হালখাতা হলো বছরের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদের প্রক্রিয়া। বছরের প্রথম দিন ব্যবসায়ীরা তাদের দেনা-পাওনার হিসাব সমন্বয় করে এদিন হিসাবের নতুন খাতা খোলেন। এজন্য খদ্দেরদের বিনীতভাবে পাওনা শোধ করার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। ‘শুভ হালখাতা কার্ড’-এর মাধ্যমে ওই বিশেষ দিনে দোকানে আসার নিমন্ত্রণ জানানো হয়।
এ উপলক্ষে নববর্ষের দিন ব্যবসায়ীরা তাদের খদ্দেরদের মিষ্টিমুখ করান। খদ্দেররাও তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী পুরোনো দেনা শোধ করেন। আগেকার দিনে ব্যবসায়ীরা একটি মাত্র মোটা খাতায় তাদের যাবতীয় হিসাব লিখে রাখতেন। এ খাতাটি বৈশাখের প্রথম দিনে নতুন করে হালনাগাদ করা হতো। হিসাবের খাতা হালনাগাদ করা থেকে ‘হালখাতা’র উদ্ভব।
মূলত পহেলা বৈশাখের সকালে সনাতন ধর্মাবলম্বী দোকানি ও ব্যবসায়ীরা সিদ্ধিদাতা গণেশ ও বিত্তের দেবী লক্ষ্মীর পূজা করে থাকেন এই কামনায় যে, তাদের সারা বছর যেন ব্যবসা ভালো যায়। দেবতার পূজার্চনার পর তার পায়ে ছোঁয়ানো সিন্দুরে স্বস্তিকা চিহ্ন অঙ্কিত ও চন্দন চর্চিত খাতায় নতুন বছরের হিসাব-নিকাশ শুরু করা হয়। এই দিন ক্রেতাদের আনন্দদানের জন্য মিষ্টান্ন, ঠান্ডা পানীয় প্রভৃতির ব্যবস্থা করে থাকেন ব্যবসায়ীরা। অনেক ব্যবসায়ী অক্ষয় তৃতীয়ার দিনেও হালখাতা বা শুভ মহরত অনুষ্ঠান করে থাকেন। হালখাতা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের সেতুবন্ধ তৈরি হয়। গত শতাব্দীর ষাট ও সত্তরের দশকে পুরান ঢাকায় হিন্দু ব্যবসায়ী, বিশেষ করে পাইকারি ব্যবসায়ীদের মধ্যে হালখাতা প্রথা অনুসরণের প্রবণতা ছিল। এমনকি বেশ ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গেই পালিত হতো অসাম্প্রদায়িক এ আচার অনুষ্ঠানটি। হালনাগাদের খাতাটি ছিল লাল রঙের লালসালু কাপড়ের মলাটে মোড়ানো। দুই-তিন ভাঁজ করে তার ওপর ফিতা দিয়ে বেঁধে রেখে হাত বিনিময় হতো। এ খাতাটিই ছিল বিগত বছরের যাবতীয় হিসাবের বিবরণী নথি।
সম্রাট আকবরের বাংলা সন প্রবর্তনের সঙ্গে যুগপৎভাবে শুরু হয় হালখাতার প্রথা। ১৬১০ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীরের নির্দেশে তৎকালীন ঢাকার সুবেদার ইসলাম খান চিশতি নিজ বাসভবনের সামনে প্রজাদের মিষ্টি বিতরণ করতেন। খাজনা আদায় ও হিসাব-নিকাশের সঙ্গে সঙ্গে চলত নানা উৎসব ও হালখাতার অনুষ্ঠান। পরে ব্রিটিশ আমলে ঢাকার ফরাশগঞ্জের রূপলাল হাউস, মিটফোর্ডের নলগোলার ভাওয়াল রাজার কাচারিবাড়ী এবং পাটুয়াটুলীর সামনে প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে এরকম আয়োজন হতো পুণ্যাহ নামে। কৃষিনির্ভর সমাজে বিশেষ করে কৃষকের হাতে নগদ পয়সা আসার একমাত্র মাধ্যম ছিল ফসল বিক্রি। ফলনের মৌসুমে ফসল বিক্রির টাকা হাতে পাওয়া না গেলে কৃষকসহ ব্যবসায়ীদের সবাই খালি হাতে থাকতেন। ফলে সারা বছর তাদের বাকিতে জিনিসপত্র কিনতে হতো। এই পহেলা বৈশাখই ছিল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ যখন তারা নিজেদের বাকির টাকা পরিশোধ করতেন। কেউ কেউ কিছু পরিশোধ করে নতুন বছরের জন্য নতুন হিসাবের খাতা খুলতেন। কালের বিবর্তনে সারা দেশের মতো পুরান ঢাকায়ও হালখাতা নিয়ে উৎসাহ-উদ্দীপনায় অনেক ভাটা পড়েছে। এখন হিসাব-নিকাশ কম্পিউটারনির্ভর হওয়ায় লালসালুতে বাঁধাই করা হিসাব খাতার চল অনেকটা কমে গেছে। বলা বাহুল্য, অনেকটা ঐতিহ্য রক্ষার জন্যই এখন হালখাতার আয়োজন চোখে পড়ে।
মন্তব্য করুন