দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির সঙ্গে আসন ভাগাভাগি না করতে আওয়ামী লীগের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ। গতকাল মঙ্গলবার নিজ অনুসারীদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জাপার প্রতিষ্ঠাতা এরশাদের পত্নী রওশন এমন দাবি জানান।
জি এম কাদেরের অনুসারীরা বলছেন, মনে প্রতিশোধের আগুন থেকেই এসব করছেন রওশন। এর মধ্য দিয়ে নির্বাচন থেকে জাপাকে সরাতে চান তিনি। পাশাপাশি অনুসারীদের পরামর্শে জাতীয় পার্টিকে আবারও ভাঙতে চান বিরোধী দলের নেতা।
জানা গেছে, জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের কাছে এবারের নির্বাচনে শতাধিক আসনে নিজের পছন্দমতো মনোনয়ন চেয়েছিলেন রওশন। তার পক্ষ থেকে আরেকটি দাবি ছিল, অনুসারীদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা। কিন্তু কোনো আবদারই পূরণ করেননি জি এম কাদের। মাত্র তিনটি আসনে মনোনয়ন দিতে চাওয়ায় বেঁকে বসেন রওশন। মনোনয়ন দাখিলের শেষ মুহূর্তে জি এম কাদেরপন্থিদের দোষারোপ করে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন তিনি। কিন্তু সেখানেই শেষ হয়নি ঘটনা।
নির্বাচনী আসন বণ্টন নিয়ে আওয়ামী লীগ ও জাপার মধ্যে যখন আলোচনা চলছে, তখন নিজের অনুসারীদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন রওশন এরশাদ। দলীয় কর্তৃত্বের দ্বন্দ্বের জেরে নির্বাচন থেকে ছিটকে পড়া রওশন জাপার মনোনয়ন নিয়ে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরেছেন। জি এম কাদেরের বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়ে জাপার সঙ্গে নির্বাচনী জোট না করার অনুরোধ জানান তিনি।
এর আগে গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় নির্বাচনে জাতীয় পার্টির অংশগ্রহণ এবং আসন ভাগাভাগির প্রসঙ্গ ওঠে। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্তব্য করেন, ‘জাতীয় পার্টিকে বিশ্বাস করা যায় না তারা কখন কী করে, তার ঠিক নেই। ওরা (জাতীয় পার্টি) নির্বাচনে থাকতেও পারে, নাও থাকতে পারে।’
প্রধানমন্ত্রীর এমন মন্তব্যের পর জাপার সঙ্গে আওয়ামী লীগের শেষ পর্যন্ত আসন সমঝোতা হচ্ছে কি না—এ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। যদিও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গতকাল মঙ্গলবার বলেছেন, তার সঙ্গে জাপার যোগাযোগ আছে।
অন্যদিকে, আসন বণ্টন প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি ও জোট গঠনের বিষয়ে কার্যক্রম নেই। আমরা নিজের মতো করে নির্বাচন করছি, মনোনয়ন দিয়েছি।’
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে রওশন এরশাদ যেসব অভিযোগ করেছেন, তা নির্বাচনের মাঠে খুব একটা প্রভাব ফেলবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘দলীয় গঠনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সবার সঙ্গে কথা বলে আমরা নির্বাচন করছি।’
তিনি বলেন, ‘২০১৯ সালে বৈধ কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে দলের চেয়ারম্যান হয়েছেন জি এম কাদের।’
নির্বাচন নিয়ে দু-এক দিনের মধ্যে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আবারও বৈঠক হবে বলে জাপা মহাসচিব জানান।
অন্যদিকে, দলটির একাধিক শীর্ষ নেতা জানিয়েছেন, ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতা হতে পারে।
নির্বাচন এলেই জাপায় নাটকীয়তা নতুন কিছু নয়। দলটিতে রাজনৈতিক নানা নাটকীয়তার কারণেই রওশন এরশাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে যাওয়ার প্রশ্নে জাপার দোদুল্যমান অবস্থার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন রওশন। সেই নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমা দিলেও পরে প্রার্থিতা তুলে নেওয়ার নির্দেশ দেন দলটির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তখন দলে রওশনকে ঘিরে তৈরি হয় আরও একটি বলয়। তারা ভোটে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেন। এর পুরস্কার হিসেবে নির্বাচনের পর থেকে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হন রওশন। বর্তমান সংসদেও তিনি একই পদে আছেন।
তবে ২০১৯ সালে জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর দলের নেতৃত্ব নিয়ে যে টানাপোড়েন, তাতে এবার বেকায়দায় পড়েছেন এরশাদপত্নী। দলে সর্বশেষ কাউন্সিলে রওশনকে প্রধান পৃষ্ঠপোষক করা হয়। এরপর কিছুদিন শান্তিপূর্ণ অবস্থা থাকলেও গত তিন বছর ধরে দেবর-ভাবির মধ্যে নেতৃত্বের কোন্দল চরমে পৌঁছে। এবারের নির্বাচন ঘিরে তা চরম আকার ধারণ করে।
প্রধানমন্ত্রীকে যা বলেছেন রওশন:
মঙ্গলবার গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন রওশন এরশাদ। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন ছেলে সাদ এরশাদ ও তার স্ত্রী, মশিউর রহমান রাঙ্গা, বিরোধীদলীয় নেতার মুখপাত্র মামুনুর রশীদসহ কয়েকজন।
সেখান থেকে বেরিয়ে রওশন বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে কী আলোচনা হয়েছে, তা বিস্তারিত জানাননি তিনি।
নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী কিছু বলেছেন কি না—জানতে চাইলে রওশন বলেন, ‘এখন তো আর সময় নেই। আর কী বলবেন।’ ৭ জানুয়ারির প্রতি সমর্থন আছে কি না—জানতে চাইলে রওশন বলেন, ‘ঠিক আছে।’
জি এম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়ে রওশন বলেন, ‘জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান আমাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেননি। আমার ছেলের জায়গায় উনি ইলেকশন করছেন। ওর কথা তার মনে নেই। জাতীয় পার্টির নেতাদের প্রতি সমর্থন আছে কি না—জানতে চাইলে রওশন বলেন, আমাদের ইচ্ছা করে বাদ দিয়েছে। কেন সমর্থন থাকবে?’
পরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার বিষয়বস্তু তুলে ধরে রওশনের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে একটি বার্তা পাঠানো হয়। এতে বিরোধী দলের নেতার বরাত দিয়ে বলা হয়, ‘প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতে বলেছি, জি এম কাদের অবৈধভাবে জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব দখল করায় এবং সংসদ নির্বাচনে জাপার মনোনয়ন চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে সুকৌশলে আমাকে এবং আমার সন্তান সাদ এরশাদকেসহ দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সরিয়ে ক্যু করে দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছেন।’
প্রধানমন্ত্রীকে সব বিষয়ে অবহিত করার কথা জানিয়ে লিখিত বার্তায় আরও বলা হয়, ‘দেশবাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার অনুরোধ এবং খণ্ডিত জাতীয় পার্টি গোলাম কাদেরের সঙ্গে কোনো নির্বাচনী জোট না করার অনুরোধ করেছি। দ্বাদশ নির্বাচন অধিক গ্রহণযোগ্য করার জন্য জাতীয় পার্টি এককভাবে সারা দেশে প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে অনুরোধ করা হয়েছে। নির্বাচনে কোনো জোট না করার অনুরোধ করেছি।’
এ বিষয়ে মশিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে জি এম কাদেরের কর্মকাণ্ডে আমাদের সমর্থন নেই। তাই জাতীয় পার্টির সঙ্গে যেন কোনো জোট না হয়, সেজন্য প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছেন রওশন এরশাদ।’
তিনি আরও বলেন, ‘দলের আড়াই থেকে তিনশ নেতাকর্মীকে অন্যায়ভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। যোগ্য প্রার্থীদের মনোনয়ন না দিয়ে অপমান করা হয়েছে। জাতীয় পার্টির সঙ্গে যেন জোট না হয়, সে অনুরোধ জানিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, উনি দলীয় পরিষদে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন।’
জাপাকে লড়াইয়ের বার্তা কাদেরের আওয়ামী লীগের সমর্থনে সহজে আর পার হওয়া যাবে না—জোটের শরিক দলগুলোকে এমন বার্তা দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
তিনি বলেছেন, ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতা আমরাও করব, শরিকদেরও করতে হবে। প্রতিদ্বন্দ্বিতার কোনো বিকল্প নেই। প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেই নির্বাচনের রেজাল্ট আনতে হবে।’
১৪ দলের শরিকদের মধ্যে আসন সমঝোতার আলোচনার মধ্যে মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে জাপাকে কোনো আসন ছেড়ে দেওয়া হবে কি না—এমন প্রশ্নে কাদের বলেন, ‘সিট ছেড়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেই তাদের আসতে হবে।’
জাতীয় পার্টি শেষ পর্যন্ত ভোট থেকে সরে যেতে পারে—প্রধানমন্ত্রীর এমন আশঙ্কা প্রসঙ্গে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘এটা কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য নয়। কেবিনেট শেষে উনি কথা বলেছেন। এটা আমরা এখনো নিশ্চিত না। আজও জাতীয় পার্টি নেতাদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। জাতীয় পার্টির মহাসচিবের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমাদের আলোচনা অব্যাহত আছে।’
আসন সমঝোতা ছাড়া জাতীয় পার্টির সঙ্গে আলোচনার কী মানে—এই প্রশ্নে কাদের বলেন, ‘আমরা রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনা করেছি; কীভাবে নির্বাচনটা সুষ্ঠু হবে, অবাধ হবে, নিরপেক্ষ হবে। নির্বাচনটা যাতে সুন্দরভাবে, শান্তিপূর্ণ পরিবেশে হয়। যেহেতু তারা অংশগ্রহণ করেছে, সেজন্য তাদের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে, সমন্বয়ের ব্যাপারে কথা হচ্ছে। এখানে অন্য কোনো বিষয় নেই।’