সোমবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ২৮ আশ্বিন ১৪৩২
সালিমাহ শিবজি
প্রকাশ : ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৭:০৪ পিএম
আপডেট : ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৭:১১ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
সিবিসি নিউজ থেকে

ইমরান খানকে জেলে রেখে কেমন হবে পাকিস্তানের নির্বাচন?

পিটিআইয়ের জনসভায় ইমরান খান। ছবি: সংগৃহীত
পিটিআইয়ের জনসভায় ইমরান খান। ছবি: সংগৃহীত

ইসলামাবাদের পাহাড় ঘোরা এক রাস্তার মাথায় একটি বাড়ির পেছনের উঠানে কয়েক ডজন লোক জড়ো হয়। কয়েকটি লাল এবং সবুজ পতাকা নেড়ে একটি রাজনৈতিক সমাবেশ শুরু হওয়ার জন্য অপেক্ষা করে তারা। নির্বাচনের কয়েক দিন আগে, পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) দলে ব্যাপক ধরপাকড়ের পর এভাবেই নীরবে প্রচার চালাচ্ছে দলটি।

সমাবেশ শুরু হওয়ার অপেক্ষায় থাকা পিটিআই প্রার্থী ও পিটিআইর সাবেক আইনজীবী শোয়েব শাহীন বলেছিলেন, ‘আমি আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করছি, কিন্তু পুলিশ এবং প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমাদের বাঁধা দেওয়া হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের প্রার্থীদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে, আমাদের সমর্থক এবং তাদের ব্যবসায় ক্ষতি সাধনের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। তবে আমরা এখনো বেঁচে আছি।’

পুলিশি অভিযান ও গ্রেপ্তারের আশঙ্কায় পিটিআইয়ের অনেক নেতা-কর্মী ও প্রার্থী আত্মগোপনে চলে গেছেন। কেউ কেউ দলীয় প্রচারে সশরীরে উপস্থিত না হয়ে অজানা স্থান থেকে রেকর্ড করা ভিডিও সম্প্রচারের মাধ্যমে সমাবেশে বক্তব্য দিচ্ছেন।

তাদের নেতা, পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান কারাগারে রয়েছেন। ২০২২ সালের এপ্রিলে পার্লামেন্টে এক অনাস্থা প্রস্তাবে হেরে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন তিনি। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকেই তার নামে বিভিন্ন মামলা করা হয়। দেশের গোপন তথ্য পাচার করার অভিযোগ এনে গত কয়েকদিন আগেই ইমরান খানের ১০ বছরের জেল দেন দেশটির আদালত।

তবে পিটিআইয়ের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, ইমরান খানের বিরুদ্ধে সব মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। দলটির অভিযোগ, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে বাধা দেওয়ার উদ্দেশ্যেই ইমরানকে ১০ বছরের জেল দেওয়া হয়েছে।

ইমরান খানকে কারাগারে রেখেই নির্বাচন আয়োজন করেছে পাকিস্তানের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। আগামীকাল, (০৮ ফেব্রুয়ারি) পাকিস্তানে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

পিটিআই অভিযোগ করেছে, নির্বাচনের প্রচারে তাদের দলের বহুল ব্যবহৃত এবং জনপ্রিয় প্রতীক ক্রিকেট ব্যাট চিহ্ন ব্যবহারে নিষেধ করা হয়েছে। ক্রিকেট তারকা হিসেবে ইমরান খানের প্রাক্তন জীবনের প্রতি সম্মান জানাতে দলটি এই প্রতীকের ব্যবহার করত এবং ক্রিকেট ব্যাট প্রতীকটি জনগণের কাছেও ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। নির্বাচনী প্রচারে পিটিআইয়ের ক্রিকেট ব্যাট চিহ্নিত প্রতীক ব্যবহার বন্ধ করতে ডিক্রি জারি করা হয়েছে। যেখানে পাকিস্তানের ৪০ শতাংশ মানুষ পড়তে জানে না সেখানে এই দলীয় প্রতীক পিটিআইয়ের জন্য ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলে মনে করা হচ্ছে।

