সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
প্রকাশ : ০৮ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৮ জুন ২০২৩, ১০:৫০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বিজ্ঞান ফিরে আসুক

বিজ্ঞান ফিরে আসুক

খবরটি ছোট করে এসেছে, তেমন একটা আলোচনা কোথাও নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে বিজ্ঞান ইউনিটের আন্ডারগ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামে ভর্তি পরীক্ষায় ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থীই ফেল করেছে। বিজ্ঞান ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে ১ লাখ ১৭ হাজার ৭৬৩ জন। এর মধ্যে পাস করেছে ১০ হাজার ৫৫৭ জন। কেউ আশ্চর্যও হচ্ছেন না এ ফলাফল দেখে। ধরেই নিয়েছেন এটাই স্বাভাবিক। বিজ্ঞান শিক্ষার এই হাল হলে দেশের উন্নতিটা কোথায় হলো—এমন প্রশ্ন তুলে রেখে বরং আলোচনা করা যায়, কেন এত ফেল করে তা নিয়ে। দেশের প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় নিম্ন পাসের হার নিয়ে আবারও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, কথা হচ্ছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মান নিয়ে।

আমাদের মনে থাকার কথা যে, ২০১৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ইংরেজি বিভাগে ভর্তির জন্য মাত্র দুজন শিক্ষার্থী পাস করেছিল। সে সময় ইংরেজি শিক্ষা নিয়ে তুমুল হৈচৈ হয়েছিল। এবার আমরা হতবাক হতে চাচ্ছি বিজ্ঞান ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় ৯০ ভাগ শিক্ষার্থী পাস নম্বর তুলতে না পারা নিয়ে। ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের এ ফলাফলে প্রশ্ন দেখা দেয় হাজার হাজার জিপিএ ৫, গোল্ডেন জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর শিক্ষার মান এবং যোগ্যতা নিয়ে। সেইসঙ্গে প্রশ্নের মুখে পড়ে দেশের গোটা শিক্ষাব্যবস্থাও। কিন্তু বিষয়টি কি কোথাও ভাবনা জাগাচ্ছে? শিক্ষামন্ত্রী বা মন্ত্রণালয়ের কর্তাদের সঙ্গে কথা বললে হয়তো তারা স্বভাবসিদ্ধ প্রাবল্যে উড়িয়ে দিয়ে বলবেন সব ঠিক আছে। তবে এ কথা ঠিক যে, না ভাবলেই আর ভাবনা থাকে না, তাই আর মিছিমিছি ভাবনা কেন? কিন্তু ভাবতে যে হয়। নিশ্চিন্ততা গভীর উদ্বেগ জাগায়। গলদটা শুরু প্রাথমিক স্তরে। ভর্তির হারের উচ্চ পরিসংখ্যান দেখাবে শিক্ষা বিভাগ। কিন্তু শিক্ষার্থীর মান তো নিতান্তই স্কুলের খাতায় নাম থাকা-না-থাকা নয়। ক্লাসে উপস্থিতির হার নেমে গেছে। আর স্কুলে ভর্তি বা উপস্থিতি শিক্ষার প্রাথমিক শর্তমাত্র, শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া কেমন শিখছে সেটাই মূল প্রশ্ন। শিক্ষকরাই বলেন, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল তো আছেই, এমনকি জেলা শহরেও দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ পাঠ্যবই স্বচ্ছন্দভাবে পড়তে পারে না। ইংরেজি ও অঙ্কের অবস্থা করুণ। ওপরের দিকেও তথৈবচ। সামগ্রিকভাবে পরিস্থিতি চিন্তার কারণ।

