ফিলিস্তিনের গাজায় দুই বছর পর যুদ্ধবিরতি চুক্তির মধ্য দিয়ে থামল ইসরায়েলের নৃশংসতা। বন্ধ হয়েছে নির্বিচার হামলা। আসতে শুরু করেছে ত্রাণ। ধ্বংসস্তূপ হলেও নিজভূমে ফিরতে পারছেন কয়েক দফায় বাস্তুচ্যুতরা। উপত্যকাটির বাসিন্দাদের মধ্যে এখন এটিই কিছুটা স্বস্তি দিচ্ছে। ইসরায়েলিদের মধ্যেও আনন্দের রেশটা কম নয়। সমঝোতা অনুযায়ী সোমবার নাগাদ মুক্তি পাচ্ছেন হামাসের হাতে জিম্মি ইসরায়েলিরা। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর তারা মিলিত হতে যাচ্ছেন স্বজনদের সঙ্গে। ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে এ যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রথম ধাপ সম্পন্ন হওয়ায় যেমন স্বস্তি, আশাবাদ আছে, তেমনি নানা ঝুঁকিও রয়ে গেছে। বিরোধ নিয়ে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে— হামাস অস্ত্র সমর্পণ করবে কি না, ইসরায়েল দখলদারিত্ব থামবে কি না। এ অবস্থায় স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা অনেকটাই ঝুঁকির মুখে পড়েছে। এরপরও সমঝোতার চেষ্টা চলছে। এসব নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন হুমায়ূন কবির
ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে শান্তিচুক্তির প্রথম ধাপ সম্পন্নের পর সব শর্ত ও প্রস্তাব নিয়ে সমঝোতা হয়েছে। এরপর দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা শুরু হবে। এগুলো মূলত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০ দফা শান্তিচুক্তি পরিকল্পনার অংশ। ওই পরিকল্পনার অন্যতম প্রধান দাবি হামাসকে অস্ত্র ত্যাগ করতে হবে। তবে এখন পর্যন্ত গোষ্ঠীটি সেই দাবিতে সাড়া দেয়নি। এমনকি যতক্ষণ ইসরায়েলি সেনা ফিলিস্তিনের ভূমি না ত্যাগ করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা নিরস্ত্রীকরণ নিয়ে আলোচনা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। হামাস ইসরায়েলি বাহিনী প্রত্যাহারের নিশ্চয়তা চায়।
মতপার্থক্য
আরব দেশগুলোর দাবি, এ পরিকল্পনার ফলে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত হতে হবে। অন্যদিকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেছেন, এটি কখনোই ঘটবে না। তার এ ঘোষণায় স্বাধীন ফিলিস্তিনের স্বপ্ন ভেস্তে দেওয়ার ইঙ্গিত রয়েছে। হামাস বলেছে, তারা গাজার শাসন ব্যবস্থা শুধু ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে এবং আরব ও মুসলিম দেশ সমর্থিত একটি ফিলিস্তিনি টেকনোক্র্যাট সরকারের হাতে ছেড়ে দেবে। সংগঠনটি যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের নেতৃত্বে কোনো কর্তৃপক্ষ কিংবা বিদেশি কোনো শাসন মানবে না।
পরে কী ঘটতে পারে
চুক্তির ফলে যুদ্ধ শেষ করার প্রত্যাশা করা হলেও যুদ্ধ বন্ধের সময় নির্ধারণ, গাজা উপত্যকার জন্য যুদ্ধোত্তর প্রশাসন এবং হামাসের ভাগ্যসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখনো স্পষ্ট করা হয়নি। যুদ্ধ শেষ হলে গাজা কে শাসন করবে, তার কোনো স্পষ্ট ইঙ্গিত নেই। গাজা শাসনের ক্ষেত্রে ট্রাম্প, নেতানিয়াহু, পশ্চিমা বিশ্ব এবং আরব রাষ্ট্রগুলো হামাসকে যুক্ত থাকার বিষয়টি বাতিল করে দিয়েছে। অন্যদিকে ট্রাম্পের মূল পরিকল্পনায় যে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ গঠনের কথা বলা হয়েছে, তা হামাস মেনে নেবে কি না, তাতেও সন্দেহ রয়ে গেছে। একটি সূত্র জানিয়েছে, তবে ইসরায়েলি মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের সময় কিছু জটিলতা তৈরি হতে পারে। ফিলিস্তিনি সূত্র জানিয়েছে, রোব বা সোমবার ইসরায়েল প্রায় দুই হাজার ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেবে বলে আশা করা হচ্ছে। এক ইসরায়েলি কর্মকর্তা বলেছেন, শিগগির প্রতিদিন ৬০০ ট্রাক গাজায় প্রবেশ শুরু করবে।
যে লড়াই এখনো শেষ হয়নি
