ডেঙ্গু মহামারির এ সময়ে মশা তাড়ানোর কয়েলও দৈনন্দিন জীবনে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য হয়ে উঠেছে। তবে আলু, ডিম, মুরগির মতো দেশে কয়েলের বাজার নিয়েও তৈরি হয়েছে অরাজকতা। একদিকে নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষকে এ ক্ষেত্রে বাজারে পণ্যটির গুণগতমান নিশ্চিতে খুব একটা কার্যকর ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো যেখানে রুটি, বিস্কুট, চাল-ডাল থেকে শুরু করে আচারের ব্যবসা থেকেও চেষ্টা করে সর্বোচ্চ মুনাফা লুটে নেওয়ার, সেখানে নাকি নন-ব্র্যান্ডের মতো ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোর দাপটে তারা কয়েলের বাজারেই টিকতে পারছে না। ফলে এরই মধ্যে যারা এসেছিল, তাদের অনেকেই এখন অভিমান করে দূরে সরে গেছে। ফলাফল যা হওয়ার সেটিই হয়েছে। কয়েলের বাজারে এখন চলছে মানহীন প্রতিযোগিতা।
এভাবেই সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ডেঙ্গুর প্রকোপে স্থানীয় কয়েলের বাজার বড় হয়ে উঠলেও সেটি আবর্তিত হচ্ছে অনিয়মের মধ্য দিয়েই। অভিযোগ রয়েছে, ক্রেতার অতি চাহিদার সুযোগ নিয়ে মশা তাড়ানোর জন্য বহুল প্রচলিত এ কয়েলের গুণগতমান নিয়ে কারসাজি হচ্ছে। ক্ষতিকর মাত্রায় রাসায়নিক প্রয়োগ করা হচ্ছে কয়েলে। আর এই উচ্চমাত্রার রাসায়নিক ব্যবহারের কারণে দ্রুত মশা তাড়ানো বা নিধন করা গেলেও তা ব্যবহারকারীর জন্য হয়ে উঠছে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ। সারা দেশে ঘরোয়াভাবে গজিয়ে ওঠা অনুমোদনহীন ছোট ছোট নন-ব্র্যান্ডের শত শত কোম্পানি মানহীন এসব কয়েল বাজারে ছাড়ছে। একইভাবে বড়দের অনুপস্থিতির সুযোগে চীন থেকে আমদানি করা অনুমোদনহীন কয়েলও এখন স্থানীয় বাজার দখলে ভাগ বসাতে শুরু করেছে। সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন, সব মিলে দায়িত্বশীলদের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে খাতটির সুষ্ঠু প্রসার যেমন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি অধিক কর্মসংস্থান ও ব্যক্তি উদ্যোক্তা সৃষ্টির সম্ভাবনাও অঙ্কুরে বিনষ্ট হওয়ার উপক্রম হতে চলেছে।
এদিকে ডেঙ্গু যতই মহামারি হয়ে উঠছে, প্রাণঘাতীর শঙ্কাও ততই প্রবল হচ্ছে। প্রতিবছর আক্রান্ত ও মৃত্যুহার উভয়ই সমান তালে বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে প্রায় প্রতিটি পরিবার সুরক্ষার জন্য দিনে-রাতে প্রায় সব সময়ই কয়েল ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। এতে কয়েলের চাহিদাও বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।
বাংলাদেশ মসকিউটো ম্যানুফ্যাকচারার অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে কয়েলের বাজারের আকার ২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। তবে এই বিশাল বাজার অংশীদারত্বে অ্যাসোসিয়েশনের অনুমোদনপ্রাপ্ত কোম্পানির সংখ্যা মাত্র ১৩৫টি। সমিতির বিবেচনায় বাজারে থাকা বাকিরা অনুমোদনহীন।
বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটের (বিএসটিআই) তথ্য বলছে, সারা দেশে বৈধভাবে কয়েল উৎপাদনে বিএসটিআইর লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান আছে ২২৯টি, যা ২০২২ সালে গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে মশার কয়েলের নাম, ঠিকানা ও ব্র্যান্ডের নাম প্রকাশ করে বিএসটিআই। ওই গণবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, এ পণ্য উৎপাদন, বিক্রয়-বিতরণের আগে বিএসটিআইর লাইসেন্স গ্রহণ ও নিয়মিত নবায়ন করতে হয়। কিন্তু কিছু অসাধু প্রতিষ্ঠান বিএসটিআইর সার্টিফিকেট অব মার্কস (সিএম) লাইসেন্স গ্রহণ না করে নকল ও নিম্নমানের মশার কয়েল উৎপাদন করে পণ্যের লেবেলে বা মোড়কে অবৈধভাবে বিএসটিআইর মানচিহ্ন ব্যবহার করে বিক্রি-বিতরণ ও