ফ্রান্সে ‘বিপজ্জনক’ বিবেচিত বিদেশি অভিবাসীদের ডিটেনশন সেন্টারে দীর্ঘ মেয়াদে আটক রাখার বিধান এক রায়ে বাতিল করে দিয়েছে দেশটির সাংবিধানিক কাউন্সিল তথা লো কনসেই কনস্টিটিউসিওনেল।
বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) দেওয়া এক রায়ে এ কথা বলেছে সাংবিধানিক কাউন্সিল। এই আদালত মূলত ফরাসি সংসদ যেসব আইন পাস করে, সেগুলো সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না, তা খতিয়ে দেখে।
নতুন এই আইন অনুযায়ী, যেসব বিদেশি নাগরিক গুরুতর অপরাধে দণ্ডিত হয়েছেন বা যারা জননিরাপত্তার জন্য ‘বিশেষভাবে বিপজ্জনক’ বলে বিবেচিত তাদের ৯০ দিনের বদলে ২১০ দিন পর্যন্ত সিআরএতে আটক রাখার বিধান রাখা হয়েছিল।
তবে সাংবিধানিক কাউন্সিল বলছে, এটি অনুপযোগী এবং সংবিধান লঙ্ঘনকারী সিদ্ধান্ত।
সাংবিধানিক কাউন্সিলের এমন রায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রুনো রোতাইয়োর জন্য বড় ধাক্কা। এই রক্ষণশীল রাজনীতিবিদ দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই আটকাদেশ বাড়ানোর পক্ষে পদক্ষেপ নিয়েছেন।
বামপন্থি আইনপ্রণেতাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি সাংবিধানিক কাউন্সিলে তোলা হয়।
আদালতের রায়ে বলা হয়, যেসব ব্যক্তি দীর্ঘমেয়াদে আটক রাখার আওতায় পড়তেন, তাদের ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থা অনুপযুক্ত এবং অনিয়মিত অভিবাসন নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য পূরণে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
বর্তমানে ২১০ দিন পর্যন্ত আটকের বিধান শুধু সন্ত্রাসবাদে দণ্ডিতদের জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু নতুন আইন অনুযায়ী এটি মাদক পাচার, ধর্ষণ, হত্যা বা সহিংস চুরির মতো অপরাধে দণ্ডিত অভিবাসীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হওয়ার কথা ছিল।
সংবিধানিক কাউন্সিল মনে করিয়ে দেয়, ‘কোনো বিদেশি নাগরিক যদি সঙ্গে সঙ্গে ফ্রান্স ছেড়ে যেতে না পারেন, তাহলে তাকে আটক রাখার সিদ্ধান্ত এমনভাবে নিতে হতে হবে, যাতে তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা অযৌক্তিকভাবে সীমিত না হয়।’
অথচ নতুন আইন অনুযায়ী, এমন অনেক অপরাধের ক্ষেত্রেও আটক প্রযোজ্য হতো, যেগুলো ‘বিশেষভাবে গুরুতর’ নয়। এমনকি এমন অভিবাসীরাও এই আইনের আওতায় পড়তেন, যারা ইতোমধ্যে তাদের সাজা ভোগ করেছেন এবং আর কোনো সক্রিয় হুমকি বহন করেন না।
এদিকে ফ্রান্সের অভিবাসীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংস্থা লা সিমাদ এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে।
সংস্থাটির সেক্রেটারি জেনারেল ফানেলি কারে-কন্তে বলেন, ‘এই সিদ্ধান্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং যারা এই আইনটি পাস করেছিলেন, তাদের জন্য একটি সতর্কবার্তা। একটি আইনের মাধ্যমে মানুষকে স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই আইনে একটি কঠোর নিরাপত্তামূলক নীতির পথে যাওয়া হচ্ছিল, যা ছিল অকার্যকর এবং মানবাধিকারের পরিপন্থি৷’
তবে ডানপন্থি রাজনীতিবিদদের মতে এই সিদ্ধান্ত ‘জননিরাপত্তাকে দুর্বল করছে৷’
ফরাসি সংসদের রক্ষণশীল এলআর দলের নেতা লরো ওয়াকিয়েজ বলেন, ‘আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোয় ১৮ মাস পর্যন্ত আটক রাখা যায়। কিন্তু ফ্রান্সে এখনো ৯০ দিনের বেশি আটকের অনুমতি নেই। সংবিধানিক কাউন্সিল ফরাসিদের আর রক্ষা করছে না৷’
একই সঙ্গে কিছু সংসদ সদস্য এই রায়কে ‘অদায়িত্বপূর্ণ এবং ইউরোপীয় মানদণ্ডের বাইরে’ বলেও অভিহিত করেছেন।
বহাল কিছু ধারা
আইনের যেসব ধারা সংবিধানিক কাউন্সিল বাতিল করেনি, তার মধ্যে রয়েছে আটকের সময় অভিবাসীর সম্মতি ছাড়া আঙুলের ছাপ ও ছবি নেওয়ার অনুমতি।
এই বিতর্কিত আইনটি পাস করানোর জন্য শুরু থেকেই সরব ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রুনো রোতাইয়ো৷ ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে প্যারিসে এক শিক্ষার্থীকে হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তি ছিলেন এক মরক্কোর নাগরিক৷ যিনি কয়েক বছর জেল খাটার পর ডিটেনশন সেন্টার থেকে সদ্য মুক্তি পেয়েছিলেন এবং যার বিরুদ্ধে ফ্রান্স ছাড়ার নির্দেশ ছিল।
এ ঘটনার পর থেকেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অভিবাসন-সংক্রান্ত আইন কঠোর করার পক্ষে অবস্থান নেন।
তিনি বলেছিলেন, ‘সবচেয়ে গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে আমাদের হাত-পা কাঁপা উচিত নয়। আমাদের ১৮০ দিন, এমনকি ২১০ দিন পর্যন্ত আটকের ক্ষমতা থাকা দরকার।’
২০২৪ সালে ফ্রান্সজুড়ে মোট ২৫টি প্রশাসনিক আটক কেন্দ্রে (সিআরএ) ৪০ হাজার ৫৯২ জন অভিবাসীকে আটক রাখা হয়। ২০২৩ সালে সংখ্যাটি ছিল ৪৬ হাজার ৯৫৫ জন।
গত বছর ফ্রান্সের মূল ভূখণ্ডে সিআরএ-গুলোয় গড়ে অভিবাসীদের ৩৩ দিন করে আটক রাখা হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় কিছুটা বেশি।
১৯৯৩ সালে প্রথমবারের মতো অনিয়মিত অভিবাসীদের মাত্র ১০ দিনের জন্য আটক রাখার বিধান চালু হয়েছিল। এরপর ২০১৮ সালের আইন অনুযায়ী সেটি ৯০ দিন করা হয়। সন্ত্রাসবাদে জড়িতদের ক্ষেত্রে সেটি ২১০ দিন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল।
সূত্র : ইনফোমাইগ্র্যান্টস
মন্তব্য করুন