পিটিআই প্রার্থীদের স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে বাধ্য করা হচ্ছে, যা নির্বাচনে দলের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনাকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করবে। পিটিআইর বিরুদ্ধে যে কৌশলগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে কয়েক দশক ধরে পাকিস্তানের শক্তিশালী সামরিক বাহিনী নানা সময়ে এই কৌশল ব্যবহার করে এসেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, পিটিআইয়ের বিরুদ্ধে সর্বশেষ যে ধরপাকড় চালানো হয়েছে তা ছিল চরম নির্লজ্জ।

ইসলামাবাদভিত্তিক থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক ইমতিয়াজ গুল বলেন, ‘আমরা এর আগে এ রকম কিছু দেখিনি। এবারের নির্বাচন ঘিরে যেটা করা হচ্ছে তা গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণ এবং এটি হবে পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে কম বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন।’

জেল থেকে প্রচার:

পাকিস্তানে জাতীয় নির্বাচনের ঠিক এক সপ্তাহ আগে পৃথক মামলায় ইমরান খানের ১০ এবং ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অভিযোগের মধ্যে ছিল রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা ফাঁস এবং বেআইনিভাবে রাষ্ট্রীয় উপহার বিক্রির অভিযোগ। তবে ইমরান খান তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং এগুলোকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে অভিহিত করেছেন।

পিটিআই লাখ লাখ সমর্থকের কাছে ইমরান খানের বার্তা পৌঁছে দিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে জনসমর্থন বাড়াতে এবং কর্মী ও সমর্থকদের মনোবল ধরে রাখতে পিটিআই তাদের নেতার চেহারাকে কাজে লাগাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ইমরান খানের কথাগুলোকে দেশবাসীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য এআই ভয়েস জেনারেটর ব্যবহার করছে পিটিআই। বার্তাগুলো ইমরান খান কারাগারে বসে লিখছেন এবং তার আইনজীবীর মাধ্যমে দলের কাছে পাঠাচ্ছেন।

ভিডিওগুলোতে, ইমরান খান তার সমর্থকদের বৃহস্পতিবার নির্বাচনে যাওয়ার আহ্বান জানান এবং ভোটারদের তাদের স্থানীয় প্রার্থীদের খুঁজে বের করার জন্য বিস্তারিত নির্দেশনা দেন। এক ভিডিও বার্তায় ইমরান খানের ভয়েসে শোনা গেছে– ‘সাহসী হও, পরাজয়ের প্রশ্নই আসে না।’

কার পক্ষে যেতে পারে এবারের নির্বাচন:

তবে এবারের নির্বাচনে যে ব্যক্তিটি জয়ী হবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে, তিনি হলেন নওয়াজ শরিফ। ইতিমধ্যে তিনি তিনবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। নওয়াজ শরিফ ২০১৭ সালের নির্বাচনে ইমরান খানের কাছে পরাজিত হন। সেই নির্বাচনে সেনাবাহিনী প্রভাব রেখেছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু ছক ঘুরে গেছে— আবারও সেনাবাহিনীর সহায়তাতেই নওয়াজ শরিফ ক্ষমতায় বসতে যাচ্ছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ দুর্নীতির মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন এবং নির্বাচনে তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল আদালত। কিন্তু সেই নিষেধাজ্ঞা বাতিল করে এই নির্বাচনে তার বিজয়ের পথ পরিষ্কারে কাজ করছে সেনাবাহিনী। বিশ্লেষকরা বলছেন, সেনা জেনারেলদের সাথে দরজার অন্তরালে চুক্তি হয়েছে নওয়াজ শরিফের।

ভোটের দিন ঘিরে হতাশা:

পাকিস্তানে একটি জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে যে উৎসাহ উদ্দীপনা দেখা যায় এবারের নির্বাচনে তেমন কিছুই চোখে পড়েনি। অনেকে মনে করছেন, নির্বাচনের ফল পূর্বনির্ধারিত। এজন্য তারা নির্বাচনকে ঘিরে কোনো আশা দেখছেন না।