২০১১ সাল থেকে টানা কয়েক বছর এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষায় পাসের হার ও জিপিএ ৫-এর বন্যা বয়ে যায়। পাসের বন্যা, বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর জিপিএ ৫ পাওয়ার পর থেকে শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। সাম্প্রতিককালে এসে বিষয়টি পরিষ্কার হয়, জিপিএ ৫ প্রাপ্তি বেড়েছে কিন্তু শিক্ষার মান বাড়েনি। বরং এর মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা কম হয়নি। ক্লাস ফাইভ ও এইটেও পাবলিক পরীক্ষা নিয়ে এসেছিল সরকার। কিন্তু পাবলিক পরীক্ষায় যে সঠিকভাবে মেধার মূল্যায়ন হচ্ছে না তার প্রমাণ উচ্চশিক্ষায় ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল। বিপুলসংখ্যক জিপিএ ৫ পাওয়ার পরও তারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হচ্ছে। অনেকেই হয়তো বলবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমেই যে পুরোপুরি মেধা যাচাই হচ্ছে, তাও বলা ঠিক হবে না। এটা ঠিক যে, শুধু মেধা যাচাই করার উদ্দেশ্যে এখানে প্রশ্ন করা হয় না। সব প্রশ্নের ধরনও সেরকম নয়। তারপরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে তার মধ্যে এটাই এখন পর্যন্ত মেধা যাচাইয়ের একটি উপায়, সেটা মানা ছাড়া উপায় নেই। আমাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা এই যে, শিক্ষাকে শিক্ষার্থীর অনুকূল ও সার্বজনীন করে তোলার একটি প্রয়াস আজ পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। আমরা আজও সিলেবাসকে শিক্ষার্থীর চাহিদা ও সক্ষমতা উপযোগী করতে পারিনি। সেটা হলে সেখানে পাস-ফেলের প্রসঙ্গটাই গৌণ হয়ে যেত। ছাত্রছাত্রীদের সামাজিক অবস্থান বিচার করে, তাদের চাহিদা ও ভালোলাগার কথা ভাবা হয়নি কখনো। প্রথমেই দরকার ছিল নম্বর তোলার প্রতিযোগিতা থেকে তাদের মুক্তি দেওয়া। দলগত পঠন-পাঠনের ওপর জোর দেওয়া, পাঠ্য বিষয়ে তথ্যের ভার কমিয়ে ধারণা তৈরির ওপর জোর দেওয়া, মূল্যায়ন পদ্ধতিকে সার্বিক ও নিরবচ্ছিন্ন করা প্রয়োজন। গুরুত্ব দেওয়া দরকার শিক্ষকের দায়বদ্ধতা ও শিক্ষক প্রশিক্ষণে। আমাদের সিস্টেম এগুলোকে অবহেলা করে বেশি মনোযোগী হয়েছে অবকাঠামোগত উন্নয়নের দিকটায়।

শিক্ষাজগতের সংস্কার করতে চাইলে কোনটা আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত এমন প্রশ্ন করলে এক কথায় উত্তর হবে শিক্ষাজগতের অব্যবস্থা এবং অকার্যকারিতা দূর করা। নম্বরভিত্তিক পদ্ধতির বাইরে গিয়ে শেখার গুণগত মানের ওপর জোর দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করা দরকার। ছেলেমেয়েরা কোন শিক্ষা কেমনভাবে পেলে ভালো হয়, সেটা একটা তাত্ত্বিক প্রশ্ন। কীভাবে সেই শিক্ষাপদ্ধতি দরিদ্র ছাত্রসমাজ ও শিক্ষকসমাজের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়, সেটা একটা প্রায়োগিক প্রশ্ন। দুটো প্রশ্নই খুব গুরুতর এবং খুব জরুরি।

যেখান থেকে লেখা শুরু হয়েছিল ফেরা যাক সেখানে। বিজ্ঞানের প্রতি কেন এই অনীহা? আমাদের দেশে আধুনিক বিজ্ঞানের চর্চা শুরু ব্রিটিশ শাসনকালে, উনিশ শতকে। কিন্তু এত এত বছরেও বাংলাদেশে তরুণ শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানশিক্ষায় আগ্রহী করে তোলা যায়নি। বিজ্ঞান শিক্ষার্থীর সংখ্যা হতাশাজনকভাবে কমছে। এটি বড় চিন্তার বিষয়। বিজ্ঞানের এ অগ্রযাত্রার কালে যখন সবকিছু বৈজ্ঞানিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দখলে চলে যাচ্ছে, তখন এ বিজ্ঞানহীন বিশাল প্রজন্ম নিয়ে জাতি কী করবে?

