প্রিয় বন্ধু, সহকর্মী ও মহান শিক্ষক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের প্রয়াণে আমরা গভীর শোক ও বেদনায় স্তব্ধ। হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসা এক বেদনাভরা সত্য আজ মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে—মনজুর ভাই আর নেই।
আমি জানি, এই লেখা তার কাছে পৌঁছাবে না। তবু লিখছি, কারণ তাকে হারানোর এই বাস্তবতাকে মেনে নেওয়া আমার পক্ষে কঠিন। আমার অনেক অভিযোগ আছে তার প্রতি—তিনটি বড় অভিযোগ। প্রথমত, অসুস্থতার দীর্ঘ লড়াই থেকে তিনি ধীরে ধীরে সুস্থতার পথে ফিরছিলেন, আমরা সবাই আশায় বুক বাঁধছিলাম যে, তিনি আবার ফিরে আসবেন আমাদের মাঝে। কিন্তু হঠাৎই সেই আশার সমস্ত সুতো ছিঁড়ে দিয়ে তিনি চলে গেলেন। দ্বিতীয়ত, আমি প্রশ্ন রাখি—এই কি যাওয়ার সময় ছিল তার? আগামী জানুয়ারিতেই তার ৭৫ বছর পূর্ণ হতো। ৭৫ কি এমন কোনো বয়স, যেখানে চলে যেতে হয়? কেন তাকে ৭৫-এর আগেই চলে যেতে হলো? তৃতীয় অভিযোগটি আরও ব্যক্তিগত—আমরা যারা তার কাছাকাছি বয়সী, তাকে নিয়ে গোপনে ঈর্ষা করতাম; তার পাণ্ডিত্য বা মননের জন্য নয়, বরং তার অদম্য তারুণ্যের জন্য। সত্তরোর্ধ্ব হয়েও তিনি ছিলেন ছিপছিপে, প্রাণবন্ত, নির্মেদ এক তরুণ। সময়ের সঙ্গে আমরা বদলে গেছি, কিন্তু তিনি বদলাননি। সেই তরুণ প্রাণটাই আজ নিভে গেছে—এটাই সবচেয়ে কঠিন গ্রহণ।
কিন্তু এই তাৎক্ষণিক অভিমান ছাড়াও আছে আরও কিছু অভিযোগ, আরও গভীর বেদনার কথা, যা গড়ে উঠেছিল আমাদের পঞ্চাশ বছরের বন্ধুত্বের পরতে পরতে। মনজুর ভাইয়ের মেধা, উদারতা, শৃঙ্খলা ও মননের গভীরতা প্রায়ই আমার জীবনে যন্ত্রণা হয়ে ফিরে এসেছে, কারণ তার প্রেরণা ও প্রত্যাশার উচ্চতা আমাকে বারবার নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। আমরা দুজনই তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক—তিনি ইংরেজি বিভাগে, আমি অর্থনীতি বিভাগে। তার নিয়মতান্ত্রিক লেখা পাঠকের মন জয় করছিল, আমিও এখানে-সেখানে লিখতাম। হঠাৎ একদিন প্রয়াত অধ্যাপক বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর সাহেব কলাভবনের নিচে আমাকে বললেন, ‘তুমি সমাজ নিরীক্ষণের জন্য লেখো, মনজুর বলেছে তুমি সমাজ ও অর্থনীতি নিয়ে ভালো লেখো।’ আমি হতবাক—এ কোন ফাঁদে ফেললেন মনজুর ভাই! একবার লেখার পর বোরহান স্যার বারবার নতুন লেখা চাইতেন। আমি পালিয়ে বেড়াতাম; কিন্তু রেহাই পেতাম না। তখন বিরক্ত হয়ে তাকেই দোষারোপ করতাম। কিন্তু আজ মনে হয়, সেই তাগিদটাই ছিল আশীর্বাদ—কারণ তারই উৎসাহে সমাজ নিরীক্ষণ কেন্দ্র থেকেই আমার প্রথম বই ‘প্রসঙ্গ: উন্নয়ন ও পরিকল্পনা’ প্রকাশিত হয়েছিল।
