মহসীন হাবিব
প্রকাশ : ০২ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:২১ এএম
আপডেট : ০২ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:৩৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
মহসীন হাবিবের নিবন্ধ

রাজনৈতিক দলগুলোর অচলাবস্থা

রাজনৈতিক দলগুলোর অচলাবস্থা

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা ক্ষণিকের লাভ-ক্ষতির হিসাব কষতে গিয়ে দীর্ঘমেয়াদে দলটিকে বিভাজনের দিকে ঠেলে দিয়েছেন। তারা হয়তো ভাবছেন, সময় পার হলে সব ঠিক হয়ে যাবে, আবার দলটি ঐক্যবদ্ধ হয়ে উঠবে। এমন ধারণা এখন কল্পনা ছাড়া কিছু না। কাচের প্লেট ভেঙে গেলে তা হয়তো জোড়া লাগানো যায়, কিন্তু তা যেমন যখন তখন ভেঙে যেতে পারে, তেমনি পূর্বের অক্ষত মূল্যটি আর থাকে না। তবুও তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম, জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে ‘বিশেষ প্রয়োজনে’ তারা নিজেদের দলের মধ্যেই ভাগ হয়ে নির্বাচন করেছিল। এই ‘বিশেষ প্রয়োজন’ নিয়ে বলতে গেলে অনেক কথা বলতে হবে। বিশেষ প্রয়োজন দেশে দেশে প্রয়োজন হয়ে পড়ে কখনো কখনো। ইংরেজিতে যাকে বলা যায় ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’। যেমন মিশরে হোসনি মোবারকের পতনের পর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিপুল বিজয়ের পর মুসলিম ব্রাদারহুডের সমর্থিত ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির নেতা মোহাম্মদ মুরসি ক্ষমতায় আসেন। সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমারা দেখতে পায়, ভুল লোক ক্ষমতায় এসেছে। মিশর চরম মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হবে শিগগিরই। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল, পরে ফিল্ড মার্শাল এবং ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির নিয়োজিত ডিফেন্স মিনিস্টার আবদেল ফাতাহ আল সিসিকে ইঙ্গিত দেয় মোরসিকে সরিয়ে দিতে। সিসির সামরিক অভ্যুত্থান পশ্চিমা দেশগুলোতে খুবই সমাদৃত হয়। তিনি ২০১৪ সাল থেকে এখনো মিশরের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এটি করা হয়েছিল বিশেষ প্রয়োজনে। এরকম অনেক উদাহরণ আছে। সম্প্রতি থাইল্যান্ডে মুভ ফরোয়ার্ড পার্টি নির্বাচনে জয়লাভ করলেও সে দেশের সংসদের উচ্চকক্ষ দলটির নেতা পিতা লিমকে প্রধানমন্ত্রী হতে দেয়নি। সর্বশেষ বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের প্রবক্তা যুক্তরাষ্ট্রে এই ‘বিশেষ প্রয়োজন’ দেখা দিয়েছে বাইডেন প্রশাসনের জন্য। আগামী নভেম্বরে নির্বাচন। ছলেবলে কৌশলে সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ফের ক্ষমতায় আসা ঠেকাতে আমেরিকা ও ইউরোপব্যাপী অনেক পরিকল্পনা-আয়োজন চলছে। যুক্তরাষ্ট্র একটি অভিবাসনের দেশ। এ দেশের সঙ্গে ইউরোপের স্বার্থ, সংস্কৃতি, রক্ত মিলেমিশে আছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রে ইউরোপের প্রভাব বিস্তর। তারা মনে করছেন, ট্রাম্প ক্ষমতায় ফিরে এলে ন্যাটো অকার্যকর হয়ে উঠবে, যে ইউক্রেনকে তারা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার সাহায্য করছে যুদ্ধে জয়ের জন্য, সেই ইউক্রেন পরাজিত হবে ইত্যাদি। সুতরাং কাগজ-কলম, সংবিধান, আইন এসব একরকম আর বাস্তব অবস্থা আরেক রকমকেই বলা যায় ‘বিশেষ প্রয়োজন’।

