বৃহস্পতিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ৩ আশ্বিন ১৪৩২
হুজ্জাতুল্লাহ জিয়া
প্রকাশ : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৬:৩১ পিএম
আপডেট : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৬:৪৮ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
আলজাজিরা থেকে

ইতিবাচক প্রচারণা আফগানিস্তান সম্পর্কে ধারণা বদলে দেবে

ইতিবাচক প্রচারণা আফগানিস্তান সম্পর্কে ধারণা বদলে দেবে। ছবি : সংগৃহীত
ইতিবাচক প্রচারণা আফগানিস্তান সম্পর্কে ধারণা বদলে দেবে। ছবি : সংগৃহীত

আজকাল আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের শিরোনাম থেকে যেন আড়ালে পড়ে গেছে আফগানিস্তান। দেশটির সম্পর্কে যে দু-একটা সংবাদ প্রকাশিত হয় সেখানেও ইতিবাচক কিছু দেখানো হয়েছে বলে চোখে পড়ে না। বরং শুধু ট্র্যাজেডিগুলোই প্রচার করা হয়। দেখানো হয় একটি মানবিক সংকটের আফগানিস্তান, একটি ভূমিকম্প, একটি বোমা হামলা বা বন্দুকযুদ্ধ, একটি খরা এবং উদ্বাস্তুদের দুর্ভোগ। আর এসব সংবাদের আড়ালে আফগানিস্তানের ইতিবাচক গল্পগুলো হারিয়ে যায়।

আফগানিস্তানের অনেক তরুণ মনে করেন, তাদের দেশ একটি কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তবে এই কঠিন সময়ের মধ্যেও তারা হতাশ নন, বরং আশার আলো দেখছেন। এরকমই একজন আফগান তরুণ হুজ্জাতুল্লাহ জিয়া। তিনি আফগানিস্তানের একটি ইংরেজি ভাষার সংবাদমাধ্যমে কাজ করতেন। হুজ্জাতুল্লাহ মনে করেন, ইতিবাচক প্রচারণা আফগানিস্তানে সম্পর্কে বিশ্ববাসীর ধারণা বদলে দেবে। আলজাজিরায় প্রকাশিত তার নিবন্ধটি কালবেলার পাঠকদের সামনে তুলে ধরা হলো –

‘ডেইলি আউটলুক আফগানিস্তানে’র একজন সংবাদকর্মী হিসেবে কাজ করতাম আমি। এটি দেশের প্রথম ইংরেজি ভাষার মিডিয়া আউটলেট। আমাদের ছোট্ট নিউজরুমে বসে আমরা দেখি, আমাদের দেশের খারাপ খবরগুলোই শুধু প্রচার করা হয় বিশ্ববাসীর সামনে। ক্রমাগত এই খারাপ খবর দেখার ফলে মানুষের কাছে আফগানিস্তান সম্পর্কে নেতিবাচক মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব পড়ে। মানুষ মনে করে আফগানিস্তান একটি অন্ধকার দেশ। আমাদের দেশে যে হাজারটা সম্ভাবনা রয়েছে, আশার আলো রয়েছে মানুষ তা জানতে পারে না।

নেতিবাচক খবরের যে কালো চাদরে আফগানিস্তানকে ঢেকে দেওয়া হয়েছে আমরা তা মোকাবিলা করার চেষ্টা করি। আমরা আমাদের নিয়মিত কভারেজের পাশাপাশি ইতিবাচক গল্পগুলো খুঁজতে শুরু করি। আমরা ইতিবাচক গল্পগুলো প্রচার করতে চাই এবং বিশ্ববাসীকে দেখাতে চাই আফগানিস্তান এখনও একটি সম্ভাবনার দেশ।

আফগানিস্তানে ডেইলি আউটলুকের প্রচার আর নেই। ২০২১ সালে তালেবান কাবুল দখলের পরপরই অন্যান্য অনেক মিডিয়ার মতো এই সংবাদপত্রটিও বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। আমার বেশিরভাগ সহকর্মী প্রতিবেশী ইরান ও পাকিস্তানে পালিয়ে যায়। সেই বছরের ২৬ আগস্ট কাবুল বিমানবন্দরে এক বোমা হামলায় তাদের একজন আলিরেজা আহমাদি মর্মান্তিকভাবে মারা যান। ক্ষোভ এবং দুঃখ নিয়ে সেসব সাংবাদিকদের অনেকেই আর আফগানিস্তানের জন্য কাজ করতে আগ্রহী হননি। ফলে এখন আরও কম সাংবাদিক ইতিবাচক আফগানিস্তানের গল্প খুঁজছেন।

