চলে গেলেন বরেণ্য শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। শুক্রবার (১০ অক্টোবর) বিকেল ৫টায় রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের মৃত্যুতে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নেমেছে শোকের ছায়া। সারা দেশের মানুষের মতো কালবেলা পরিবারও শোকাহত। আমরা মরহুমের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি।
সিলেট শহরে অনেকটা জায়গাজুড়ে তাদের বাড়িটিতে ছিল ফল আর ফুলগাছে ঘেরা ছায়াময় মায়াবী নিসর্গ। বাড়ির দরজা খুললেই মণিপুরী রাজবাড়ি। মণিপুরীদের বর্ণাঢ্য সব উৎসব—দোল পূর্ণিমা, রাস পূর্ণিমা, অর্চনা; আর সেসব উৎসবে নাচগান সব বাড়িতে বসেই দেখা যেত। সাম্প্রদায়িক সখ্য ও সম্প্রীতির সেই পরিবেশে বেড়ে ওঠা তার।
ছাত্র ছিলেন ইংরেজির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে আড্ডা জমত চারুকলায়। শিল্পী সফিউদ্দিন আহমেদ বিশেষ স্নেহ করতেন। ছবির প্রতি অদম্য আগ্রহ থেকে চারুকলায় জয়নুল আবেদিনের অনুমতি নিয়ে ক্লাসে বসে কাজ দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন উৎসাহ দিয়েছিলেন তাকে। ফলে টেক্সচার, আলোছায়া, স্কেচ, লিথোগ্রাফি, প্রিন্ট, জলরংসহ শিল্পকলার করণকৌশল খুব ভালোভাবেই রপ্ত হয়েছিল। তখনকার জনপ্রিয় দৈনিক সংবাদে প্রথম লেখা শিল্পী পাবলো পিকাসোকে নিয়ে। সন্তোষ গুপ্ত ও আবুল হাসনাত বিশেষ উৎসাহ দিয়েছিলেন। পিঠ চাপড়ে প্রশংসা করেছিলেন পটুয়া কামরুল হাসান। ১২ বছর একনাগাড়ে সংবাদে লিখেছেন। জনপ্রিয় এই কলাম: ‘অলস দিনের হাওয়া’।
নিউমার্কেট থেকে অনেক বই কিনতেন অবিশ্বাস্য দামে; সেটাও টাকা বাঁচিয়ে, আজকাল যা অসম্ভব। জীবনের একটা সারল্য ছিল সে সময়ে। বইয়ের মতো শিল্পকলা তার আরেক অচ্ছেদ্য নেশা। লিখেছেন এ নিয়ে প্রচুর। শিল্প-সমালোচনা করছেন দীর্ঘ সময় ধরে। তিনি মাইকেল মধুসূদন দত্ত, কাজী নজরুল ইসলাম, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, সমর সেন ও শামসুর রাহমানের সাহিত্য নিয়ে গভীর সমালোচনামূলক কাজ করেছেন। ১৯৯৬ সালে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হন। তার ছোটগল্প সংকলন ‘প্রেম ও প্রার্থনার গল্প’(২০০৫) প্রথম আলোর বর্ষসেরা বই হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল।
১৯৭৩ সালে তিনি লেখেন প্রথম উপন্যাস। ‘বিশাল মৃত্যু’। একাধারে শিক্ষক, লেখক, ঔপন্যাসিক, অনুবাদক, কলামিস্ট, শিল্প-সমালোচক। মুকুটে অনেক পালক। সব কটিই প্রোজ্জ্বল। ঢাকা ও কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছে তার প্রবন্ধ, গল্পসংকলন, উপন্যাস। সুরজিৎ ঘোষের উদ্যোগে কলকাতার প্রমা থেকে বেরোয় ‘থাকা না থাকার গল্প’। মহাশ্বেতা দেবী, আবুল বাশার ও সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের যৌথ সংকলন। বিচিন্তা পত্রিকাসহ অন্যান্য পত্রিকায় তার গল্প, উপন্যাস বেরিয়েছে।
সৈয়দ মনজুরুর ইসলাম একলা চলার দিন শেষ করেন ১৯৭৬ সালের ২০ জুন। স্ত্রী সানজিদা ইসলাম। তার বিষয়ও ইংরেজি সাহিত্য। কর্মক্ষেত্রে তিনিও একজন সফল মানুষ। স্টাইল নিয়ে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের নিজস্ব ভাবনা ছিল। একটু গাঢ় রঙে ঝোঁক ছিল। সবুজ, মেরুন, নীল। আটপৌরে থাকতেই ভালোবাসতেন তিনি। পিএইচডির সমাবর্তনে কোট-টাই পরে রীতিমতো হাঁসফাঁস করেছেন। শার্ট, প্যান্ট, পাঞ্জাবিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। ভালোবাসতেন বৃষ্টি আর গান। লালন, হাসন রাজা, নজরুল, হারানো দিনের গান, রবীন্দ্রসংগীত। আর স্বপ্ন দেখতেন একটু অলস প্রহরের। বলা যেতে পারে আলস্যবিলাস! কিন্তু সেটি আকাশকুসুম ভাবনা হয়েই থেকে গেছে। কাজের পর কাজ, প্রহর আর শেষ হয়নি। এখন তার অন্তহীন বিশ্রাম। এখন তিনি আমাদের সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবে তিনি বেঁচে থাকবেন তার বিচিত্র সৃষ্টিকর্মের মধ্যে।
মন্তব্য করুন