গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে অভিন্ন পারিবারিক আইনের জন্য আন্দোলন চলছে। জেন্ডার ইস্যু রাষ্ট্রীয় নীতির অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে নারীর মনোজগতে একটা বড় পরিবর্তন এসেছে।
আন্তর্জাতিক সিডও দিবস উপলক্ষে আজ রোববার (৩ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ আয়োজিত ‘অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়ন : নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ বাস্তবায়ন’-বিষয়ক আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে এসব কথা বলেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম। রোববার বেলা সাড়ে ৩টায় সংগঠনের আনোয়ারা বেগম মুনিরা খান মিলনায়তনে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
তিনি বলেন, সমাজে নারী বিদ্বেষের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, আইনের প্রয়োগ হচ্ছে না, সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটেছে, নারীর বিরুদ্ধে ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। অভিন্ন পারিবারিক আইন বাস্তবায়ন করতে হলে নারী আন্দোলনকে আরও অগ্রসর হতে হবে। চিন্তা-ভাবনা ও কাজে নারী সমাজকে দক্ষ হতে হবে; জেন্ডার গ্যাপ দূর করতে নারী বিষয়ে সরকারকে গবেষণা করতে হবে; তিনি আরও বলেন অভিন্ন পারিবারিক আইন বাস্তবায়িত হলে নারীর অবস্থা দৃঢ় হবে এজন্য সমাজের মধ্যে চলমান মতানৈক্য ও বিদ্বেষ দূর করতে ঐক্যবদ্ধভাবে সকলকে আন্দোলন করতে হবে।
সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের আন্তর্জাতিক উপপরিষদ সম্পাদক দেবাহুতি চক্রবর্তী।
ওই অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতিসংঘ সিডও কমিটির সাবেক সদস্য ফেরদৌস আরা বেগম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহনাজ হুদা। আলোচনায় অংশ নেন ওয়াই ডব্লিউ সিএ অব বাংলাদেশ এর সাধারণ সম্পাদক হেলেন মনীষা সরকার, মহিলা ঐক্য পরিষদের সহসভাপতি গীতা বিশ্বাস, বাংলাদেশ আদিবাসী ইউনিয়নের সহসভাপতি রাখি ম্রং এবং ভোরের কাগজের সিনিয়র রিপোর্টার সেবিকা দেবনাথ।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনে বলা হয়, সিডও সনদের দুটি ধারার ওপর সংরক্ষণ বহাল থাকায়, নারীর অধিকার রক্ষা ও বাস্তবায়নে এই সংরক্ষণ বিরাট এক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের নারীর অবস্থা ও অবস্থানের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় সংবিধানে নারীর অধিকার ও মর্যাদা রক্ষায় ইতিবাচক দিক এবং সরকার কর্তৃক বিভিন্ন আইন সংস্কারসহ নানা উন্নয়ন পদক্ষেপ গ্রহণের পরও ব্যক্তিজীবনের অধিকারহীনতার ক্ষেত্র, নারীর প্রতি সমাজের প্রচলিত পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং ক্রমবর্ধমান সহিংসতা বৃদ্ধি এবং সহিংসতার ঘটনায় বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা নারীর জীবনে নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করতে পারছে না। পাশাপাশি নারীর ব্যক্তিজীবনে অধিকারের অসম ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, সন্তানের অভিভাবকত্ব ও সম্পত্তির উত্তরাধিকারে রাষ্ট্রীয় নীতি অনুসারে সমান সুযোগের অভাব।
নারীর ব্যক্তিজীবনের অধিকারহীনতার ক্ষেত্রগুলো একটির সঙ্গে আরেকটি সম্পৃক্ত যা নারীর অবস্থানে প্রান্তিকতা সৃষ্টি করছে। সাম্প্রতিককালে বিবাহবিচ্ছেদ, সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী বিশেষ অতিথির বক্তব্যে জাতিসংঘ সিডও কমিটির সাবেক সদস্য ফেরদৌস আরা বেগম বলেন, সরকার নারীবান্ধব প্রচুর আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করলেও সিডও সনদের পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়নি। এতে সিডও সনদকে আইনে পরিণত করা যাচ্ছে না, কোর্টে উত্থাপন করা সম্ভব হচ্ছে না। সমতার আন্দোলন কার্যকর হচ্ছে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহনাজ হুদা বলেন, আইন প্রণয়নে রাজনীতির একটা বড় প্রভাব আছে।
তিনি বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদে, ভরণপোষণে বিভিন্ন ধর্মীয় আইনের নিয়মকানুনে উল্লেখ করে বলেন, ল কমিশন এখনো চেষ্টা করছে অভিন্ন আইন প্রণয়নের। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ যখন অভিন্ন পারিবারিক আইন নিয়ে কাজ শুরু করে তখন মনে হয়েছিল সমাজ এটা আস্তে আস্তে গ্রহণ করবে কিন্তু বাস্তবে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণই বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে, এ অবস্থায় অভিন্ন পারিবারিক আইনের জন্য অ্যাডভোকেসি ক্রমাগতভাবে চলতেই থাকবে।
স্বাগত বক্তব্যে সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, বাংলাদেশ সরকার এখন পর্যন্ত সিডও সনদেও ধারা ২ এবং ধারা ১৬.১ (গ)-এর ওপর সংরক্ষণ বহাল রেখেছে। ধারা দুটির সংরক্ষণের মাধ্যমে নারীর অধিকারের প্রতি রাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন দেখা যায়। এই ধারা দুটির সংরক্ষণ নারীর অধিকারের সাথে সাংঘর্ষিক।
মন্তব্য করুন