ইসলামাবাদের প্রাচীনতম বাজারগুলোর একটি হলো আবপাড়া। এই বাজারের একজন সুগন্ধির দোকানের মালিক বলছিলেন, ‘আমার জীবনে এটিই প্রথম নির্বাচন যেখানে নির্বাচনের কোনো কার্যকলাপ বা জনসাধারণের কোনো আগ্রহ দেখেছি না।’ তিনি পিটিআই এবং পিএমএলএনকে উল্লেখ করে বলেন, ‘এটা কোনো নির্বাচন নয়, একটি সাজানো ফল দেখানো হবে। একটি দলকে নিয়মিত সব ধরনের হয়রানি এবং শাস্তি দেওয়া হচ্ছে এবং অন্য দলকে প্রোটোকল দেওয়া হচ্ছে।’

মঙ্গলবার প্রকাশিত এক জরিপ যেন তেমন চিত্রই প্রকাশ করে। জরিপে দেখা গেছে, যেখানে ১০ জনের মধ্যে ৭ জনই পাকিস্তানের নির্বাচন সাজানো বলে মন্তব্য করেছেন। তারা বলেছেন, নির্বাচনের সুষ্ঠুতার প্রতি তাদের বিশ্বাস নেই। জরিপে ৭০ শতাংশ মানুষ বলেছেন তাদের এলাকার অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হচ্ছে।

৪৬ বছর বয়সী তাহসিন আনজুম হতাশা প্রকাশ করে বলেন, নির্বাচনের প্রতি তারা কোনো আগ্রহ পাচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘দেশের রাজনীতিকে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। আমি এই নির্বাচনকে বিশ্বাস করি না, এটা সুষ্ঠু কোনো লড়াই নয়। কিন্তু তবুও আমি বৃহস্পতিবার নির্বাচনে ভোট দেব।’ তিনি বলেন, ‘আমরা যাকে ভোট দিতাম, সে জেলে আছে।’

সালিমাহ শিবজি : মুম্বাইভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সিবিসির দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সংবাদদাতা। তিনি প্রায় দুই দশক ধরে CBC-তে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং বিশ্বজুড়ে দুর্নীতি ও সংঘর্ষের সংবাদ কাভার করছেন।

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

নিউমার্কেটে চুরির কাজে ব্যবহৃত সরঞ্জাম, নগদ টাকাসহ গ্রেপ্তার ১

আন্দোলনরত শিক্ষকদের ছত্রভঙ্গ করায় ছাত্রশিবিরের নিন্দা

শিক্ষকদের আন্দোলন নিয়ে ইউনিভার্সিটি টিচার্স লিংকের বিবৃতি

কক্সবাজার আদালতে বিচারকের মোবাইল-মানিব্যাগ চুরি

পাঠ্যপুস্তক ছাপার দায়িত্ব হস্তান্তর ‘মাথাব্যথায় মাথা কাটার মতো সিদ্ধান্ত’ : টিআইবি

বিশ্বকাপে ইতিহাস গড়ে ভারতকে হারাল অস্ট্রেলিয়া

মৌসুমি বায়ুসহ আগামী ৪ দিনের আবহাওয়ার পূর্বাভাস

চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা

এবার উপদেষ্টাদের নিয়ে মুখ খুললেন সামান্তা শারমিন

ঢাকায় আসছেন জাকির নায়েক

১০

ছক্কা মেরে ইতিহাস গড়লেন স্মৃতি মান্ধানা!

১১

উপদেষ্টা রিজওয়ানাকে এনসিপি নেতার হুঁশিয়ারি

১২

একটি দল ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চায় : কফিল উদ্দিন 

১৩

চাকসু নির্বাচনে নতুন প্রত্যয়ে ছাত্রদল

১৪

বন্দর ব্যবসায়ী নেতারা / মাশুল বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত চট্টগ্রাম বন্দর বন্ধের ষড়যন্ত্রের অংশ

১৫

ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি নিয়ে ৬ হাজারের বেশি মতামত পেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়

১৬

জুলাইয়ের গাদ্দারদের সব রেকর্ড প্রকাশ করা হবে : মুনতাসির

১৭

যে ছয় ফিলিস্তিনি বন্দিকে ছাড়তে রাজি নয় ইসরায়েল

১৮

ময়মনসিংহে পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহার

১৯

ধানের শীষের বিজয় মানেই জনগণের মুক্তি : গয়েশ্বর চন্দ্র রায়

২০
X