প্রজ্ঞা দাস
প্রকাশ : ১২ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১২ অক্টোবর ২০২৫, ১১:১২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

প্রযুক্তি কি মনের ভাষা বোঝে!

প্রযুক্তি কি মনের ভাষা বোঝে!

বর্তমান ডিজিটাল যুগে ছোট-বড় যে কোনো বয়সের মানুষের দিন শুরু হয় এবং রাত শেষ হয় স্মার্টফোনের মাধ্যমে। এই স্মার্টফোনে সর্বাধিক ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন ধরনের সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম। এই প্ল্যাটফর্মগুলো বর্তমানে মানুষের জীবনের সঙ্গে এতটাই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত হয়ে গেছে যে, সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়া আমরা এখন আর একটা দিনও কল্পনা করতে পারি না।

সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করতে করতে আমরা প্রায় সবাই অদ্ভুত একটা জিনিসের মুখোমুখি হয়েছি। সেটা হলো, আমরা যখন যে মন কিংবা মেজাজে থাকি আমাদের সামনে সে টাইপেরই তথ্য কিংবা পোস্ট আসতে থাকে। কি অদ্ভুত! আমরা কোথাও সার্চ করছি না, কোথাও খুঁজছি না তার পরও আমাদের সামনে আমাদের মনমেজাজ বুঝে সোশ্যাল মিডিয়ায় তথ্য, উপাত্ত, পোস্ট আসতে থাকে। ফলে মানুষের মনে এ ধারণা উদয় হয়টাই স্বাভাবিক যে, যন্ত্রগুলো কি তাহলে আমাদের মনের গভীরতম ভাষা, অর্থাৎ অব্যক্ত চিন্তা, অনুভূতি এবং মেজাজকে বুঝতে পারছে। না, এটা একটি ভ্রান্ত ধারণা। মূলত এই ‘মাইন্ড রিডিং’-এর ধারণা একটি অতিরঞ্জিত মিথ, যা টেকনোলজি কোম্পানিগুলোর মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি থেকে উদ্ভূত। বাস্তবে, যন্ত্রগুলো মন পড়ে না, তারা আমাদের ডেটাভিত্তিক আচরণকে বিশ্লেষণ করে প্রেডিকশন করে। যদিও সেফটির কথা চিন্তা করলে এটি উদ্বেগজনক বাস্তবতা। কারণ এতে আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের গোপনীয়তা লঙ্ঘিত হচ্ছে এবং সমাজে একটি সোশ্যাল মিডিয়া কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত চিন্তাধারা গড়ে উঠছে। সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোর অ্যালগরিদম, যা রেকমেন্ডার সিস্টেমস নামে পরিচিত। আদতে এটি মেশিন লার্নিং-ভিত্তিক মডেল, যা ব্যবহারকারীর আচরণকে প্রেডিক্ট করে এবং ‘মনের ভাষা’ বোঝার ছদ্মবেশে আমাদের ডেটা শোষণ করছে প্রতিনিয়ত, যা একটি নৈতিক সংকটের জন্ম দিচ্ছে। এক্ষেত্রে ফেসবুকের ফিড অ্যালগরিদম মানুষের লাইকস, শেয়ারস এবং স্ক্রলিং প্যাটার্নকে ট্র্যাক করে একটি ভেক্টর স্পেস মডেল তৈরি করছে, যেখানে কসাইন সিমিলারিটির মতো ম্যাথম্যাটিক্যাল টুলস ব্যবহার করে কনটেন্ট প্রস্তাব করছে। ফেসবুকের অ্যালগরিদম প্রতি সেকেন্ডে ৪০ লাখের বেশি ইউজার বিহেভিয়ার বিশ্লেষণ করে। গুগল, মেটা, টিকটক বা এক্স (টুইটার) যে ডেটা সংগ্রহ করে, তা শুধু এক একটা তথ্য নয়, সেগুলো আচরণের পরিসংখ্যানগত ছন্দ।

