বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা বর্তমানে সংকটের এমন এক খাদের কিনারায় পৌঁছে গেছে, যেখান থেকে অবিলম্বে ঘুরে দাঁড়ানো অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। স্বাস্থ্যব্যবস্থায় বিদ্যমান অসংখ্য এবং বহুমুখী চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে অন্যতম পদ্ধতিগত অদক্ষতা ও অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা পরিকাঠামো ছাড়াও রয়েছে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে বাধা ও বৈষম্য, বিশেষ করে গ্রামীণ এবং সুবিধাবঞ্চিত অঞ্চলগুলোতে। এ সমস্যাগুলোর কারণে স্বাস্থ্য খাতে টেকসই অর্থায়নের মডেলগুলো বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, যা জনসাধারণের ওপর আর্থিক বোঝা চাপিয়ে দিয়ে তাদের দুর্ভাগ্যজনক স্বাস্থ্য ব্যয়ের দিকে চালিত করে যার ফলে অনেক পরিবার ক্রমেই দরিদ্র থেকে দরিদ্রতম অবস্থার দিকে ধাবিত হয়।
চারদিকে যখন জোরেশোরে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সংস্কারের কথা উঠছে, চলুন এ ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জগুলো আসলে কী এবং কতটা গুরুতর তা জেনে নেওয়া যাক। প্রথমেই চলে আসে পদ্ধতিগত অদক্ষতা এবং বৈষম্যের (systematic inefficiency and disparities) বিষয়টি। পদ্ধতিগত অদক্ষতার মধ্যে পড়েÑখণ্ডিত স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, সেবা প্রদানকারীদের মধ্যে দুর্বল সমন্বয় এবং সম্পদের অসম বণ্টন। ফলে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা এবং পর্যাপ্ত চিকিৎসা প্রদান কঠিন হয়ে পড়ে যার নেতিবাচক ফলÑদুর্বল জনস্বাস্থ্য। গ্রামীণ ও সুবিধাবঞ্চিত অঞ্চলগুলোতে এ সমস্যা প্রকট, যেখানে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে নিদারুণ আর্থিক সীমাবদ্ধতা বিরাজমান। এতে গ্রামীণ এবং শহরাঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। সংস্কার ছাড়া এ বৈষম্য বাড়তেই থাকবে এবং দেশের মোট জনসংখ্যার একটি বড় অংশ প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবার বাইরে থাকবে।
বৈশ্বিক স্বাস্থ্যমান পূরণ (meeting global standards) আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (SDGs) অংশ হিসেবে সার্বজনীন স্বাস্থ্য কভারেজ (Universal Health Coverage) অর্জনে প্রতিশ্রুতবদ্ধ। তবে বর্তমান স্বাস্থ্যব্যবস্থা এ বৈশ্বিক প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণ করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যাপক, ন্যায়সংগত এবং উচ্চমানের স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানে প্রস্তুত নয়। অদক্ষতা, প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবার অভাব এবং অসংগতিপূর্ণ স্বাস্থ্য পরিচর্যার মান প্রমাণ করে বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে বৈশ্বিক মান ও সর্বোত্তম অনুশীলনে ঘাটতি রয়েছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে এই মানগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ার জন্য অবিলম্বে সংস্কার প্রয়োজন, যাতে প্রত্যেক নাগরিককে আর্থসামাজিক অবস্থা, কিংবা ভৌগোলিক অবস্থান নির্বিশেষে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবায় প্রবেশাধিকার (Access) নিশ্চিত করা যায়।
এরপর আসে নৈতিক বাধ্যবাধকতা (fulfilling the moral imperative) পূরণ করার চ্যালেঞ্জটি। আমরা জানি, বাংলাদেশের সংবিধানে স্বাস্থ্য একটি মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃত আর তাই এ দেশের নাগরিকদের আর্থিক অসুবিধার সম্মুখীন না করে তাদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবায় প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। নিজ পকেট থেকে চিকিৎসার ব্যয়ভার (out pocket expenditure) মেটানোর ওপর বর্তমান নির্ভরতা এ দেশের মোট স্বাস্থ্যব্যয়ের ৭৪ শতাংশেরও বেশি, তাই নিঃসন্দেহে বলা যায় এটি টেকসই নয় বরং বৈষম্যমূলক। আর্থিক বোঝা এ দেশের দরিদ্র জনসাধারণের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার পথে অন্তরায়, যা এড়িয়ে যাওয়া যেত এমন সব অসুস্থতা এবং মৃত্যুর দিকে ধাবিত করে। প্রস্তাবিত সংস্কারগুলো শুধু এই আর্থিক বোঝাই লাঘবের জন্য প্রয়োজনীয় নয় বরং স্বাস্থ্যসেবা যাতে সবার জন্য সাশ্রয়ী হয় এবং প্রবেশাধিকারযোগ্য হয়, তা নিশ্চিত করা।
