গাজায় চলমান যুদ্ধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিবাদে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ক্রমেই শীতল হয়ে উঠছে স্পেনের। এরই ধারাবাহিকতায় মাদ্রিদ সরকার বাতিল করেছে এক বিশাল সামরিক চুক্তি। ইসরায়েলের সঙ্গে প্রায় ৭০০ মিলিয়ন ইউরো বা ১০ হাজার কোটি টাকার এই চুক্তি বাতিল দুদেশের দীর্ঘদিনের সামরিক সম্পর্কে এক বড় ধাক্কা।
সংবাদমাধ্যম এএফপি জানিয়েছে, এই চুক্তির আওতায় ইসরায়েলি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এলবিট সিস্টেমস থেকে উন্নত রকেট লঞ্চার কেনার কথা ছিল। কিন্তু স্পেন স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, গাজার রক্তের দাগ লেগে থাকা কোনো অস্ত্র তাদের সেনাবাহিনীতে স্থান পাবে না।
সোমবার প্রকাশিত সরকারি নথিতে দেখা যায়, বাতিল হওয়া এই চুক্তির আওতায় স্পেন ১২টি সিলাম রকেট লঞ্চার কিনতে যাচ্ছিল। এলবিটের ‘পালস প্ল্যাটফর্মে’ তৈরি এই অস্ত্র সিস্টেম থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতেও হামলা চালানো সম্ভব। এত বড় প্রযুক্তিগত সুবিধা থেকেও পিছিয়ে এলো মাদ্রিদ, কেবল মানবিক অবস্থানকে অগ্রাধিকার দিয়ে। ফলে সরাসরি ১৭৬ মিলিয়ন ডলার ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছে ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠানটি।
এই সিদ্ধান্ত শুধু একটি অর্থনৈতিক চুক্তি বাতিল নয়, বরং স্পেন সরকারের বৃহত্তর রাজনৈতিক অবস্থান ও নৈতিক দায়বদ্ধতার প্রতিফলন। প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ আগেই ঘোষণা করেছিলেন— ইসরায়েলের কাছ থেকে সামরিক সরঞ্জাম কেনা কিংবা দেশটিকে সামরিক পণ্য বিক্রি দুই-ই নিষিদ্ধ করা হবে। নতুন আইন প্রণয়ন করে সেটিকে কার্যকর করার প্রস্তুতিও চলছে। এই প্রক্রিয়া শেষ হলে ইসরায়েলের অস্ত্র বাজার থেকে একেবারেই বেরিয়ে যাবে স্পেন।
শুধু এই একটি চুক্তি নয়, আরও বড় উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি জানা গেছে, ইসরায়েলের অপর একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে করা ১৬৮টি ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র লঞ্চার কেনার চুক্তিও বাতিলের পথে। এর মূল্যমান ৩৩৭ মিলিয়ন ডলার। যদি সেটিও বাতিল হয়, তাহলে সামরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে দুই দেশের সম্পর্ক প্রায় শূন্যে নেমে আসবে।
মাদ্রিদের সংবাদমাধ্যম বলছে, স্পেন সরকারের বড় পরিকল্পনা হলো ধীরে ধীরে সেনাবাহিনীকে ইসরায়েলি প্রযুক্তি ও অস্ত্র থেকে পুরোপুরি মুক্ত করা। ইতোমধ্যেই বার্সেলোনাভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান দেলাস সেন্টার জানিয়েছে, গাজায় আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর থেকে মাত্র ছয় মাসে এক বিলিয়ন ডলারেরও বেশি মূল্যের সামরিক চুক্তি করেছে স্পেন। এখন সেই দিকেই কোপ পড়ছে।
মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জোর দিচ্ছেন সানচেজ। ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে তিনি প্রথম গাজার পরিস্থিতিকে সরাসরি ‘গণহত্যা’ আখ্যা দেন। তার মতে, শিশু ও নারীদের নির্বিচার হত্যাকাণ্ড চালিয়ে কোনো রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আইনের ঊর্ধ্বে যেতে পারে না। এজন্যই ন্যায্যতার জায়গা থেকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া স্পেনের জন্য এক ধরনের নৈতিক দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অবশ্য এই অবস্থান দুই দেশের সম্পর্ককে শীতল করেছে। ২০২৪ সালে ফিলিস্তিনকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার পর থেকেই সাপে-নেউলে সম্পর্ক তৈরি হয় মাদ্রিদ-তেলআবিবের মধ্যে। ক্ষুব্ধ ইসরায়েল তখন মাদ্রিদ থেকে রাষ্ট্রদূত ফিরিয়ে নেয়। সাম্প্রতিক অস্ত্র চুক্তি বাতিল ও নতুন আইন প্রণয়নের ঘোষণার পর পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়। পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে স্পেনও তেলআবিব থেকে তাদের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে নিয়েছে।
ফলে স্পষ্ট হচ্ছে— ইসরায়েলের বিরুদ্ধে শুধু রাজনৈতিক নয়, কূটনৈতিক ও সামরিক সব দিক থেকেই দূরত্ব বাড়াচ্ছে স্পেন। বিশ্লেষকদের মতে, এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে দেশটি একসময় ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভেতরে ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় সমালোচকে পরিণত হবে।
মন্তব্য করুন