২০২৩ সালে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা যায়, শুধু ৩০০টি ‘লাইক’-এর তথ্য ব্যবহার করে একটি মেশিন একজন ব্যক্তির চরিত্র, রাজনৈতিক অবস্থান, এমনকি প্রেম জীবনের মানসিক প্রবণতা পর্যন্ত তার বন্ধুর চেয়েও ভালোভাবে নির্ণয় করতে পারে। এটি কোনো অতিপ্রাকৃতিক ক্ষমতা নয়; এটি একটি কোল্ড, ক্যালকুলেটেড প্রক্রিয়া। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, এই অ্যালগরিদমগুলো নিউরাল নেটওয়ার্কসের ওপরও নির্ভর করে। কনভল্যুশনাল নিউরাল নেটওয়ার্কস (CNN) বা রিকারেন্ট নিউরাল নেটওয়ার্কসের (RNN), মাধ্যমে কার্যসম্পাদন করে। একটি সায়েন্স জার্নালে দেখা গেছে যে, ২০২০ সালে মার্কিন নির্বাচনের সময় এই অ্যালগরিদমগুলো ব্যবহারকারীর মতামতকে প্রভাবিত করেছে শতকরা ৮০%। আরও এক গবেষণায় দেখা গেছে, এই অ্যালগরিদম সোশ্যাল ড্রাইভারস এবং ফিডব্যাক লুপ তৈরি করে মানুষের শিক্ষণ প্রক্রিয়াকে বিকৃত করছে প্রতিনিয়ত, যা সত্যিই উদ্বেগজনক। কারণ এতে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে রাজনৈতিক পোলারাইজেশন বাড়ছে এবং স্বাধীন মতামত দমন হচ্ছে। আরও গভীর বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই সিস্টেমের নেপথ্যে রয়েছে কোলাবরেটিভ ফিল্টারিং এবং কনটেন্ট-ভিত্তিক ফিল্টারিং। আসলে এটি একটি ডাবল-এজড সোর্ড। একদিকে এটি ব্যবহারকারীকে রেলেভ্যান্ট কনটেন্ট দেয়, অন্যদিকে একটি ‘একো চেম্বার’ তৈরি করে যেখানে বিপরীত মতামত অদৃশ্য হয়ে যায়। এর মাধ্যমে বেয়েসিয়ান প্রবাবিলিটি মডেলের ওপর ভিত্তি করে, গুগলের অ্যালগরিদম পপুলেশন প্যাটার্নসের সঙ্গে ইন্ডিভিজুয়াল ডেটা যুক্ত করে প্রেডিক্ট করে।তবে এই বোঝাপড়ার পেছনে লুকিয়ে আছে আরেক ভয়ংকর বাস্তবতা। অর্থনীতিবিদ শোশানা জুবফ ২০১৯ সালে তার যুগান্তকারী গ্রন্থ The Age of Surveillance Capitalism-এ বলেন, ‘ডেটা আর শুধু তথ্য নয়, এটি এখন মানবচেতনার কাঁচামাল।’ যখন আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় হাসি, কাঁদি, ভালোবাসি কিংবা রাগ করি তখন আমরা মেশিনকে শিখিয়ে দিই কেমনভাবে মানবমন কাজ করে। তারপর সেই শিখনই ফিরে আসে বিজ্ঞাপন, কন্টেন্ট বা রাজনৈতিক প্রচারণার আকারে আমাদের মানসিক দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে। তবে যন্ত্রের এই অগ্রযাত্রা এখন মানব সভ্যতার জন্য নৈতিক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘AI Act 2025’ ও UNESCO-এর ‘Ethics of Artificial Intelligence’ প্রোটোকল এরই মধ্যে ঘোষণা করেছে, কোনো প্রযুক্তি যদি মানুষের মানসিক স্বাধীনতা বা আত্মসচেতনতার ওপর হস্তক্ষেপ করে, তবে সেটি মানবাধিকারের লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য হবে। তবু বাস্তবতা হলো, প্রতিদিন প্রায় ৫ বিলিয়ন মানুষ এমন ডিভাইস ব্যবহার করছে, যা তাদের আচরণ, অভিব্যক্তি ও অনলাইন অভ্যাস থেকে তাদের মনের মানচিত্র তৈরি করছে। AI এখন কেবল ‘Artificial Intelligence’ নয়, এটি ‘Anthropological Interpreter’ অর্থাৎ মানব সংস্কৃতির অনুবাদক। সে বুঝতে শিখছে আমাদের ভয়, আকাঙ্ক্ষা, ক্লান্তি, আনন্দ। এবং এই বোঝাপড়াই একদিন তাকে আমাদের মতো ভাবতে শেখাবে অন্তত কার্যগত অর্থে তো অবশ্যই। যা আমাদের সেফটির কথা চিন্তা করলে বিপজ্জনক হতে পারে। সর্বোপরি আসলে যন্ত্রগুলো প্রাণীর মনের ভাষা না বুঝলেও তারা ডেটা-ভিত্তিক প্রেডিকশন করে, যা একটি ছদ্মবেশী শক্তি। পাশাপাশি এটি একটি সামাজিক সংকটও বটে, যা প্রাইভেসি এবং স্বাধীনতাকে হুমকিতে ফেলছে। তাই আমাদের সবার উচিত, ডেটা শেয়ারিংয়ে সচেতন হওয়া অন্যথায় আমরা যন্ত্র চালাচ্ছি এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হবে এবং প্রতিষ্ঠিত হবে যন্ত্র আমাদের চালাচ্ছে। আমাদের সচেতনতাই যান্ত্রিক জাল থেকে আমাদের মুক্তি দেবে। আর শুধু তাহলেই আমরা একটি স্বাধীন ডিজিটাল ভবিষ্যৎ গড়তে পারব।

