শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের সব সেক্টর থেকে ওই সরকারের সুবিধাভোগীদের সরানোর উদ্যোগ নেওয়া হলেও ব্যতিক্রম শুধু জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। সরকারি এ দপ্তরটি হাঁটছে উল্টোপথে। দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতিতে ডুবে থাকা দপ্তরটি এবার আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগীদের পুনর্বাসন শুরু করেছে। আওয়ামী লীগের সাবেক এক মন্ত্রীর ভাইকে ১ কোটি ৩৩ লাখ বই ছাপার কাজ দেওয়া হয় গত বছর, যা নিয়ে শুরু হয় তুমুল সমালোচনা। আপত্তি তোলে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। এর পরও আগামী ২০২৬ শিক্ষাবর্ষে তাকে ১ কোটির বেশি বইয়ের কাজ দেওয়ার প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত। শুধু তাই নয়, বিতর্কিত এই মুদ্রাকরকে নিয়ে গোপনে বৈঠক করেন সংস্থাটির কর্তাব্যক্তিরা।
এনসিটিবির একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানিয়েছেন, শেখ হাসিনা সরকারের ২০১৮-২৪ মেয়াদের মন্ত্রিসভায় টেকনোক্র্যাট কোটায় ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী ছিলেন মোস্তাফা জব্বার। তার ভাই রব্বানী জব্বার ২০২১ সালে নেত্রকোনার খালিয়াজুরি উপজেলা পরিষদ উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। পরে ২০২৩ সালে তিনি মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি হন। আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে গত রোববার তাকে সমিতির পদ থেকে অপসারণ করে সেখানে প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
কালবেলার হাতে আসা এনসিটিবির মুদ্রণ শাখার তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত বছরের ৫ আগস্টের পর তাকে ১ কোটি ৩২ লাখ ৫০ হাজার ৪৯৯ কপি বই ছাপার কাজ দেয় এনসিটিবি। আনন্দ ও এপেক্স প্রিন্টার্সের নামে তিনি প্রায় ৭৫ কোটি টাকার কাজ করে বিল তুলেছেন বিনা বাধায়। নিম্নমানের বই দিলেও হয়নি জরিমানা।
এদিকে আগামী ২০২৬ শিক্ষাবর্ষের বই ছাপার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিকের প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি এবং মাধ্যমিকের ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির বইয়ের জন্য ৫৯৮টি লটের দরপত্র উন্মুক্ত করা হয়েছে। এসব দরপত্রের মধ্যে রব্বানী জব্বারের দুটি প্রেস ১৬টি লটের সর্বনিম্ন দরদাতা নির্বাচিত হয়েছে। এতে তিনি ৪৭ লাখ বইয়ের কাজ পাবেন। এরই মধ্যে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বইয়ের দরপত্র মূল্যায়নের কাজ শেষ করেছে কমিটি এবং তার প্রেস দুটিকে কাজের যোগ্য বলে বিবেচনা করা হয়েছে। বাকিগুলোয় মূল্যায়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। চলতি মাসের শেষদিকে চতুর্থ, পঞ্চম ও নবম শ্রেণির বইয়ের দরপত্র জমা দেওয়ার কথা রয়েছে। এনসিটিবি ও মুদ্রণ শিল্প সমিতির একাধিক নেতা জানিয়েছেন, আগের দরপত্রের সমঝোতা অনুযায়ী আরও ৪৫ লাখের বেশি বইয়ের কাজ পাবেন রব্বানী জব্বার। আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রীর ভাইয়ের এত সংখ্যক বই ছাপার কাজ পাওয়া নিয়ে সরকারি এ কাজের সঙ্গে যুক্তরা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন, বিষয়টি নিয়ে তদন্তে নেমেছে দুটি গোয়েন্দা সংস্থা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দরপত্র নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান এনসিটিবির নাকের ডগায় সমঝোতার মাধ্যমে দরপত্র জমা দেওয়া হলেও প্রতিষ্ঠানটি ‘নিধিরাম সর্দারের’ ভূমিকায়। শুধু তা-ই নয়, দরপত্র নিয়ন্ত্রণে রব্বানী জব্বার কীভাবে মুখ্য ভূমিকা পালনের সুযোগ পাচ্ছেন, তা নিয়েও বিস্ময় প্রকাশ করেছেন অনেকেই। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও সরকারির বিভিন্ন সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার প্রকাশ্যে বৈঠক করা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এবারের দরপত্রে কোন প্রেস কত বই ছাপার কাজ পাবে এবং কে কোন লটে কত দর দেবে, তা আগেভাগেই ভাগবাটোয়ারা হয়ে গেছে। মূলত রব্বানী জব্বারসহ সাত থেকে আটটি বড় প্রেসের মালিকদের একটি সিন্ডিকেট এই ভাগবাটোয়ারার নেতৃত্ব দিয়েছে। এতে সরকারের প্রায় ৩০০ কোটি বাড়তি খরচ হবে।
