

ইডেন গার্ডেন্সে রোববার বিকেলের সেই নিস্তব্ধতা ভারতের সাম্প্রতিক টেস্ট ইতিহাসে নতুন এক মোড়কে পরিণত হবে—এমন সংকেত আগেই মিলেছিল। কিন্তু কেউ ভাবেনি, ১২৪ রানের তুচ্ছ লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে এতটা বিপর্যস্ত হবে স্বাগতিকরা। কেশব মহারাজের দ্বিতীয় আঘাত যখন মোহাম্মদ সিরাজের উইকেট ছুঁয়ে দিল, তখন কলকাতা বুঝল—ভারতের ‘অদম্য ঘরের রাজত্ব’ আর সেই অভেদ্য দেয়াল হয়ে নেই।
দিনের শুরুতে চাপ ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার উপরই—মাত্র ৬৩ রানের লিড, হাতে তিন উইকেট। কিন্তু টেম্বা বাভুমা সেটাই পাল্টে দিলেন একাই। বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ঐতিহাসিক শিরোপা জেতানোর পর এটাই ছিল তার প্রথম টেস্ট, আর ঠিক সেখানেই তিনি দেখালেন কেন তাকে বলা হয় ‘ব্যাটিং-মনস্তত্ত্বের মাস্টার’।
একটি অর্ধশতক, এর চেয়েও বেশি—খেলার গতিপথ নিয়ন্ত্রণের চমৎকার ক্ষমতা। বাভুমা কষে দেন অতিরিক্ত ৬০ রান, ভারতের সামনে লক্ষ্য দাঁড়ায় ১২৪।
যা একসময় ‘সাধারণ রুটিন চেজ’ ছিল, তা ইডেনে পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে।
চেজ শুরু হতেই মার্কো ইয়ানসেন দুই ওপেনারকে ফিরিয়ে ভারতকে চাপে ঠেলে দেন। লাঞ্চের পর ওয়াশিংটন সুন্দর ও রবীন্দ্র জাডেজা সাময়িক প্রতিরোধ গড়লেও সেটি টিকল সামান্য সময়। প্রথম ইনিংসে চার উইকেট নেওয়া সাইমন হারমার ফের আঘাত করেন, এরপরই ধস।
অভিষেক মৌসুমে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা ধ্রুব জুরেল লড়াই করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু ফাঁকা স্কোরবোর্ডের চাপে তাকেও থামতে হয়। এরপর ঋষভ পান্তের অস্থিরতা আর নির্ভরতার অভাব আরও স্পষ্ট হয়।
শেষ আলোটা জ্বালিয়েছিলেন অক্ষর প্যাটেল—দুটি ছক্কায় আশা দেখালেও তাকে শেষ পর্যন্ত মহারাজই থামান। স্কোরবোর্ড তখন বলে দিচ্ছে: ভারত অলআউট ৯৩, ৩৫ ওভারেই।
১৯৭৭ সালের পর থেকে ঘরের মাঠে ভারত কখনও ১০০ রানের নিচে চতুর্থ ইনিংসে অলআউট হয়নি—এদিন তা ভেঙে চুরমার। ২০০৬-এ মুম্বাইতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ভারতের সর্বনিম্ন ছিল তিন অঙ্কই। আরও পেছনে গেলে ১৯৭৭-এ চেন্নাইয়ে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৮৩ ছিল রেকর্ড।
সেই পরিসংখ্যানেও নতুন লজ্জার দাগ যোগ হলো।
কেবল এক বছর আগেও ভারতে এসে টেস্ট সিরিজ জেতা ছিল ‘অসম্ভব মিশন’। ২০১২-এর পর থেকে টানা ৪২ জয়, মাত্র চার হারের ইতিহাস—এমন আধিপত্যই বিশ্ব ক্রিকেটে ভারতের ঘরের-রাজত্বকে কিংবদন্তির পর্যায়ে নিয়ে যায়।
কিন্তু নভেম্বর ২০২৪-এ নিউজিল্যান্ডের ৩-০ হোয়াইটওয়াশ সেই সাম্রাজ্যে প্রথম ফাটল তোলে। তার পরিধি বাড়ল ইডেনে—ছয় টেস্টে ভারতের চতুর্থ হার।
দ্বিতীয় সর্বনিম্ন লক্ষ্য রক্ষা করে ভারতে টেস্ট জেতা—এত বড় অর্জনের পর বাভুমার ব্যক্তিগত রেকর্ড আরও উজ্জ্বল হলো। ১১ টেস্টে তার নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকার ১০ জয়, ১ ড্র। দক্ষিণ আফ্রিকার টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে তিনি এখন গ্রায়েম স্মিথ, হ্যানসি ক্রোনিয়ে, ফাফ ডু প্লেসিস ও শন পোলকের পরেই।
দিনটি শুরু হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার দুশ্চিন্তায়। শেষটা হলো ভারতের আত্মসমালোচনায়। ইডেন গার্ডেন্সের স্ট্যান্ডগুলো যতটা নীরব, তার চেয়েও নীরব ভারতীয় ড্রেসিংরুমের ভাবনা— কোথায় হারিয়ে গেল অতুলনীয় ঘরের অজেয়তা? নতুন যুগের দল কি মানিয়ে নিতে পারছে না?
ইডেনের এই ধাক্কা হয়তো শুধু একটি পরাজয় নয়—ভারতের টেস্ট ইতিহাসে নতুন বাস্তবতার দরজা।
মন্তব্য করুন