৃষি জমিতে ব্যবহৃত এক কেজি ইউরিয়া, ডিএপি, টিএসপি ও এমপি সার যথাক্রমে ১১.১৯, ১১.২৭, ০.৫৬ ও ০.৪৬ কেজি ইকুইভ্যালেন্ট কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণ করে এবং তা উৎপাদন করতে যথাক্রমে ২৩.৪৫, ৬.৭৬, ০.১৮, ৬.৭৬ মেগাজুল শক্তি লাগে, যার প্রধান উৎস জীবাশ্ম জালানি এবং GWP-১০০ এর অন্তর্ভুক্ত। অথচ জৈব উৎস থেকে সমপরিমাণ নাইট্রোজেন, ফসফরাস পটাশিয়াম থেকে যে মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইড উৎপন্ন হয় তার পুরোটাই জৈব-রাসায়নিক। এ ছাড়া কৃত্রিম বালাইনাশকও উৎপাদন ব্যবহারেও এমনটি আবার পরিবহন ও প্রক্রিয়াকরণে ব্যবহৃত শক্তি জীবাশ্ম জালানিনির্ভর। সুতরাং কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থায় বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জীবাশ্ম জালানি অবদানকে চিহ্নিত করে, তা সাকল্যে-শূন্য করার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক কৌশল প্রণয়ন বাংলাদেশের জন্য জরুরি। প্রকৃতিতে নির্গত কার্বন অপসারণ এখন বৈশ্বিক চাহিদা। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের অবদানকারী গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ ও ব্যবহার সাকল্যে-শূন্য করার কৌশল হলো, কার্বন অপসারণ, নির্গমণ কমানো, পুনঃব্যবহার ও এড়ানোর নীতি প্রয়োগ করা যেতে পারে। অপসারণের প্রক্রিয়াগুলির মধ্যে মূল হলো কার্বন সিকোয়স্টেশন বা সংবন্ধন। এই প্রক্রিয়াটি উদ্ভিদ এবং মাটিতে বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন আহরণ এবং সংরক্ষণ করে। কার্বন-সংবন্ধন প্রাকৃতিকভাবে বন এবং তৃণভূমিতে ঘটতে পারে এবং এটি নির্দিষ্ট কৃষি অনুশীলনের (পরিবেশবান্ধব বা জৈব কৃষি) মাধ্যমেও উন্নত করা যেতে পারে। আর একটি উপায় হলো নির্গমন হ্রাস, যা বিভিন্ন কৃষি কার্যক্রমের সময় গ্রিন হাউস গ্যাসের নিঃসরণ কমানো, যেমন পশুসম্পদ লালনপালন, মাটি ব্যবস্থাপনা এবং শক্তি ব্যবহার।

গাছ রোপণ আরও একটি অনন্য উপায়। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য ফলমূল সবজিকেন্দ্রিক কৃষি বনায়ণ এতে খাদ্য চাহিদাও পূরণ হবে পাশাপাশিভাবে কার্বন সংবন্ধনও হবে। অফসেটিং নির্গমন, এতে বনায়ন (গাছ রোপণ) এবং পুনঃবনায়ন (বন উজাড় এলাকায় গাছ প্রতিস্থাপন)-এর মতো কাজ জড়িত থাকে। তবে অফসেটিংয়ের বৈশ্বিক রাজনৈতিক ব্যবহার বেশি, যার মাধ্যমে কার্বন ট্রেডিং হচ্ছে যা উন্নত বিশ্ব জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার অক্ষুণ্ন রাখছে।