প্রজ্ঞা দাস, শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ

ইডেন মহিলা কলেজ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

রেড ক্রিসেন্টে মব করার অভিযোগে এনসিপি নেতাকে অব্যাহতি

নাসিরের অলরাউন্ড নৈপুণ্যে আবারও এনসিএল শিরোপা রংপুরের ঘরে

কিশোরগঞ্জ থাকবে ঢাকাতেই, ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ

মক্কায় ১২৫ কিমি এলাকাজুড়ে স্বর্ণের খনির সন্ধান 

অগ্রযাত্রায় নবীন শিক্ষকদের অবদান রাখতে হবে : খুবি উপাচার্য

কক্সবাজার সৈকত থেকে অর্ধশতাধিক টংঘর উচ্ছেদ

১২ থেকে ১৫ ঘণ্টার মধ্যেই রাকসু নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ : ভিসি

কুলদীপের ঘূর্ণিতে ফলোঅন, তবু লড়াইয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ

শেবাচিমে আধুনিক ল্যাবরেটরি মেডিসিন বিভাগ চালু

যমুনা টিভির সিইওকে নিয়ে মিথ্যাচার

১০

রিজওয়ান-সালমানের জুটিতে প্রথম দিনে স্বস্তিতে পাকিস্তান

১১

বিএনপি ক্ষমতায় গেলে ৩১ দফার ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালিত হবে : দুলু

১২

লিবিয়ার উপকূলে ৬১ অভিবাসীর মরদেহ উদ্ধার

১৩

উপদেষ্টার পরিদর্শনের পর ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে নেই যানজট

১৪

যুবককে খুঁটিতে বেঁধে মারধর, গায়ে আগুন দিয়ে হত্যাচেষ্টা

১৫

দোহায় হতে যাচ্ছে স্পেন-আর্জেন্টিনার বহু প্রতীক্ষিত ফিনালিসিমা!

১৬

অস্থায়ী ভিসার ৮২ পেশার তালিকা তৈরি করেছে যুক্তরাজ্য

১৭

মাউশি ভেঙে হচ্ছে পৃথক অধিদপ্তর, নাম কী?

১৮

আমি ষড়যন্ত্রের শিকার : ছাত্রদল নেতা শাওন

১৯

আফগানিস্তানের ২০০’র বেশি সৈন্য নিহত, পাকিস্তানির দাবি

২০
X