মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব নেওয়ার পর মধ্যপ্রাচ্যের দিকে প্রথম আন্তর্জাতিক সফরের লক্ষ্য স্থাপন করেন।
সৌদি আরব, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত- এই তিন উপসাগরীয় শক্তিধর দেশ সফরের মধ্য দিয়ে তিনি যে বার্তা দিতে চেয়েছিলেন, সেটি ছিল একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত অংশীদারিত্ব জোরদার, আবার অন্যদিকে ছিল স্পষ্ট ব্যক্তিস্বার্থের ছায়া।
সফর শুরুর আগেই কাতার থেকে ট্রাম্পকে উপহার দেওয়া হয় একটি বিলাসবহুল ৪০০ মিলিয়ন ডলারের বিমান। অন্যদিকে, ট্রাম্পের প্রথম গন্তব্য নির্ধারিত হয় সৌদি আরব- কারণ তারা ছিল যুক্তরাষ্ট্রে এক ট্রিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগে সবচেয়ে আগ্রহী।
এই সফরের প্রতিটি পরতে পরতে ছিল চমকপ্রদ চুক্তি, ব্যতিক্রমী আর্থিক প্রতিশ্রুতি এবং ট্রাম্প পরিবারের সাথে উপসাগরীয় দেশগুলোর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রমাণ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন সফর ইতিহাসে বিরল, যেখানে একজন রাষ্ট্রপ্রধানের পরিবার নিজ দেশে ব্যবসা পরিচালনার পাশাপাশি সফরকৃত দেশগুলোতেও নিজস্ব ব্যবসার সম্প্রসারণে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে।
সফরের আগে ট্রাম্পের দুই ছেলে- এরিক ও ডোনাল্ড জুনিয়র- মধ্যপ্রাচ্যে ঘন ঘন সফর করে ব্যবসার মাটি তৈরিতে ব্যস্ত ছিলেন। এরিক ট্রাম্প ঘোষণা দেন দুবাইয়ে ৮০ তলা বিশিষ্ট ট্রাম্প টাওয়ার নির্মাণের পরিকল্পনার কথা। সেসঙ্গে তিনি অংশ নেন একটি ক্রিপ্টোকারেন্সি সম্মেলনে, যেখানে ট্রাম্প পরিবারের মুদ্রা কোম্পানি ওয়ার্ল্ড লিবার্টি ফিনান্সিয়ালের পক্ষে বড় বিনিয়োগ চুক্তির ঘোষণা আসে।
দোহায় ট্রাম্প অর্গানাইজেশন নতুন একটি গলফ রিসোর্ট প্রকল্পে কাতার সরকারের মালিকানাধীন কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। এছাড়া সৌদি আরবের রিয়াদ ও জেদ্দায় দ্বার-গ্লোবাল-এর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ট্রাম্প ব্র্যান্ডের রিয়েল এস্টেট প্রকল্প শুরু হয়। এমনকি ওমানে নির্মিতব্য বিলাসবহুল গলফ রিসোর্ট এবং হোটেলেও যুক্ত রয়েছে ট্রাম্প কোম্পানি।
সৌদি সরকার-সমর্থিত লিভ গলফ ট্রাম্পের মালিকানাধীন রিসোর্টে একাধিক প্রতিযোগিতা আয়োজন করে, যা শুধু ট্রাম্প পরিবারের আয়ের উৎসই নয়, বরং উপসাগরীয় আর্থিক কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে তার সম্পর্কের গভীরতাও তুলে ধরে। এই সম্পর্ককে ‘স্পষ্ট স্বার্থের সংঘাত’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন কেটো ইনস্টিটিউট-এর গবেষক জন হফম্যান।
সফরের সময় ট্রাম্প ঘোষণা দেন, সৌদি আরব চার বছরে যুক্তরাষ্ট্রে ৬০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে। সংযুক্ত আরব আমিরাত ১.৪ ট্রিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি দেয় এবং কাতার থেকে উপহার পাওয়া বিমান নিয়ে প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘এটি গ্রহণ করা সম্পূর্ণ যৌক্তিক।’
তবে প্রশ্ন উঠেছে- এসব প্রতিশ্রুতি কতটা বাস্তবায়িত হবে, আর কতটুকুই বা শুধু কূটনৈতিক প্রদর্শনী?
হোয়াইট হাউস থেকে প্রেস সচিব ক্যারোলিন লেভিট সাংবাদিকদের বলেন, এই সফর সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় স্বার্থে পরিচালিত, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কোনোভাবেই ব্যক্তিগত লাভের উদ্দেশ্যে কিছু করছেন না।
যদিও বাস্তবতা হলো, ট্রাম্প অর্গানাইজেশনের সঙ্গে ট্রাম্প পরিবারের সম্পর্ক এখনো অখণ্ড, আর কোম্পানির লাভ মানেই প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত লাভ।
এই অভিযোগগুলোকে প্রতিহত করতে ট্রাম্প পরিবার একটি স্বেচ্ছাসেবী ‘ইথিক্স চুক্তি’ প্রকাশ করে, যেখানে বলা হয়েছে, তারা সরাসরি কোনো বিদেশি সরকারের সঙ্গে চুক্তি করবে না। তবে বেসরকারি বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিতে কোনো বাধা নেই।
আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিউট-এর টিমোথি পি. কার্নি বলেন, ট্রাম্প কোম্পানির লাভ মানেই প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত সম্পদ বৃদ্ধির সুযোগ। হোয়াইট হাউস ছাড়ার পর তিনি এই লাভ পুরোপুরি ভোগ করবেন।
যে সময়ে বিশ্ব কূটনীতি নৈতিকতা ও স্বচ্ছতার গুরুত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চাইছে, সে সময় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এমন সফর রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও ব্যক্তিস্বার্থের সীমারেখাকে ঘোলাটে করে তোলে।
ট্রাম্পের এই সফর কী শুধু যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে ছিল, নাকি পারিবারিক ব্যবসার স্বার্থে সাজানো এক ‘রাজকীয় সফর’? রাষ্ট্রীয় মুখোশ পরে ব্যক্তিগত লাভ নিশ্চিত করাই কি ছিল প্রকৃত উদ্দেশ্য?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর সময়ের কাছে ন্যস্ত। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটুকু স্পষ্ট- এই সফর এক নতুন ধারা সূচনা করেছে, যেখানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও পারিবারিক ব্যবসা আলাদা নয়, বরং একীভূত। আর সেখানেই উঁকি দিচ্ছে সবচেয়ে বড় আশঙ্কা- রাষ্ট্রপ্রধান না কি ব্যবসায়িক প্রতিনিধি?
সূত্র : এপির ওয়াশিংটন প্রতিনিধি উইল উইজার্টের কলাম থেকে অনুবাদকৃত
মন্তব্য করুন