মহসীন হাবিব
প্রকাশ : ৩০ জানুয়ারি ২০২৪, ০৩:৪৩ এএম
আপডেট : ৩০ জানুয়ারি ২০২৪, ০২:৫৬ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশ কেন বিচার পাবে না

বাংলাদেশ কেন বিচার পাবে না

যত বড় মাপের মানুষই হোক, যদি দেখা যায় তার বিচারবোধে বৈষম্য আছে, পক্ষপাত আছে; যদি দেখা যায় তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে বৈপরীত্য আছে, তাহলে তার গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। মানুষ তার প্রতি আস্থা রাখতে পারে না। ঠিক একই কথা বলা যায় রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে—আন্তঃরাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে। যুক্তরাষ্ট্র বড় দেশ। শুধু বড় দেশ বললে অসম্পূর্ণ থাকে, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ যে কোনো অর্থে। দেশটির অভ্যন্তরীণ শাসনব্যবস্থা বিশ্বের অন্য অনেক দেশের তুলনায় অনেক এগিয়ে। যে কারণে সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং নিঃসন্দেহে দেশটির সবচেয়ে শক্তিশালী মানুষ ডোনাল্ড ট্রাম্পকেও আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে উপযুক্ত বিচারের সম্মুখীন হতে হয়। অভিযোগ এবং বিচারের সম্মুখীন হওয়া এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই আমেরিকায়। রাস্তায় বা স্কুলে যতই বন্দুক হামলায় মৃত্যুর ঘটনা ঘটুক না কেন, ন্যায়বিচার পাওয়া থেকে নাগরিকরা কেউ সাধারণত বঞ্চিত হয় না। সেখানে আর যাই হোক, অর্থ দিয়ে বিচারকে অথবা বিচারককে কেনা যায় না। উকিলরা আদালতে দাঁড়িয়ে মিথ্যা কথা বলেন না, মিথ্যা তথ্য দেন না। পুলিশের হাতে অল্প-বিস্তর মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও পুলিশ ঘুষ খায় না বলেই আমরা জানি। সিস্টেমটাই সে দেশে এমন যে, রাজনৈতিক কোনো ব্যক্তির পুলিশে ফোন করে ধরানো-ছাড়ানোর কোনোই সুযোগ নেই। এসব বিশ্বব্যাপী মানুষ জানে ও বোঝে। আবার একই দেশে যখন ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারি হয়, অতি ভালো এবং শান্তিপ্রিয় মানুষ হিসেবে পরিচিত প্রেসিডেন্টের হোয়াইট হাউসে মনিকা-কাণ্ড ঘটে, অথবা যখন প্রেসিডেন্ট পুত্রের বিশাল আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ ওঠে, নির্বাচনের ফলাফল মেনে না নিয়ে হোয়াইট হাউস আক্রমণের খবর ছড়িয়ে পড়ে—তখন বিশ্ব ধন্দে পড়ে যায়। পূর্ণ আস্থা আর রাখতে পারে না। ঠিক এমনি বৈপরীত্যের কথাই মনে জায়গা করে নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে একটি ফাঁসি কার্যকর করার পর।

২৫ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামা অঙ্গরাজ্যে খুনের দায়ে অভিযুক্ত ৫৮ বছর বয়সী কেনেথ স্মিথকে নাইট্রোজেন গ্যাস মাস্ক মুখে পরিয়ে মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করা হয়েছে। তাকে ২০২২ সালের নভেম্বর মাসেও একবার মৃত্যুদণ্ডের চেয়ারে বসিয়ে ইনজেকশনের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের চেষ্টা করা হয়েছিল। তখন এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে তাকে ইনজেকশন পুশ করে মৃত্যু নিশ্চিত করতে চেষ্টা করা হয়। কিন্তু শরীরে ভেইন খুঁজে না পাওয়ায় বারবার সিরিঞ্জ পুশ করেও শেষ পর্যন্ত দণ্ড কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। কারণ মৃত্যুদণ্ডের ওয়ারেন্ট টাইম অতিক্রান্ত হয়ে গিয়েছিল।