এনসিটিবির চেয়ারম্যানের রুটিন দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, সরকারি বিধিবিধান অনুযায়ী, দরপত্রদাতা সব শর্ত পূরণ করলে তাকেই কাজ দিতে হয়। এনসিটিবি সেভাবেই কাজ করছে এবং কারও কাজ বাতিল করার এখতিয়ার তাদের নেই। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে পারে। সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত কমিটি (পারচেজ কমিটি) দরপত্র বাতিল করার একমাত্র ক্ষমতা রাখে। এনসিটিবি এ বিষয়টি কমিটির কাছে উত্থাপন করতে পারে।
রব্বানী জব্বারকে নিয়ে বৈঠক করার বিষয়ে চেয়ারম্যান বলেন, তিনি সমিতির সভাপতি হিসেবে আসতেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যেহেতু নানা অভিযোগে তাকেসহ সমিতির সবাইকে সরিয়ে দিয়েছে, তাই বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে আনুষ্ঠানিকভাবে জানাবেন এবং পরবর্তী কার্যক্রমের বিষয়ে মতামত চাইবেন।
এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক রিয়াদ চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, একজন দরপত্রদাতা সব শর্ত পূরণ করার পর তাকে কাজ না দেওয়ার এখতিয়ার তাদের নেই। তার (রব্বানী জব্বার) সম্পর্কে সরকারের সব দপ্তর অবগত এবং আগ বাড়িয়ে তার কাজ বাতিল করার বিষয়টি সমীচীন হবে না।
সার্বিক বিষয়ে বক্তব্য জানতে রব্বানী জব্বারের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল ও বার্তা পাঠিয়েও তার কোনো সাড়া মেলেনি।
মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান কালবেলাকে বলেন, ‘শুধু রব্বানী জব্বার কেন, বিগত সরকারের সুবিধাভোগীরাই এখনো এনসিটিবির সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করছেন। প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ কর্মকর্তারাও আগের সরকারের সুবিধাভোগী। তাদের না সরালে এমন ঘটনা ঘটবেই।’
জাতীয় নাগরিক পাার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক নিয়াজ মোর্শেদ কালবেলাকে বলেন, ‘৫ আগস্টের পর খুনি একটি সরকারের সাবেক মন্ত্রীর ভাইকে বই ছাপার মত স্পশকার্তর কাজ দেওয়া কোনোভাবে সমর্থন করতে পারি না। এজন্য এনসিটিবির কর্মকর্তারা দায়ী। প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ পদ বিশেষ করে বই ছাপার সঙ্গে যুক্ত একজন কর্মকর্তা বিগত সরকারের সরাসরি লোক। তারা মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করছে এবং আওয়ামী লীগ পুনর্বাসন করছে।’
সমঝোতা বৈঠকের নেতৃত্বে ছিলেন রব্বানী জব্বার: ২০২৬ শিক্ষাবর্ষের জন্য এনসিটিবি কাজ শুরু করেছে। প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিকের প্রথম-তৃতীয় শ্রেণি এবং মাধ্যমিকের ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির বইয়ের দরপত্র উন্মুক্ত করা হয়েছে। নিম্নমানের বই ঠেকাতে এনসিটিবি এ বছর কাগজের জিএসএম ৮২ থেকে বাড়িয়ে ৮৫, বাস্টিং ফ্যাক্টর (ব্রাইটনেস) ১৬ থেকে বাড়িয়ে ২০, এবং শতভাগ পাল্প থেকে উৎপাদিত প্রাকৃতিক রঙের কাগজ ব্যবহারের মতো নতুন উদ্যোগ নিয়েছে। এ ছাড়া প্রতিটি প্রেসে সিসিটিভি ক্যামেরা ও ইআরসিকে নতুন শর্ত যুক্ত করা হয়েছে। পরিদর্শন এজেন্সি নিয়োগে কঠোর শর্তারোপ করা হচ্ছে, যাতে এজেন্সিকে কোনো মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান নিজের পকেটবন্দি করতে না পারে। এসব কঠিন শর্তারোপ করার পর মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো বেশি দামে বইয়ের কাজ নিতে একজোট হয়ে যায়। তারা দফায় দফায় বৈঠক করে সমঝোতা দর দিয়ে দরপত্র দিচ্ছে। এতে সরকারের প্রায় ৩০০ কোটি বাড়তি খরচ হবে। এ সমঝোতার দরপত্রের নেতৃত্ব দেয় রব্বানী জব্বার ও শীর্ষস্থানীয় কিছু মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান। তাদের দেওয়া দরের বাইরে গিয়ে কেউ দরপত্রের রেট (দর) দিতে পারেনি।
