বেন রাইফ
প্রকাশ : ১২ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১২ অক্টোবর ২০২৫, ১১:১৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

নিজের স্বার্থেই কি অস্ত্রবিরতি নেতানিয়াহুর

নিজের স্বার্থেই কি অস্ত্রবিরতি নেতানিয়াহুর

গাজায় শিশু, সাংবাদিক আর উদ্ধারকর্মী—যারা গত দুই বছর ধরে নিজের চোখের সামনে সহকর্মী ও আপনজনদের মরতে দেখেছে—এখন কিছুটা আশায় বুক বাঁধছে। তাদের কাছে হয়তো মনে হচ্ছে, দুঃস্বপ্নটা এবার শেষের দিকে।

একইভাবে ইসরায়েলি জিম্মিদের পরিবারের লোকজন—যারা ভেবেছিল, হয়তো আর কখনো প্রিয়জনকে ফিরে পাবে না—তাদের মধ্যেও এখন স্বস্তি। এ স্বস্তি আমাদেরও স্পর্শ করে। তবু, এ অস্ত্রবিরতির ভবিষ্যৎ কতটা স্থায়ী হবে—সেই প্রশ্ন থেকে যায়।

এর আগেও এমন সময় এসেছে। জানুয়ারির এক ভিডিও এখনো চোখে ভাসে, যেখানে ২৮ বছর বয়সী আলজাজিরার সাংবাদিক আনাস আল-শারিফ লাইভ সম্প্রচারে নিজের প্রেস ভেস্ট আর হেলমেট খুলে ফেলে আনন্দে ভেসে যাওয়া ভিড়ের মধ্যে উঠে দাঁড়ায়। সেই অস্ত্রবিরতি তখন অনেককেই মুক্তি এনে দিয়েছিল। গাজায় খানিকটা স্বস্তিও এসেছিল। কিন্তু মাত্র দুই মাস পরই ইসরায়েল সেই চুক্তিকে ছিঁড়ে ফেলে। এক রাতেই তারা গাজায় শতাধিক বিমান হামলা চালায়। মারা যায় চার শতাধিক ফিলিস্তিনি। পাঁচ মাসের মাথায় গাজার এক হাসপাতালের বাইরে সাংবাদিকদের একটি তাঁবুতে বোমা পড়ে। মারা যান আনাস আল-শারিফসহ ছয়জন সাংবাদিক।

আজকের অস্ত্রবিরতির মধ্যেও সেই স্মৃতি ফিরে আসে। হ্যাঁ, খারাপ চুক্তি হলেও তা কোনো চুক্তি না থাকার চেয়ে ভালো—বিশেষ করে যখন গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প আর টনি ব্লেয়ারের মতো লোকরা মাঝখানে থাকেন। তবু উদ্বেগটা বাড়ে যখন দেখি, সরকারি ভাষ্য ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছে।

ট্রাম্প বুধবার রাতে বলেন, ‘এটা প্রথম ধাপ’। অথচ এই শব্দগুচ্ছ চুক্তির লেখায় কোথাও নেই। বরং শুনতে অনেকটা জানুয়ারির সেই চুক্তির মতো, যেটিকে ইসরায়েল পরে ব্যবহার করেছিল যুদ্ধ আবার শুরুর পথ তৈরিতে। এই ধোঁয়াটে ভাষা ইচ্ছাকৃত। ইসরায়েলি মিডিয়ায় নেতানিয়াহুর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত সাংবাদিক আমিত সেগাল পরদিন বলেন, ‘দ্বিতীয় ধাপ বলে আসলে কিছু নেই। এটা সবাই জানে। ভবিষ্যতে কিছু হতে পারে, কিন্তু এই চুক্তির সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই।’ এ কথায় কি বোঝা যায় নেতানিয়াহু ঠিক আগের মতোই পরিকল্পনা করছেন—জিম্মিদের মুক্তির পর আবার যুদ্ধ শুরু করতে? এ ধরনের ধারণা অমূলক নয়। কারণ, নেতানিয়াহু বরাবরই একসঙ্গে অনেক হিসাব কষতে জানেন।

তার চিন্তা-ভাবনা বুঝতে গেলে আগে দেখতে হবে কোন কোন বিষয়ের প্রভাব পড়ে তার সিদ্ধান্তে। প্রথমত, তার নিজের বিচার চলছে—ঘুষ, জালিয়াতি আর বিশ্বাস ভঙ্গের অভিযোগে। দোষ প্রমাণ হলে বড় শাস্তি হতে পারে। তাই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থাকা তার জন্য জীবন-মরণ প্রশ্নে দাঁড়িয়েছে। এ কারণেই ২০২২ সালের নির্বাচনের আগে তিনি চরমপন্থি ধর্মীয় দলগুলোর সঙ্গে জোট বাঁধেন। সরকার গঠনের পরও আদালতের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে তার সরকার বারবার আঘাত করেছে।