নির্বাচন সামনে রেখে বেশ কিছু কারণে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার এ ‘বিশেষ প্রয়োজন’ অনুভব করেছে। ভারত, চীনসহ কয়েকটি দেশ এই ‘বিশেষ প্রয়োজন’ সমর্থন দেওয়াকে সঠিক বলে মনে করেছে। ল্যাঠা চুকে গেছে এবং আওয়ামী লীগ আবার সরকার গঠন করেছে। এই বিশেষ প্রয়োজনের বিরোধিতা করেছিল পশ্চিমা দেশগুলো। তাদেরই প্রত্যক্ষ সমর্থনে প্রধান বিরোধী দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে। সরকার এ জাতীয় নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে দেশের স্থানীয় পর্যায়ে প্রচুর ভোটার উপস্থিতি দেখাতে একটি কৌশল অবলম্বন করে। নিজের দলের লোকদেরই স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার অনুমোদন দেয়। সে কাহিনি আমরা কমবেশি সবাই জানি। দলীয় নেতাকর্মীদের নির্বাচন করতে বাধা নেই—এই একটি মাত্র আদেশ আওয়ামী লীগকে যে বিভক্তির পথে নিয়ে গিয়েছে, তার খেসারত কতকাল টানতে হবে কে জানে!

আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগে বেশ কয়েকটি জেলায় খোঁজ নিয়েছি, অনেক অরাজনৈতিক ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ করে রাজনৈতিক আবহ জেনেছি। জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী সমর্থক, আওয়ামী লীগেরই জেলা কমিটির নেতারা যে স্বতন্ত্র এবং আওয়ামী প্রার্থী নামে ভাগ হয়ে গিয়েছেন, তা এখনো জোড়া তো লাগেইনি, বরং দুপক্ষের মধ্যে বৈরিতা, হানাহানি অব্যাহত আছে এবং ক্ষেত্রবিশেষ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্য কোনো নির্বাচনী এলাকার কথা না বলে আমার নিজের এলাকার কথাই বলি। নির্বাচনকালে ফরিদপুর-৩, অর্থাৎ ফরিদপুর সদর আসন বেশ আলোচিত ছিল। এ আসনে আওয়ামী লীগদলীয় প্রার্থী হয়েছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামীমুল হক এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এ. কে. আজাদ। নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী এ. কে. আজাদ। কিন্তু তারপর কেউ এ দুই প্রার্থীকে হাতে হাত মিলিয়ে দিতে পেরেছেন কি? পারেননি। এখন ফরিদপুরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, সমর্থক এমনকি জনগণের মধ্যে ‘শামীম গ্রুপ’ এবং ‘আজাদ গ্রুপ’ বলে দুটি পৃথক বলয়ের পরিচিতি। দেশব্যাপী আওয়ামী লীগেরই একপক্ষ আরেকপক্ষের বিরুদ্ধে কারচুপির অভিযোগ এনেছে। এখনো আওয়ামী লীগের সদস্যের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের অন্য সদস্যের হয়রানিমূলক মামলা চলমান রয়েছে। জাতীয় নির্বাচন-পরবর্তীতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগেরই নেতাকর্মীরা একে অন্যের বাড়িঘরে হামলা চালিয়েছে, সংঘর্ষে জড়িয়েছে। এখনো চলছে। এ দাগ সহসা মুছে ফেলা যাবে? কোনোক্রমেই না।

এবার স্থানীয় নির্বাচনে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা কাউকে প্রার্থী করতে পারবেন না। দলের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা কোনো প্রার্থীর নাম ঘোষণা করতে পারবেন না। দল থেকে কাউকে সমর্থন দেওয়া যাবে না। দলীয় প্রতীকও দেওয়া হবে না। তবে যে কোনো নেতা স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাবেন। সেইসঙ্গে নেতারা অনেক ভালো ভালো কথাই বলেছেন। কিন্তু বাস্তবচিত্র ভিন্ন। প্রায় প্রতিটি অঞ্চলেই এমপিরা নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে ‘আশীর্বাদ’ দিচ্ছেন। এ নিয়ে ২৬ মার্চ কালবেলার এক রিপোর্টই বলছে, ‘এলাকায় নিজের অবস্থান শক্তিশালী করতে পছন্দের প্রার্থীকে জিতিয়ে আনতে এরই মধ্যে তৎপর হয়ে উঠেছেন নতুন সংসদ সদস্যরা। বিপরীতে ভবিষ্যৎ বিবেচনায় শক্তিশালী বলয় তৈরির চেষ্টা করছেন সংসদ নির্বাচনের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীরা।’