বাজারজাত করছে। ফলে লাইসেন্স নিয়ে নবায়নকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১২৯টি। এর মধ্যে বড় ও মাঝারি মানের কোম্পানি সাতটি। তবে কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, মশার কয়েল উৎপাদনের জন্য অতি সম্প্রতি নতুন করে তারা ৩৩০টি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দিয়েছে। সব মিলে দেশে অনুমোদিত মশার কয়েলের লাইসেন্স পাওয়া প্রতিষ্ঠান হলো ৫৫৯টি। বর্তমান বাজার পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ মসকিউটো ম্যানুফ্যাকচারার অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি আমানউল্লাহ মুনসী কালবেলাকে বলেন, দেশি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলে সেটি দেশের জন্যই মঙ্গল। কিন্তু নিয়মের মধ্যেই বেড়ে উঠতে হবে। জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি করে নয়। আবার দেশীয় শিল্পের বিকাশের সময় বিদেশি পণ্যের আগ্রাসনও কাম্য নয়। সরকারই পারে এ দুয়ের মধ্যে সমন্বয় করে নিয়মের মধ্যে একটা শিল্পকে বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দিতে। এজন্য বলব, দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলো আরও দায়িত্বশীল ও নির্মোহ হতে হবে।
জানা গেছে, কয়েলের বাজারে একসময় রেকিট অ্যান্ড বেনকাইজারের মরটিন, এসিআই, ভারতের গোদরেজের গুডনাইট, কাজী এন্টারপ্রাইজের ইগল, গ্লোবসহ আরও কয়েকটি ব্র্যান্ড বেশ সুপরিচিত ছিল। ২০১২ সালের দিকেও এ বাজারে প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডগুলোর হিস্যা ছিল ৫৫ শতাংশের বেশি। এখন সেই হিস্যা কমে ১০ শতাংশের কাছাকাছি নেমে এসেছে। দেশের সুপরিচিত ব্র্যান্ডগুলোর কেউ কেউ এরই মধ্যে উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে। আবার কেউ কেউ উৎপাদন একেবারে বন্ধ না করলেও সীমিত পরিসরে কারখানা চালু রেখেছেন। তাতে মশার কয়েলের বাজারে করপোরেট প্রতিষ্ঠানের হিস্যা ক্রমেই কমছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এসিআই কনজ্যুমার ব্র্যান্ডসের পরিচালক কামরুল হাসান কালবেলাকে বলেন, কয়েলের বাজারে এখন দুষ্টদের রাজত্ব চলছে। আমরা চাইলেই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কয়েল উৎপাদন করে বাজারে ছাড়তে পারি না। তাই উৎপাদনই বন্ধ করে দিয়েছি। তিনি বলেন, আমাদের অনেক নিয়ম মানতে হয়। কর দিতে হয়। ওইসব কারখানার ক্ষেত্রে তো কিছুই লাগে না।
গ্লোব কয়েলের ডেপুটি ম্যানেজার (মার্কেটিং) সালেহা শারমিন শানু কালবেলাকে বলেন, একটা সময় সারা দেশে গ্লোব কয়েলর একচেটিয়া দাপট ছিল। এরপর ধীরে ধীরে অনেক লোকাল কয়েলের প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়। তাদের মধ্যে অখ্যাত অনেক ব্র্যান্ড, তাদের কয়েলে বেশি মাত্রায় রাসায়নিক ব্যবহার করায় এবং এতে মশা মারার কার্যকারিতা বাড়তে থাকায় ক্রেতারা ব্র্যান্ডের পরিবর্তে নন-ব্র্যান্ডে আগ্রহী হয়ে ওঠে। তারা শুধু তাৎক্ষণিক কার্যকারিতা দেখতে চায়। কিন্তু এতে কতটা স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হলো, সেটা আমলে নিতে চায় না। কিন্তু গ্লোব কয়েলের পক্ষে বাজার ধরে রাখতে জনস্বাস্থ্য হুমকিতে ঠেলে দেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ফলে বাধ্য হয়ে গ্লোবও নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল।
আগামীর পরিকল্পনা জানতে চাইলে অবশ্য তিনি জানান, এটা ঠিক, বড়রা সবাই নিজেকে গুটিয়ে নিলে তো এ বাজারে অরাজকতা বাড়তেই থাকবে। সুখবর হলো, ডেঙ্গু মহামারির এ দুঃসময়ে এরই মধ্যে গ্লোব কয়েল আবার বাজারে ফিরে এসেছে এবং অল্প সময়ের মধ্যেই তার পুরোনো ঐতিহ্য ফিরে পেতে শুরু করেছে। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে ভারতেও এ কয়েল রপ্তানির প্রক্রিয়াও চলছে।