দ্বিতীয়ত, তিনি রাজনীতিতে এসেছিলেন একটাই লক্ষ্য নিয়ে—যাতে কোনোদিন একটা স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গড়ে না ওঠে।

নব্বইয়ের দশকে প্রথম ক্ষমতায় এসে তিনি অসলো শান্তিচুক্তিকে ধ্বংস করেন। পরে আমেরিকার শান্তি উদ্যোগে লোক দেখানো সায় দিলেও ধীরে ধীরে পশ্চিম তীরে বসতি গড়ে তা গিলে খেয়েছেন।

গত ৭ অক্টোবরের পর এই দুই উদ্দেশ্য একাকার হয়ে গেছে। ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আঘাতের মুখে পড়ে ইসরায়েল যখন স্তব্ধ, নেতানিয়াহুর জনপ্রিয়তা তখন তলানিতে। ক্ষমতায় টিকে থাকতে গিয়ে তিনি গাজায় এমন এক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন, যার শেষ কোথায়, সেটা কেউ জানে না।

এই লড়াই তাকে কিছুটা পুরোনো ভাবমূর্তি ফিরিয়ে দেয়; কিন্তু বিনিময়ে চলে যায় অসংখ্য জীবন।

এবং সেজন্যই, তিনি বারবার আলোচনা ভেঙেছেন, জানুয়ারির চুক্তিও নিজে থেকে বাতিল করেছেন।

নেতানিয়াহু দীর্ঘদিন ধরে ‘সংঘাতকে নিয়ন্ত্রণে রাখা’র যে নীতি মেনে চলছিলেন—ফিলিস্তিনিদের দমন করেই শান্তি টিকিয়ে রাখা যায়, এমন ধারণা নিয়ে—তা এখন নতুন এক মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। গাজা থেকে ২০ লাখ মানুষকে চিরতরে সরিয়ে দেওয়ার সুযোগ দেখে তিনি মুখ ঘুরিয়ে নেন আরও চরমপন্থার দিকে।

ট্রাম্প যখন ‘গাজা রিভিয়েরা’র স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন, তখন নেতানিয়াহু এ বিতাড়নের লক্ষ্যকে প্রকাশ্যেই আপন করে নেন। তিনি নানা পথে চেষ্টা করেন—ফিলিস্তিনিদের চেপে ধরতে, তাদের ঠেলে দিতে। কিন্তু বাস্তবতা তাকে থামিয়ে দেয়। মিশরের কড়া সীমান্ত আর বিশ্ববাসীর নির্লিপ্ততা—যারা গাজার লাখ লাখ শরণার্থীকে নিতে রাজি নয়—এ বাস্তবতাই তার স্বপ্নকে আটকে দেয়।

এ অবস্থায় নেতানিয়াহু আবার পথ পাল্টে অস্ত্রবিরতিতে রাজি হয়েছেন। গাজা থেকে মানুষ সরানোর প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছে। ইসরায়েল আজ বিশ্বমঞ্চে ক্রমেই একঘরে। তার দেশে সম্মান কমছে, বাইরে আস্থা কমছে। জাতিসংঘে যেসব ‘সামরিক সাফল্য’র কথা তিনি বলেছেন, তা দিয়েও জনপ্রিয়তা বাড়ছে না। সামনে নির্বাচন। এখন তিনি মনে করছেন, যুদ্ধ থামিয়ে গাজায় একতরফা বিজয়ের ঘোষণা দেওয়া—তাতে হয়তো ভোটে সুবিধা হবে। যদি চরমপন্থিরা তার জোট ছাড়েও তিনি হয়তো ‘জাতীয় দায়বদ্ধতার’ নামে আগের কোনো মিত্রকেই টেনে আনবেন।

ইসরায়েলি জিম্মিদের ফেরানোর মুহূর্ত আর ট্রাম্পের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার সুযোগ—নেতানিয়াহুর প্রচারে তা যথেষ্ট কাজে লাগবে। যদি এ অস্ত্রবিরতিই নতুন করে সৌদি আরব, ইন্দোনেশিয়া বা এমনকি সিরিয়ার সঙ্গেও সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পথ খুলে দেয়, তাও নেতানিয়াহুর জন্য রাজনৈতিক সাফল্য হয়ে থাকবে। তবে চুক্তিটিকে ধাপে ধাপে বাস্তবায়নের যে পদ্ধতি রাখা হয়েছে, সেটাই ইঙ্গিত দেয়—এই পথ তিনি মাঝপথে ছেড়ে দিতে পারেন।