বিবিসি জানায়, চুক্তিটি গাজায় দুই বছর ধরে চলমান যুদ্ধের অবসান ঘটানোর কাছাকাছি নিয়ে এসেছে, তবে ইসরায়েলের হামলা এখনো বন্ধ হয়নি, তা ঘটবে কি না, তার কোনো গ্যারান্টিও নেই। অবশ্য গাজায় ফিলিস্তিনিরা এরই মধ্যে চুক্তি উদযাপন করেছে। তাদের আশা, এ চুক্তিই দুর্ভোগের অবসান ঘটাবে। তেল আবিবেও জিম্মি ইসরায়েলিদের পরিবারের লোকেরা হোস্টেজেস স্কোয়ারে জড়ো হয়। তারাও আশাবাদী, জিম্মি স্বজন দেশে ফিরে আসবে। হামাস গ্যারান্টি দাবি করেছে, জিম্মিদের ফিরিয়ে দেওয়ার পর ইসরায়েল যাতে যুদ্ধ ফের শুরু না করে।
স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার সেরা সুযোগ
দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে তীব্র সংঘাতের অবসান ঘটাতে অনেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট চেষ্টা করেছেন। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলা ও ইসরায়েলের পাল্টা হামলা শুরুর পর টানা দুই বছর নৃশংস হত্যাকাণ্ড চলেছে গাজায়। অবশেষে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি সফলতার মুখ দেখলেন। তার প্রচেষ্টায় গাজায় শান্তিচুক্তি করা সম্ভব হয়েছে। হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে সমঝোতার ফলে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন যুগের সূচনা হতে চলেছে। আশা করা হচ্ছে, এ শান্তি প্রক্রিয়া একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গিও উন্মোচন করবে। ১৯৯৩ ও ১৯৯৫ সালের অসলো শান্তিচুক্তির পর এটি হবে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার সেরা সুযোগ। অসলো-১ চুক্তি ছিল গোপন আলোচনার ফল, যাতে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) ও ইসরায়েল পরস্পরকে স্বীকৃতি দেয়। পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকা থেকে পর্যায়ক্রমে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারের জন্য একটি কাঠামো নির্ধারণ করে। আর অসলো-২ চুক্তি ফিলিস্তিনি শাসনকে আরও সম্প্রসারণ করে এবং পশ্চিম তীরকে তিনটি প্রশাসনিক অঞ্চলে ভাগ করে। এবারের চুক্তি অসলো চুক্তির পদ্ধতি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এই চুক্তির ফলে মানচিত্র ও দুটি রাষ্ট্রের কাল্পনিক সাংবিধানিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন এসেছে। চুক্তিটি একটি বাস্তব পদ্ধতির প্রতিশ্রুতি দেয়, যেখানে গাজা শাসিত হবে একটি নতুন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে এবং বিধ্বস্ত গাজা পুনর্নির্মাণ করা হবে। তবে স্থায়ী শান্তির পথে এখনো নানা বাধা রয়েছে। সেগুলো আরও জটিল হতে পারে। গাজা পুনর্গঠন করতে গিয়ে উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের নতুন অর্থনৈতিক সম্পর্ক তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে, যা বাণিজ্য ও কর্মসংস্থানের পথ তৈরি করবে। সিরিয়া ও লেবাননের সঙ্গেও ফিলিস্তিনি নেতাদের নতুন সম্পর্ক তৈরি হতে পারে। তবে কারও ভাবা উচিত নয়, এ কাজগুলো সহজ হবে।
স্বাধীন ফিলিস্তিন ছাড়া সংকটের সমাধান হবে না
মিডল ইস্ট আই এক নিবন্ধে বলেছে, গাজায় দুই বছর ধরে ইসরায়েলের জাতিগত নিধন বিশ্বের মানুষ দেখেছে। ফিলিস্তিনিরা ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছে। কিন্তু স্বাধীন দেশের স্বপ্ন এখনো তাদের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। যতদিন না স্বাধীন ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠা হচ্ছে, ততদিন ফিলিস্তিনিদের সংগ্রাম চলবে। ইসরায়েলের অবিরাম হামলা, হত্যাযজ্ঞ ও দুর্ভিক্ষ উপেক্ষা করে গাজাবাসী যে প্রাণশক্তির পরিচয় দিয়েছে, তাতে করে স্বাধীন ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম যে অব্যাহত থাকবে, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। অন্যদিকে, ইসরায়েলের দখলদারি যতদিন চলবে, ততদিন ওই অঞ্চলের উত্তেজনা শেষ হবে না। তাই স্বাধীন ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠা এবং দখলদারিত্ব বন্ধ করা ছাড়া শান্তি আসবে না। তবে এখনো স্বাধীন ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠার আলোচনা শুরু হয়নি।
মন্তব্য করুন