

লিওনেল মেসি যখন আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে মাঠে নামতেন, পুরো ফুটবল বিশ্বের চোখেই থাকত সেই মুহূর্তগুলো। হাসি, কান্না, বঞ্চনা ও উৎসমুখরতার সন্ধিক্ষণ—সবই মিশে আছে কাহিনিতে। আর্জেন্টাইন সংবাদমাধ্যম টিওআইস স্পোর্টসের লাউতারো আলভারেজের রচনাকে ভিত্তি করে মেসির আর্জেন্টাইন মঞ্চে যেসব মুহূর্তগুলো সবচেয়ে গভীর ছাপ ফেলেছে, সেগুলো কালবেলার পাঠকের জন্য নিচে সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো।
১) দেশের মাটিতে প্রথম ম্যাচ—যাত্রার সূচনা (৯ অক্টোবর ২০০৫)
জার্মানি বিশ্বকাপ বাছাইয়ের সেই ম্যাচে আর্জেন্টিনা পেরুকে ২-০ গোলে হারায়; মেসি পুরো ৯০ মিনিট খেলেন এবং রোমান রিকেলমেকে এক পেনাল্টি পাস থেকে গোল করান। দেশে তার প্রথম বড় মঞ্চ—এটাই ছিল জাতীয় দলের সঙ্গে তার দীর্ঘ যাত্রার শুরু।
২) আর্জেন্টিনার মাটিতে প্রথম গোল—দেশের মায়া (১১ অক্টোবর ২০০৮)
সাউথ আফ্রিকা বিশ্বকাপ বাছাইয়ে উরুগুয়ের বিরুদ্ধে পেনাল্টিতে গোল করেন তিনি। এই গোল তার আর্জেন্টিনার মাটিতে প্রথম গোল। আর্জেন্টাইন ভক্তদের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠতার সূচনা হয়েছে এখান থেকেই।
৩) ২০১১ কোপা আমেরিকায় বিক্ষুব্ধ ঢেউ
২০১১ সালে ঘরের মাটিতে কোপায় আর্জেন্টিনার মাঝেমধ্যে খারাপ ফল ও সমর্থকের তির্যক প্রতিক্রিয়া ছিল লক্ষণীয়—কখনো গোঁসা, কখনো বকুনি। বিশেষত সান্তা ফে এলাকায় উরুগুয়ের হাতে পরাজয়ের পর দর্শকদের তিরস্কার মেসিরও ওপর চাপ হিসেবে দাঁড়ায়।
৪) সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত (২০১৬)
প্রেস নিয়ে বিতর্কের পর পুরো দল—মেসি ও কোচসহ—নির্দিষ্ট কিছু সংবাদমাধ্যম বয়কট করেন। মেসি বলেছিলেন, অনাবশ্যক চর্চা আর অপপ্রচারের বিরুদ্ধে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি ছিল।
৫) ২০১৭: ভেনেজুয়েলার সঙ্গে ড্র ও মাঠের টিপ্পনী
রিভার প্লেটে ভেনেজুয়েলার বিপক্ষে ১-১ গোলে ড্র—এমন ফল আর্জেন্টিনার জন্য বিপদের ঘণ্টা বাজিয়েছে; ম্যাচ শেষে দর্শকদের ক্ষোভ উপড়ে পড়ে মেসিদের ওপর।
৬) দেশের হয়ে ট্রফি জয়ের পর আবেগঘন কান্না (কোপা আমেরিকা ২০২১)
দীর্ঘ ২৮ বছরের অপেক্ষার পর ২০২১ কোপা আমেরিকা জয়ে মেসির প্রথম আন্তর্জাতিক বড় শিরোপা আসে। মেসির সেই কান্নার মুহূর্ত এখনো ভক্তদের চোখে ভাসে।
৭) বিশ্বজয় পরের উৎসব (২০২৩)
কাতার বিশ্বকাপ জয়ের পর দেশের মাঠে আতশবাজি, মিছিলে ভক্তদের সঙ্গে মেসির উদযাপন সবই হয় ২০২৩ সালের মার্চে প্যানামার বিরুদ্ধে প্রীতি ম্যাচে। মেসি তার ৮০০তম গোলও পূর্ণ করেন সেদিন; সমর্থকদের সঙ্গে আনন্দঘন সম্মিলন ছিল অনন্য।
৮) ছায়া ছাড়া এক দল—ব্রাজিলকে ৪-১ জয় (মেসি অনুপস্থিত)
মেসি অনুপস্থিত থাকলেও আর্জেন্টিনা ব্রাজিলকে ৪-১ গোলে বিধ্বস্ত করে দেখিয়েছে দলটি কতটা আত্মনির্ভরশীল; একটি প্রতীকী মুহূর্ত যা বোঝায় দলে মেসির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা কমে আসছে।
৯) কলম্বিয়ার বিরুদ্ধে স্বেচ্ছায় বদলি ও যুগের অবসান (১০ জুন)
কলম্বিয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচে মেসি নিজের ইচ্ছায় বদলি নেন—এটি ছিল এমন এক মুহূর্ত যা দেখিয়ে দেয় যে মেসির শরীর আর সায় দিচ্ছে না। আর মেসি কম খেললেও দল এখন তার ছাড়া খেলতে শেখাচ্ছে; এটিও এক যুগ বদলের সংকেতও বটে।
১০) আর্জেন্টিনার হয়ে তার শেষ গোল (১৫ অক্টোবর ২০২৪)
গত বছরের ১৫ অক্টোবর বলিভিয়ার বিপক্ষে হ্যাটট্রিক ও দুটি অ্যাসিস্ট করেন তিনি। সেটিই আর্জেন্টিনার জার্সিতে তার সর্বশেষ গোল।
মেসি আর আর্জেন্টিনা—এই বন্ধনটা ছিল প্রেম ও দ্বন্দ্বের মিশেল; কখনো অতুলনীয় আনন্দ, কখনো গ্লানি ও চাপ। ৪৯টি হোম ম্যাচে ৩৫ গোল, ১৯ অ্যাসিস্ট—সংখ্যাগুলোই একটা গল্প বলে, কিন্তু আসল গল্পটা হলো মাঠে তৈরি করা অনুভূতি: কাঁদা, হাসি, অভিযোগ, উৎসব—সব মিলিয়ে এক লম্বা সম্পর্ক।
আজকের ম্যাচ (ভেনেজুয়েলার বিপক্ষে) হয়তো তাৎক্ষণিকভাবে একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি, কিন্তু মেসি যে ছেড়েছেন বা রেখে যাচ্ছেন—সেগুলো অনেক দিন ভাবনায় রাখবে আর্জেন্টিনার ফুটবলপ্রেমীরা।
মন্তব্য করুন