যে মানুষটা নিজে কখনো ফিলিস্তিনিদের জন্য ‘একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন’ বিশ্বাস করেননি, তিনি তো এই চুক্তিতে থাকা ‘স্বাধীনতার পথে বিশ্বাসযোগ্য অগ্রগতি’র প্রতিশ্রুতি মানার কথাও ভাববেন না।

এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আর নীরব থাকতে পারে না। গত দুই বছর ধরে যারা চোখ বন্ধ করে গাজার ধ্বংসযজ্ঞ দেখেছে, তারা এখনই হস্তক্ষেপ না করলে এ চুক্তিও শেষ হয়ে যাবে আগের মতো।

এ দায়িত্ব শুধু গাজায় সীমাবদ্ধ নয়। পশ্চিম তীরেও গত দুই বছরে হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। একদিকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়া আর অন্যদিকে চোখের সামনে বসত উজাড় হওয়া—এই দ্বিচারিতা বন্ধ না হলে কোনো স্বীকৃতিরই মূল্য থাকবে না।

ইসরায়েলের সমাজে যে উগ্র উন্মাদনা দানা বেঁধেছে, তা রাতারাতি থামবে না। তাই ইসরায়েলি মানবাধিকার সংস্থা বেটসেলেম সতর্ক করে বলেছে—‘গণহত্যার রূপ’ সহজেই পশ্চিম তীরেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।

আর যদি অস্ত্রবিরতি টিকে যায়, তবুও ৭ অক্টোবরের আগের যে ‘সব ঠিক চলছে’ এমন ভ্রম ছিল, সেখানে ফেরা যাবে না। যে ভয়াবহতা ঘটেছে, তা বিচার চাই। যারা মারা গেছে, তাদের জন্য ন্যায়বিচার চাই। গাজা আবার গড়ে তুলতে হবে। আর ফিলিস্তিনিদের মুক্ত করতে হবে সেই নিয়ন্ত্রণ থেকে, যা এতদিন ধরে তাদের দমিয়ে রেখেছে।

লেখক: ইসরায়েল-ফিলিস্তিনবিষয়ক ‘+৯৭২ ম্যাগাজিন’-এর সিনিয়র সম্পাদক। নিবন্ধটি দ্য গার্ডিয়ানের মতামত বিভাগ থেকে অনুবাদ করেছেন তারেক খান

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

রেড ক্রিসেন্টে মব করার অভিযোগে এনসিপি নেতাকে অব্যাহতি

নাসিরের অলরাউন্ড নৈপুণ্যে আবারও এনসিএল শিরোপা রংপুরের ঘরে

কিশোরগঞ্জ থাকবে ঢাকাতেই, ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ

মক্কায় ১২৫ কিমি এলাকাজুড়ে স্বর্ণের খনির সন্ধান 

অগ্রযাত্রায় নবীন শিক্ষকদের অবদান রাখতে হবে : খুবি উপাচার্য

কক্সবাজার সৈকত থেকে অর্ধশতাধিক টংঘর উচ্ছেদ

১২ থেকে ১৫ ঘণ্টার মধ্যেই রাকসু নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ : ভিসি

কুলদীপের ঘূর্ণিতে ফলোঅন, তবু লড়াইয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ

শেবাচিমে আধুনিক ল্যাবরেটরি মেডিসিন বিভাগ চালু

যমুনা টিভির সিইওকে নিয়ে মিথ্যাচার

১০

রিজওয়ান-সালমানের জুটিতে প্রথম দিনে স্বস্তিতে পাকিস্তান

১১

বিএনপি ক্ষমতায় গেলে ৩১ দফার ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালিত হবে : দুলু

১২

লিবিয়ার উপকূলে ৬১ অভিবাসীর মরদেহ উদ্ধার

১৩

উপদেষ্টার পরিদর্শনের পর ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে নেই যানজট

১৪

যুবককে খুঁটিতে বেঁধে মারধর, গায়ে আগুন দিয়ে হত্যাচেষ্টা

১৫

দোহায় হতে যাচ্ছে স্পেন-আর্জেন্টিনার বহু প্রতীক্ষিত ফিনালিসিমা!

১৬

অস্থায়ী ভিসার ৮২ পেশার তালিকা তৈরি করেছে যুক্তরাজ্য

১৭

মাউশি ভেঙে হচ্ছে পৃথক অধিদপ্তর, নাম কী?

১৮

আমি ষড়যন্ত্রের শিকার : ছাত্রদল নেতা শাওন

১৯

আফগানিস্তানের ২০০’র বেশি সৈন্য নিহত, পাকিস্তানির দাবি

২০
X