ভূমি ব্যবহার পরিবর্তন বিশেষ করে বন ও অন্যান্য প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রকে কৃষি জমিতে রূপান্তর করা, যা সঞ্চিত কার্বন ছেড়ে দেয় এবং গ্রহের কার্বন শোষণ করার ক্ষমতা হ্রাস করে। আবার জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে খাদ্যের চাহিদাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই চাহিদা পূরণ করা প্রায়ই তীব্র কৃষি অনুশীলনের দিকে পরিচালিত করে, যার ফলে নির্গমন বৃদ্ধি হতে পারে। এজন্য সাকল্যে-শূন্য নির্গমন মোকাবিলায় জাতীয়ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সরকারি নীতি কৃষি-খাদ্যব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এই নীতিগুলোর মধ্যে টেকসই অনুশীলনের জন্য প্রণোদনা, কৃষি-খাদ্য থেকে নির্গমনের প্রবিধান এবং জলবায়ু লক্ষ্যমাত্রার আন্তর্জাতিক চুক্তি অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। উপযুক্ত গবেষণা ও আন্তর্জাতিক নেগোসিয়েশেন সহযোগিতা অপরিহার্য, কারণ একটি দেশের কৃষি থেকে নির্গমনের প্রভাব বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের মাধ্যমে অন্যদের প্রভাবিত করতে পারে।

কৃষি-খাদ্যব্যবস্থা থেকে সাকুল্য-শূন্য নির্গমন অর্জন করা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে লড়াই করা এবং ক্রমবর্ধমান বিশ্ব জনসংখ্যার জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এটির জন্য টেকসই কৃষি অনুশীলন, প্রাণিসম্পদ ব্যবস্থাপনা, প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবন এবং সহায়ক নীতির সমন্বয়ে একটি বহুমুখী পদ্ধতির প্রয়োজন। কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থা থেকে নির্গমন মোকাবিলার চ্যালেঞ্জ জটিল, তবে এটি এমন চ্যালেঞ্জ যা আমাদের গ্রহ এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের স্বার্থে আমাদের অবশ্যই মোকাবিলা করতে হবে। সমন্বিত উপায়ে কাজ করে কৃষি-খাদ্যব্যবস্থা থেকে সাকুল্য-শূন্য নির্গমনের লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করে আরও টেকসই এবং স্থিতিস্থাপক খাদ্য ব্যবস্থায় অবদান রাখা সম্ভব।

ড. মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন : গবেষক, বাংলাদেশ কৃষি গবেষনা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সজীব ওয়াজেদ জয়ের ৫৩তম জন্মবার্ষিকী শনিবার

ইতিহাসে এই দিনে কী ঘটেছিল?

অস্ট্রেলিয়ায় উদ্ভাবিত বিশ্বের প্রথম টাইটানিয়াম হার্ট মানবদেহে প্রতিস্থাপন

শনিবার রাজধানীর যেসব এলাকায় যাবেন না

শক্তিশালী পাসপোর্টে শীর্ষে সিঙ্গাপুর, বাংলাদেশের অবস্থান কত?

২৭ জুলাই : নামাজের সময়সূচি

যে ভুলে মরতে পারে টবের গাছ

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদে ২৪ বছর ধরে চাকরি, অতঃপর..

ঝিনাইদহে ২৪ বছর ধরে ক্রিকেট ব্যাট বানাচ্ছেন ৩ ভাই

জামালপুরে ১০ মামলায় আসামি ২৩০৫, গ্রেপ্তার ৩২

১০

আনোয়ারা পারকি সমুদ্র সৈকতে পর্যটকদের ভিড়

১১

যাত্রী পারাপার কমেছে আখাউড়া স্থলবন্দরে

১২

সিলেটে ৭ চোরাই সিএনজি অটোরিকশা উদ্ধার, গ্রেপ্তার ৭

১৩

‘সাংবা‌দি‌কের ওপর হামলা নিঃস‌ন্দে‌হে ছাত্র‌দের কাজ নয়’

১৪

রাজশাহীতে সহিংসতার মামলায় গ্রেপ্তার ১১৬৩

১৫

ছাত্রলীগের রাজনীতি ছাড়ার ঘটনা নিয়ে সারজিসের ফেসবুক স্ট্যাটাস

১৬

তিন সমন্বয়ককে আটকের কারণ জানালেন ডিবিপ্রধান

১৭

দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আল জাজিরাকে তথ্য প্রতিমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার

১৮

পাকিস্তানের বিপক্ষে রুদ্ধশ্বাস জয়ে ফাইনালে শ্রীলঙ্কা

১৯

ময়মনসিংহে শিক্ষার্থীর ওপর হামলা-মারধর

২০
X