আরেকটি চ্যালেঞ্জ হলো স্বাস্থ্য খাতে অধিকতর অবনতি রোধ করা (preventing further deterioration)। মহামারি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং অর্থনৈতিক ধাক্কার মতো সংকটকালে স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুর্বলতাসমূহ সংস্কারের জরুরি দিকটা উন্মোচন করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কভিড-১৯ মহামারিকালে অপর্যাপ্ত পরিকাঠামো, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে বাধা এবং অপর্যাপ্ত সংকট ব্যবস্থাপনা প্রটোকলসহ জরুরি পরিস্থিতিতে সাড়া দেওয়ার স্বাস্থ্যব্যবস্থার সক্ষমতার উল্লেখযোগ্য দুর্বল দিকগুলোর উন্মোচন করেছে। সংস্কার ছাড়া, স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভবিষ্যৎ সংকট মোকাবিলায় অপ্রস্তুত থাকবে, জনসাধারণকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে। একটি অধিকতর স্থিতিস্থাপক স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য অবিলম্বে পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন যেটি জরুরি পরিস্থিতিতে সাড়া দিতে এবং সংকটকালে জনসাধারণকে সুরক্ষা দিতে সক্ষম।
এ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি স্থায়িত্ব নিশ্চিত করা (ensuring long-term sustainability) অন্যতম চ্যালেঞ্জ। বস্তুত স্বাস্থ্যব্যবস্থার দীর্ঘমেয়াদি স্থায়িত্ব ব্যাহত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। সংস্কার ব্যতীত, বর্তমান ব্যবস্থাটি তার অদক্ষতা ফেরে পড়ে স্থবির হতে থাকবে, লাখ লাখ নাগরিককে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখবে। প্রস্তাবিত সংস্কারের লক্ষ হলো টেকসই স্বাস্থ্য অর্থায়ন মডেল তৈরি করা, যেমন একটি জাতীয় স্বাস্থ্যবীমা প্রকল্প, যেটি রাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য আর্থিক সুরক্ষা প্রদান করবে এবং নিশ্চিত করবে, স্বাস্থ্যসেবা সবার জন্য প্রবেশাধিকারসাধ্য ও সাশ্রয়ী। পদ্ধতিগত অদক্ষতা এবং প্রবেশাধিকারের বাধার মূল কারণগুলোকে মোকাবিলা করে, এই সংস্কারগুলোর আরও দক্ষ, ন্যায়সংগত এবং স্থিতিস্থাপক স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
স্বাস্থ্য খাতের এ সংস্কারের জন্য সরকার, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী, সুশীল সমাজ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়সহ সব স্টেকহোল্ডারের সম্মিলিত প্রচেষ্টা আবশ্যক। প্রয়োজনীয় আইনি ও নিয়ন্ত্রণ কাঠামো প্রণয়ন, সম্পদ বরাদ্দ এবং সংস্কারগুলো কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত করার জন্য সরকারকে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসতে হবে। স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের অবশ্যই আইনি প্রক্রিয়ায় সংযুক্ত থাকতে হবে। কারণ তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ সংস্কারের সাফল্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সুশীল সমাজ সংগঠনগুলো সংস্কারের পক্ষে, গণসচেতনতা বাড়াতে এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর পৌঁছে দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সংস্কার প্রক্রিয়াকে সমর্থন করার জন্য প্রযুক্তিগত সহায়তা, অর্থায়ন এবং সর্বোত্তম অনুশীলন নিশ্চিত করতে পারে।
উপসংহারে বলা যায়, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা সংস্কার এখন সময়ের দাবি। প্রস্তাবিত সংস্কারগুলো শুধু বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যের মান পূরণের জন্য অত্যাবশ্যক নয় বরং প্রত্যেক নাগরিককে আর্থিক অসুবিধার সম্মুখীন না করে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবায় তাদের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার রাষ্ট্রের নৈতিক বাধ্যবাধকতা প্রতিপাদন করবে। তাই কালবিলম্ব না করে এখনই সংস্কারকাজে হাত দিতে হবে। সংস্কার বাস্তবায়নে বিলম্ব হলে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে পড়বে এবং লাখ লাখ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য ও কল্যাণকে বিপন্ন করে তুলবে। জরুরি ভিত্তিতে, সুদৃঢ় সংকল্প নিয়ে একসঙ্গে কাজ করে আমরা একটি ন্যায়সংগত, দক্ষ এবং স্থিতিস্থাপক স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারি, যাতে এ দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য একটি সুস্থ ও পরিপূর্ণ জীবনযাপন নিশ্চিত করা যায়।
লেখক: হেলথ সিস্টেম ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