নিয়তির অন্ধকার ফাঁদে পড়েছিলাম আমি নিজেও। আমি সবসময় আমার দেশের সম্ভাবনা এবং ইতিবাচক দিকগুলো খুঁজতাম। রাজনৈতিক বিষয়গুলোকেও ইতিবাচক চোখে দেখার এবং বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করতাম। দুই দশকের যুদ্ধ ও সহিংসতার মধ্যেও পাঠকদের মধ্যে আমি আশা জাগানোর চেষ্টা করেছি। তবে আমার অফিস বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আমি বেকার হয়ে পড়ি এবং হতাশার অন্ধকারে ডুবে যেতে শুরু করি। জীবন রাতারাতি খুব কঠিন হয়ে যায় আমার জন্য। আমি আমার পরিবারের ভরণপোষণের জন্য সংগ্রাম করছিলাম। আমার কাছে সেসময় সবকিছু অর্থহীন মনে হয়েছিল।

আমি আমার মহিলা আত্মীয়দের কাছ থেকে প্রায়ই তালেবান শাসনের অধীনে তাদের সংগ্রাম এবং মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার ওপর নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে অভিযোগ শুনেছি। এটি আমাকে দুঃখ দিয়েছে এবং শুধু আমার যন্ত্রণা বাড়িয়েছে। আমি তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেছি।

এভাবে কেটে যায় কয়েকমাস। আমি ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করি, সান্ত্বনার কথার চেয়ে আরও অনেক বেশি কিছু দিতে পারি আমি। যেমন একটি চীনা প্রবাদ আছে : ‘অন্ধকারকে অভিশাপ দেওয়ার চেয়ে একটি মোমবাতি জ্বালানো ভালো’। ইংরেজি ভাষার শিক্ষক হিসেবে আমার অনেক দিনের অভিজ্ঞতা ছিল। আমি এটিকে কাজে লাগাতে চাই। আমি দেশের সাক্ষরতা বৃদ্ধি ও ইংরেজি শিক্ষা নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিই। আফগানিস্তানজুড়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করা শুরু করি আমি।

এই কাজে যুক্ত হয়ে আমি এমন অনেককে খুঁজে পেয়েছি যারা এই কঠিন সময়ে দেশের তরুণ প্রজন্মের জন্য কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এমন অনেককে খুঁজে পেয়েছি যারা দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ইতিবাচক ভূমিকা পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরা কয়েকজনে কাবুলের পশ্চিমাঞ্চলের দাশত-ই-বারচিতে ইংরেজি শেখানোর জন্য একটি প্রাইভেট একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেছি।

আমাদের কারও কাছেই কোনো জমানো টাকা ছিল না। তাই আমাদের বন্ধুদের কাছ থেকে ধার নিতে হয়েছে। আমরা একটি বিল্ডিং ভাড়া নিয়েছি এবং ডেস্ক, চেয়ারসহ প্রয়োজনীয় সব সরঞ্জাম দিয়ে সেটি একটি স্কুল হিসেবে তৈরি করেছি। আমরা একটি সিলেবাস তৈরি করেছি এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে নিবন্ধন নিয়েছি।

আফগানিস্তানে মেয়েদের মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবে মেয়েরা এখনও বেসরকারি শিক্ষাকেন্দ্রে পড়ার অনুমতি পায়। তাই আমাদের একাডেমিতে আমরা ছেলে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি মেয়েদেরও পড়াশোনার সুযোগ করে দিয়েছি। আমরা আইনি দিকগুলো মেনে চলি এবং মেয়ে ও ছেলে শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা ক্লাসরুমের ব্যবস্থা করেছি। কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অনুযায়ী আমরা ক্লাসে মেয়ে শিক্ষার্থীকে ইসলামিক হিজাব পরা নিশ্চিত করেছি।

আমরা লক্ষ্য করেছি শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার প্রতি অনেক আগ্রহী। তারা পড়াশোনা করতে চায় এবং ইংরেজি শিখতে চায়। তারা নিয়মিত একাডেমিতে আসার জন্য অত্যন্ত উৎসাহী এবং আন্তরিক। সম্প্রতি এক সড়ক দুর্ঘটনায় পড়ে আমাদের একজন শিক্ষার্থী। একটি রিকশা তার মোটরবাইকে ধাক্কা দিলে তার আঙুলে গুরুতর আঘাত লাগে। তার আঙুলে অস্ত্রোপচার করা হয়। আমরা আশ্চর্য হই যখন সে আঙুলে অস্ত্রোপচার করে সেদিনই ক্লাসে উপস্থিত হয়।