ভোটের রাজনীতিতে রব্বানী জব্বারকে কেউ হাতছাড়া করতে চায়নি: বিনামূল্যে বই ছাপাসহ বিভিন্ন মুদ্রণের কাজ করে এমন প্রায় ৭৫০ জন সদস্য রয়েছেন বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতিতে। যারাই সমিতির নেতা হন তারাই বিনামূল্যের বই ছাপার কাজে নানা প্রভাব বিস্তারে চেষ্টা করেন। সেই সমিতির নির্বাচনে রব্বানী জব্বার ব্যাপক প্রভাবশীল। এজন্য আওয়ামী লীগের পতন হলেও তাকে কোথাও বাধার মুখে পড়তে হয়নি। সমিতির অফিসে নিয়মিত না গেলেও সব জায়গায় সরব উপস্থিতি ছিল তার। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, এনসিটিবিসহ সব গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে তিনি মুদ্রণ সমিতির প্রতিনিধি হিসেবে অংশ নিয়েছেন। প্রায় প্রতিদিনই তিনি ব্যক্তিগত বা সমিতির বিষয় নিয়ে এনসিটির চেয়ারম্যান, সদস্য পাঠ্যপুস্তকের সঙ্গে বৈঠক করেন। জানা গেছে, সমিতিতে একাধিক গ্রুপ সক্রিয় থাকলেও রুবেল-তোফায়েল এই দুটি গ্রুপ সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী। অতীতে রব্বানী জব্বার যখন যে পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, তারাই সমিতির শীর্ষ পদে এসেছেন। আগে তিনি তোফায়েল খান গ্রুপের পক্ষে থাকায় তাদের কমিটিই একাধিকবার নির্বাচিত হয়েছে। তবে সর্বশেষ ২০২৩-২৫ কমিটিতে তোফায়েল খান-সেরনিয়াবাত কমিটির সঙ্গে তার সম্পর্কে ছেদ হয় এবং রুবেলকে সঙ্গে নিয়ে নতুন কমিটি গঠন করেন। সমিতির একাধিক সদস্য জানান, আগামী নভেম্বরে সমিতির দ্বিবার্ষিক নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। তবে গত রোববার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অনিয়মের অভিযোগে বর্তমান কমিটি বাতিল করে একজন প্রশাসক নিয়োগ করেছে। আগামী ১২০ দিন বা তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনী রাজনীতিতে রব্বানী জব্বারকে কোনো পক্ষই হাতছাড়া করতে চায় না। বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতিতে তার ব্যাপক প্রভাবের কারণে আওয়ামী লীগের পতনের পরও তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলেননি; বরং তাকে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করেছেন প্রকাশ্যে। আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। উভয়পক্ষই রব্বানী জব্বারকে হাতছাড়া করতে চাইছে না। আওয়ামী লীগের মন্ত্রীর ভাই হওয়ার শর্তেও গত দশ মাসে তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলেননি। বরং যে কোনো উপায়ে কমিটির মেয়াদ শেষ করতে চেয়েছেন যাতে রব্বানী জব্বার তাদের এই কৌশল বুঝতে না পারেন। এর আগে ২০২১-২০২৩ মেয়াদের কমিটিতে শহীদ সেরনিয়াবাত এবং জহুরুল ইসলাম সমিতির নেতৃত্ব দিয়েছেন। তোফায়েল খানও এর আগে একাধিকবার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ওই কমিটি মুদ্রণ সমিতিতে বসে এনসিটিবির তৎকালীন চেয়ারম্যানসহ একাধিক প্রিন্টার্সের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলনে করেছেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তোফায়েল খান বলেন, রব্বানী জব্বার তার সঙ্গে সখ্য নয়; বরং বিপরীত প্যানেলে নির্বাচন করেছে। বরং বিগত নির্বাচনে সমিতির সদস্যদের রাজধানীর নামিদামি হোটেলে রেখে জোর করে ভোট নিয়ে যারা নেতা হয়েছেন তারা তার সঙ্গে সখ্য করেছেন।
মন্তব্য করুন