বিজ্ঞান শিক্ষার এ দশার একটি বড় কারণ বিদ্যালয়ে এবং কলেজে বিজ্ঞান শিক্ষক নেই। প্রান্তিক পর্যায়ে বহু জায়গায় বিজ্ঞান পড়ানোর ভালো স্কুল নেই। একটা সময় ছিল গ্রামের স্কুলগুলো ভালো করত। এখন আর সেদিন নেই। পড়ালেখা চলে গেছে ক্রেতা সামর্থ্যের ওপরে। বিত্তবানদের ছেলেমেয়েরা শহরের নামিদামি স্কুলে পড়ে, বিপুল বিনিয়োগে কোচিং করে এবং ভালো রেজাল্ট করে। ফলে একসময় বলা হতো, গ্রামের স্কুল থেকেই দেশের আগামীর বিজ্ঞানীরা উঠে আসবে, সেটা আর হয়নি এবং হবেও না। একদিকে বিজ্ঞান শিক্ষকের অভাব, অন্যদিকে কুসংস্কারের প্রতি আকৃষ্ট করে তোলা হচ্ছে কিশোর-তরুণদের। মুন্সীগঞ্জ সদরের বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের কথা মনে আছে নিশ্চয়ই। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তাকে। তার আগে ক্লাসের ভেতরেই কতিপয় ছাত্র ধর্ম ও বিজ্ঞান নিয়ে তার যৌক্তিক ব্যাখ্যাকে ধর্মীয় আবরণে ফেলে তাকে অপমান করে। এ ছাত্ররা শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক এবং ছাত্রদের কথাবার্তা গোপনে ভিডিও করে তা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। করোনার সময়ও আমরা দেখেছি, সামাজিক মাধ্যমে স্বাস্থ্যবিধিবিরোধী ধর্মীয় কুসংস্কার ছড়ানো হয়েছে। শিক্ষার্থীদের মগজে নিয়মিত প্রবেশ করানো হচ্ছে তত্ত্ব যে, বিজ্ঞান আছে শুধু ধর্মে, তাই পড়ার প্রয়োজন নেই। এগুলোর প্রভাবও কাজ করছে বিজ্ঞানের প্রতি অনীহায়। বিজ্ঞান-শিক্ষাকে আকর্ষকই করে তোলা যাচ্ছে না। এর দায় থেকে শিক্ষকসমাজও মুক্ত নন। পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের বাইরেও মহাবিশ্বের যে অপূর্ব রহস্য ছড়িয়ে রয়েছে, তার অনুসন্ধানে শিশু-কিশোর মনকে প্রণোদিত করার চেষ্টা নেই শ্রেণিকক্ষে। নোটবই, পাঠ্যপুস্তকে বিজ্ঞানকে সীমাবদ্ধ করার চেষ্টা চলে। কোনো অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বিশ্বের বিজ্ঞানীরা এখন বিনিদ্র রজনী কাটাচ্ছেন, বিগত দশকে কোনো আবিষ্কারগুলো চমকে দিচ্ছে পৃথিবীকে, তার আলোচনা অধিকাংশ বিদ্যালয়ের ক্লাসঘরে ঢুকতেই পারে না। অবশ্য এসব আলোচনা এখন সামাজিক পরিসরেও নেই। বিজ্ঞানের চাহিদা তৈরি করা প্রয়োজন। এটা শিক্ষকের কাজ, স্কুল-কলেজের কাজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের। রাষ্ট্র, শিক্ষক, অভিভাবক সবাইকেই বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করতে হবে। আধুনিক বিশ্বকে বিজ্ঞানের চেতনায় গ্রহণ করার প্রচেষ্টা আসুক সব স্তরে। ধর্মীয় গোঁড়ামিকে পেছনে ফেলে জীবনের চর্চায় বিজ্ঞান থাকুক স্বমহিমায়।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সজীব ওয়াজেদ জয়ের ৫৩তম জন্মবার্ষিকী শনিবার

ইতিহাসে এই দিনে কী ঘটেছিল?

অস্ট্রেলিয়ায় উদ্ভাবিত বিশ্বের প্রথম টাইটানিয়াম হার্ট মানবদেহে প্রতিস্থাপন

শনিবার রাজধানীর যেসব এলাকায় যাবেন না

শক্তিশালী পাসপোর্টে শীর্ষে সিঙ্গাপুর, বাংলাদেশের অবস্থান কত?

২৭ জুলাই : নামাজের সময়সূচি

যে ভুলে মরতে পারে টবের গাছ

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদে ২৪ বছর ধরে চাকরি, অতঃপর..

ঝিনাইদহে ২৪ বছর ধরে ক্রিকেট ব্যাট বানাচ্ছেন ৩ ভাই

জামালপুরে ১০ মামলায় আসামি ২৩০৫, গ্রেপ্তার ৩২

১০

আনোয়ারা পারকি সমুদ্র সৈকতে পর্যটকদের ভিড়

১১

যাত্রী পারাপার কমেছে আখাউড়া স্থলবন্দরে

১২

সিলেটে ৭ চোরাই সিএনজি অটোরিকশা উদ্ধার, গ্রেপ্তার ৭

১৩

‘সাংবা‌দি‌কের ওপর হামলা নিঃস‌ন্দে‌হে ছাত্র‌দের কাজ নয়’

১৪

রাজশাহীতে সহিংসতার মামলায় গ্রেপ্তার ১১৬৩

১৫

ছাত্রলীগের রাজনীতি ছাড়ার ঘটনা নিয়ে সারজিসের ফেসবুক স্ট্যাটাস

১৬

তিন সমন্বয়ককে আটকের কারণ জানালেন ডিবিপ্রধান

১৭

দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আল জাজিরাকে তথ্য প্রতিমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার

১৮

পাকিস্তানের বিপক্ষে রুদ্ধশ্বাস জয়ে ফাইনালে শ্রীলঙ্কা

১৯

ময়মনসিংহে শিক্ষার্থীর ওপর হামলা-মারধর

২০
X