কেনেথ ইউগেন স্মিথের বিরুদ্ধে অভিযোগ গুরুতর অবশ্যই। তিনি এলিজাবেথ বেনেট নামে এক নারীকে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত ছিলেন। এলিজাবেথের স্বামী চার্লস বেনেট তার স্ত্রীকে হত্যা করতে বিল গ্রে নামের একজনের সঙ্গে চুক্তি করেন। বিল গ্রে এ হত্যা সংঘটিত করার জন্য ভাড়া করেন জন পার্কার ও কেনেথ স্মিথকে মাত্র ১ হাজার ডলার প্রতিজন পাবে এ চুক্তিতে। ১৯৮৮ সালের মার্চ মাসের ১৮ তারিখ পার্কার ও স্মিথ এলিজাবেথের বাসায় প্রবেশ করে তাকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে। তদন্তে নেমে পুলিশ সন্দেহ করে এ হত্যার পেছনে এলিজাবেথের স্বামী রয়েছে। সেটা বুঝতে পেরে এক সপ্তাহের মধ্যেই এলিজাবেথের স্বামী চার্লস আত্মহত্যা করেন। হয়তো স্ত্রীকে হত্যার পর অনুশোচনাও হয়েছিল, কে জানে! হত্যার মধ্যস্থতা করার অপরাধে বিল গ্রেকে প্যারোলবিহীন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তিনি ২০২০ সালে কারাগারেই মৃত্যুবরণ করেন। পার্কার ও স্মিথকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়া হয়। ২০১০ সালের পার্কারকে শক্তিশালী চেতনানাশক ইনজেকশন প্রয়োগের মাধ্যমে রায় কার্যকর করা হয়। এবং হত্যাকাণ্ডের প্রায় ৩৬ বছর পর স্মিথের মৃত্যুদণ্ডও কার্যকর হলো। স্মিথ আপিল করেছিলেন। আপিল আদালত তা নাকচ করে দেন। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনার এ মৃত্যুদণ্ড স্থগিত করতে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু আলাবামা রাজ্য তা কর্ণপাত করেনি। বরং আলাবামা কর্তৃপক্ষ বলেছে, এ মৃত্যুদণ্ডের পদ্ধতিতে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়নি। মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর এলিজাবেথের বড় ছেলে মাইক সেনেট বলেছেন, এটি তাদের জন্য একটি অম্লমধুর সময়। এ মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের মাধ্যমে তাদের মা ফিরে আসবে না, তথাপি হত্যাকারী স্মিথ তার কৃতকর্মের প্রাপ্য পুরস্কারই পেয়েছে। স্মিথ তার ঋণ শোধ করেছে।

এমন ঋণ শোধের আশা তো শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা এমনকি বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ করতে পারে! মাইক সেনেট যদি মায়ের মৃত্যুর যথাযথ বিচার হত্যাকারীর মৃত্যুদণ্ডের মাধ্যমে পান, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিকোণ থেকে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা তাদের পিতা-মাতা, তিন ভাই, ভ্রাতৃবধূসহ নিকটাত্মীয় পরিজনের হত্যার যথাযথ বিচার পাবেন না কেন? কী বীভৎস নিষ্ঠুর ছিল সেই হত্যাকাণ্ড তা পৃথিবীর সব রাজনীতিবিদ, সব রাষ্ট্রই জানে। কোলের শিশু, অন্তঃসত্ত্বা নারী কাউকে সামান্য সহানুভূতি দেখানো হয়নি। অথচ আজ দীর্ঘকাল ধরে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের একজন রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে বসবাস করছেন। তাকে অনেক প্রচেষ্টার পরও ফিরিয়ে আনা যায়নি বিচারের রায় কার্যকর করতে। কেমনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠবে? কী করে আওয়ামী লীগপ্রধান যুক্তরাষ্ট্রের সব কথা মাথা পেতে নেবেন? একটি খোঁড়া যুক্তি শোনা যায় যে, যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমারা যেসব দেশে মৃত্যুদণ্ড আছে, সেসব দেশের অভিযুক্তদের ফিরিয়ে দেয় না। বোগাস! যুক্তরাষ্ট্রের একেক অঙ্গরাজ্যে ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট বিষয়ে একেক ধরনের আইন আছে। রাশেদ চৌধুরী যে অঙ্গরাজ্যে অবস্থান করছেন, সেই ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের পেনালকোড সেকশন ৩৬০০-এ বলা আছে, “Every male person, upon whom has been imposed the judgment of death, shall be delivered to the warden of the California state prison designated by the department for the execution of the death penalty. The inmate shall be kept in a California prison until execution of the judgment. The department may transfer the inmate to another prison which it determines to provide a level of security sufficient for that inmate. The inmate shall be returned to the prison designated for execution of the death penalty after an execution date has been set.”