১৬ বছর বয়সী একটি মেয়ে দর্জির দোকানে কাজ করে। সেখান থেকে পরিবারের ভরণপোষণের জন্য সামান্য বেতন পায় সে। মেয়েটি ইংরেজি শেখার জন্য অত্যন্ত আগ্রহী কিন্তু পড়াশোনা করার মতো সামর্থ্য নেই, তাই আমরা তাকে বিনা বেতনে আমাদের একাডেমিতে যোগ দেওয়ার সুযোগ দিয়েছি। বই এবং উপকরণের খরচ মেটাতে প্রতিদিন সে তার বেতন থেকে ১০ রুপি আলাদা করে রাখে।

আমি আমার একাডেমির দিকে তাকাই এবং আফসোস করি যদি এই স্কুলটি আমি আরও আগে শুরু করতে পারতাম। আমি হতাশার মধ্যে ডুবে গিয়েছিলাম এবং দুই বছর সময় নষ্ট করেছি। আমরা যদি আরও আগে শুরু করতে পারতাম, তাহলে আরও অনেক ছেলেমেয়েকে আমরা তাদের শিক্ষার স্বপ্নপূরণের পথে সাহায্য করতে পারতাম। আমি অনুশোচনা অনুভব করি। কয়েক বছর আগে আমি যে ছাত্রছাত্রীদের পড়িয়েছিলাম তাদের মধ্যে কেউ কেউ এখন ভারত, বাংলাদেশ, কিরগিজস্তান, ফ্রান্স এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে গিয়ে পড়াশোনা করছে। আমি খুশি, আমি হতাশাকে ঝেড়ে ফেলে আশাকে আলিঙ্গন করেছি। আমি আমার ছাত্রদের উৎসাহ দিই এবং তাদের আশাবাদী করে তোলার চেষ্টা করি। আমি আফগানিস্তানে সম্ভাবনা দেখি। আফগানিস্তানে আমার মতো অনেক তরুণ আশার আলো দেখে।

আমাদের হাজারো ইতিবাচক গল্প রয়েছে। সেই গল্পগুলো বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরা দরকার। ইতিবাচক প্রচারণা আফগানিস্তানে সম্পর্কে বিশ্ববাসীর ধারণা বদলে দেবে।

হুজ্জাতুল্লাহ জিয়া : ডেইলি আউটলুক- আফগানিস্তানের সাবেক সাংবাদিক

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

এশিয়া কাপে পাকিস্তান ওপেনারের লজ্জার রেকর্ড

চট্টগ্রামে আ.লীগ কর্মীদের বাসা ভাড়া না দিতে মাইকিং

ভারতে ‘মস্তিষ্কখেকো অ্যামিবা’ সংক্রমণে ১৯ জনের মৃত্যু

বনানীতে দুই শিসা বারে ডিএনসির অভিযান

বয়কটের হুমকি দিয়েও না করার কারণ জানালেন পিসিবি প্রধান

কর্মচারী দিয়ে ক্লাস-পরীক্ষা পরিচালনার অভিযোগ

শাহীন ঝড়ে বাঁচা-মরার ম্যাচে লড়াকু সংগ্রহ পাকিস্তানের

‘গোলাপী খালার’ পাশে দাঁড়ালেন তারেক রহমান

পরাজিত শক্তির সঙ্গে আঁতাতের রাজনীতি মঙ্গলজনক হবে না: নীরব

চট্টগ্রামে মার্কিন বিমান ও সেনা উপস্থিতি নিয়ে সমালোচনার কারণ কী?

১০

রাকসু নির্বাচন / ভোটকেন্দ্র সিসি ক্যামেরার আওতায় আনাসহ ৭ দফা দাবি ছাত্রশিবিরের

১১

দীর্ঘ ৬ বছর পর বুটেক্সে ক্যারিয়ার ফেয়ার অনুষ্ঠিত

১২

ফ্যাসিবাদের মতো তামাকও দেশ থেকে নির্মূল করতে হবে : ফরিদা আখতার

১৩

ছাত্র সংসদ আর জাতীয় নির্বাচন এক নয় : টুকু

১৪

বৃহস্পতিবার থেকে ৫ দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনে ৭ দল

১৫

কনটেইনারে ছিদ্র, তেল নিতে কাড়াকাড়ি

১৬

ইউরোপীয় পার্লামেন্টের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বিএনপির বৈঠক 

১৭

পিআর পদ্ধতি চাই না : দুদু

১৮

শ্রমিক দল নেতাকে আজীবন বহিষ্কার

১৯

প্রাথমিকে সংগীত শিক্ষক নিয়োগ বাতিলের দাবি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত : আসক

২০
X