মনজুর ভাইয়ের সঙ্গে আমার সেই সাহিত্যিক সময়গুলোর স্মৃতি এখন অমূল্য। তখন সংবাদ সাহিত্য সাময়িকীতে তিনি লিখতেন ‘অলস দিনের হাওয়া’, আমি লিখতাম ‘কড়ি-কড়চা’। তার লেখা নিয়মিতভাবে পৌঁছে যেত রোববারের মধ্যেই প্রয়াত আবুল হাসনাত ভাইয়ের টেবিলে, আর আমার লেখা পৌঁছাত কি না—সেটা অনিশ্চিত থাকত। একবার তো সময়মতো লেখা না দেওয়ায় আমাকে সংবাদ অফিসে আটকে চা ধরিয়ে লিখিয়ে নেওয়া হয়েছিল সন্তোষদার পরামর্শে! সম্পাদক বজলুর রহমান হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘মনজুরের মতো সময়মতো লিখে দাও না কেন?’ সেদিন মনে মনে তাকে শাপশাপান্ত করেছিলাম; কিন্তু পরে বুঝেছি—তারই মতো নিয়ম মেনে চলতে গিয়ে আমার লেখাগুলো সংরক্ষিত হয়েছিল, যা পরবর্তী সময় মফিদুল ভাই বই আকারে প্রকাশ করেছিলেন ‘অর্থনীতির কড়চা’ নামে।
তার প্রেরণার আরেকটি উদাহরণ মনে পড়ে। জাতীয় কবিতা উৎসবে তিনি পড়েছিলেন এক অসাধারণ প্রবন্ধ—‘কবিতার ভবিষ্যত’। আমি তখন কেবল মন্তব্য করেছিলাম যে, কবিতার ভবিষ্যৎ শুধু সাহিত্যিক প্রবণতায় নয়, সমাজের আর্থসামাজিক বিবর্তনেও নির্ভর করে। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বলেছিলেন, ‘তাহলে লিখে ফেলো না কেন?’ আমি দ্বিধায় ছিলাম—সাহিত্যের বিষয়ে লেখা আমার কাজ নয়। কিন্তু তার তাগাদা থামেনি—‘শুরু করো, পারবে।’ তার উৎসাহে এক দুপুরে একটানে লিখে ফেললাম ‘কবিতার ভবিষ্যত’ শিরোনামের সেই লেখা। কয়েকদিন পর সংবাদ সাহিত্য সাময়িকী খুলে দেখি, সেটি প্রথম পাতার প্রথম লেখা হিসেবে ছাপা হয়েছে, নতুন নকশায়, নতুন আঙ্গিকে। আমার জীবনের প্রথম সাহিত্যবিষয়ক লেখা—এটিও সম্ভব হয়েছিল কেবল তার কারণে।
মনজুর ভাইয়ের এই দৃঢ়তা, উৎসাহ, আর স্নেহই তাকে আমাদের সবার কাছে আলাদা করে তুলেছিল। তিনি ছিলেন শিক্ষক হিসেবে অনন্য, সহকর্মী হিসেবে অনুপ্রেরণাদায়ক, আর বন্ধু হিসেবে আশ্রয়ের মতো। তার জীবনে কোনো ভান ছিল না, কোনো অহংকার ছিল না—ছিল এক নিবেদিত মন, এক বিশুদ্ধ মানবিক সত্তা।
আজ তার চলে যাওয়ায় আমাদের জীবনে এক অপূরণীয় শূন্যতা তৈরি হলো। এই শোক কেবল এক বন্ধুর জন্য নয়, একজন আলোকবর্তিকার জন্য, যিনি আমাদের মনন, সাহিত্য, শিক্ষা ও জীবনবোধে আলোক ছড়িয়েছিলেন।
আমি জানি, তিনি আর আমার দরজায় টোকা দেবেন না। কিন্তু বিশ্বাস করি—তিনি চিরকাল আমার হৃদয়ের দরজায় টোকা দেবেন, তার মমতা, স্নেহ ও প্রেরণার আলো হয়ে।
লেখক: ইউএনডিপির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন কার্যালয় ও দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগের সাবেক পরিচালক
মন্তব্য করুন