২০১৯ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর গ্যাভিন নিউসাম একটি নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ডাদেশ সাময়িকভাবে স্থগিত রেখেছেন। সেখানে আইন পরিবর্তন না হলে এই নির্বাহী আদেশ পাঁচ বছরের বেশি রাখা যায় না। যে রাষ্ট্র নিজের নাগরিকদের বিচার পাওয়ার অধিকার সমুন্নত রাখতে বদ্ধপরিকর, সেই রাষ্ট্রই যখন উন্নয়শীল দেশগুলোতে বিচার পাওয়ার অধিকারকে আটকে রাখে, তা কি অন্য দেশের বিচারব্যবস্থাকে অস্বীকার করার শামিল নয়? একই কাজ কানাডা ও যুক্তরাজ্য করে যাচ্ছে দীর্ঘকাল ধরে। শুধু তাই নয়, পশ্চিমা দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়ে একদল দেশবিরোধী গুজব ছড়িয়ে বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিবেশের সৃষ্টি করছে। দেশের জাতির পিতার বিরুদ্ধেও মিথ্যা এবং মানহানিকর বক্তব্য প্রকাশ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে ইউটিউবে। আশ্রয় প্রদানের ক্ষেত্রেও কিছু নিয়মকানুন, শর্ত রয়েছে। ওই উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদানকারীরা সেসব আশ্রয় শর্তও ভঙ্গ করছে প্রতিদিন। তারা বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে সহিংসতার উসকানি দিচ্ছে, তাদের গুজব শুনে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কেউ কেউ সহিংস হয়ে উঠছে। যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা দেশগুলো নীরব, যেন মদদ দিয়ে যাচ্ছে! অথচ এই যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য এডোয়ার্ড স্লোডেনকে রাশিয়ায় আশ্রয় দেওয়ায় চিৎকার-চেঁচামেচি করে। জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ আজ দীর্ঘকাল ধরে যুক্তরাজ্যের কারাগারে রয়েছেন। তাকে যুক্তরাষ্ট্রে ফেরত পাঠানোর সব প্রক্রিয়া প্রায় সম্পন্ন হয়ে আছে। চাপ দিয়ে ইকুয়েডরের দূতাবাস থেকে বের করে ব্রিটিশ পুলিশের কাছে ধরা দিতে বাধ্য করা হয়েছে। তারা দুজনের কেউ কিন্তু কোনো সরকারকে, কোনো দেশের জনগণকে সহিংসতার উসকানি দেননি। স্লোডেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সির অতি গোপনীয় তথ্য ফাঁস করে দিয়েছেন। আর জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি মার্কিন বাহিনীর বাগদাদে হামলার গোপন ফুটেজ প্রকাশ করে দিয়েছেন। কথা হলো, বাইরের দেশে থেকে আপনাদের সরকারের বা রাষ্ট্রের ক্ষতিসাধন করলে আপনারা তাকে ফিরিয়ে নিতে যা প্রয়োজন সব করছেন। অল্পের জন্য এডোয়ার্ড স্লোডেনকে হংকং থেকে ধরতে পারেননি, তিনি ভাগ্যক্রমে রাশিয়ায় পালিয়ে যেতে পেরেছেন। এখন রাশিয়া তাকে আশ্রয় দিয়েছে, আপনাদের কেমন লাগছে? অথচ আপনাদেরই কোলে বসে বাংলাদেশ নিয়ে যা ইচ্ছা তাই করছে যারা, তাদের নিরাপদ আশ্রয় দিয়ে রাখছেন—এ কি চরম দ্বিচারিতা নয়? রাশেদ চৌধুরী বা নুর চৌধুরী যে বাংলাদেশে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের অন্যতম দুটি চরিত্র, তা নিয়ে কি আপনাদের কোনো সন্দেহ আছে? যদি না-ই থাকে সন্দেহ, তাহলে জঘন্য অপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর করায় বাধা দিচ্ছেন কেন? কেন বঞ্চিত করছেন পিতা-মাতাকে হত্যার বিচার পাওয়ার অধিকার?

লেখক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বিএনপির আরও ৪ নেতা বহিষ্কার

তীব্র গরমে ক্লাসেই অসুস্থ ৩০ শিক্ষার্থী

নবীনদের ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ দিচ্ছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ

এলসভিয়ার থেকে ফ্রি ই-বুকের সুবিধা পাবে বাকৃবি শিক্ষার্থীরা

ডিএনসিসির রাজস্ব বিভাগ শনিবারেও খোলা থাকবে

লু’র কথার পরে ফখরুলের বক্তব্যের আর কোনো মূল্য নেই : কাদের

রাসেল ভাইপার আতঙ্কে মিলছে না ধানকাটার শ্রমিক!

জেলায় জেলায় ডাকাতি করাই তাদের নেশা

প্রমাণ হলো এসএমসি প্লাস অনুমোদনহীন, কর্ণধারকে জরিমানা

উন্নয়ন প্রকল্পে মানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান দিয়ে সমীক্ষা করার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

১০

নিপুন অসুস্থ, তাকে মানসিক ডাক্তার দেখানো জরুরি : জায়েদ খান

১১

বিমানবন্দরের সামনে মাইক্রোবাসে আগুন

১২

জেনিথ লাইফের সঙ্গে মিডল্যান্ড ব্যাংকের চুক্তি

১৩

ফ্রেশারদের চাকরির সুযোগ দিচ্ছে ওয়ান ব্যাংক, পদ ৩০

১৪

৯ হজ এজেন্সিকে ভিসা প্রক্রিয়া সম্পন্নের নির্দেশ

১৫

সুনামগঞ্জে কুকুরের কামড়ে শিশুসহ ২৬ জন আহত

১৬

উপজেলা নির্বাচন / মঙ্গলবার ব্যাংক বন্ধ থাকবে যেসব এলাকায়

১৭

শিল্পী সমিতির আদালতের দারস্থ হওয়া শিল্পীদের জন্য লজ্জার : সোহেল রানা

১৮

দশ পদে ২৯ জনকে নিয়োগ দেবে রাজশাহী বিভাগীয় কমিশন

১৯

সাগর-রুনি হত্যা : ১০৮ বার পেছাল তদন্ত প্রতিবেদন

২০
X