নিজের বলয়, রাজনৈতিক শক্তি অর্জন রাজনীতির কৌশল। যে কোনো রাজনীতিবিদ তা করেন। এটা দোষের কিছু নয়। কিন্তু এ বলয় তৈরি যদি দলের চেয়ে মুখ্য হয়ে ওঠে, তাহলে ক্ষয়িষ্ণু হতে বাধ্য। এই গ্রুপিংয়ের ফলে আওয়ামী বিরোধী একটি গোষ্ঠীও ঢুকে পড়ছে কোনো একটি পক্ষে।

অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতোই স্থানীয় নির্বাচনকেও আওয়ামী লীগের নিজস্ব নির্বাচন বলে ধরে নিয়েছে। সারা দেশে তাদের নেতাকর্মী-সমর্থক কেউ অংশ নিচ্ছেন না। রুহুল কবির রিজভী কয়েক দিন আগে বলেছেন, ‘যারাই দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নেবেন, তাদের অতীতের মতোই দল থেকে বহিষ্কার করা হবে।’ অনেকে মনে করেন, বিএনপির এ সিদ্ধান্তটিই ভুল। এর ফলে দলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড ডিপ ফ্রিজে চলে যাচ্ছে। শুধু ঢাকায় ছোটখাটো প্রতিবাদ সমাবেশ এবং বক্তব্য-বিবৃতির মধ্যেই দলটি সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। ঢাকায় দলীয়ভাবে না হলেও অনানুষ্ঠানিকভাবে বিএনপি তাদের সমর্থকদের মধ্য থেকে প্রার্থী দেওয়া উচিত ছিল। বছরের পর বছর এভাবে দলীয় নেতাকর্মী ধরে রাখা যায় না। মনে রাখা দরকার, সমর্থক আর নেতাকর্মী এক কথা নয়। বিএনপির জেলা পর্যায়ে অনেক নেতাকর্মীই এখন ঝিমিয়ে পড়েছেন। খোদ শীর্ষ পদে থেকেই টেলিফোন আলাপে স্বীকার করেছেন, তারা আন্দোলনে নেতাকর্মীদের নামাতে ব্যর্থ হয়েছেন। আমরা মনে করি, বিএনপির সবচেয়ে বড় ত্রুটি ছিল জনগণকে সংগঠিত করার কাজকে গৌণ করে, বিদেশি শক্তির ওপর ভর করে বৈতরণী পার হতে চেষ্টা করা।

দুটি বড় দলের মধ্যেই এরকম সাংগঠনিক সংকট তৈরি হয়েছে। এর ফলে এ দুটো দলই আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতনের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। ভবিষ্যতে যদি আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে সরে যায়, তাহলে আর যাই হোক, ১৯৯৬ সালের মতো আন্দোলন করে সরকার নামাতে পারবে না। সে শক্তি নিজেরাই নষ্ট করে ফেলল। যেমনটি আর সম্ভব হবে না বিএনপিরও, সেই একত্রে ১৯৯০ সালের মতো আন্দোলনের তেজ প্রদর্শনের। শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকলে জনগণ রাজনীতিবিমুখ হয়ে পড়ে, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা সরকারি দলের কৃপায় পরিণত হয়। আজ বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ সেরকম একটি অবস্থার মধ্যে আটকে গেছে। আর যাই হোক, বাংলাদেশের মানুষ আর সহসা, অর্থাৎ অদূর ভবিষ্যতে কোনো শক্তিশালী বিরোধী দল দেখতে পাবে—অনেকেই মনে করেন না।

লেখক: সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

এলসভিয়ার থেকে ফ্রি ই-বুকের সুবিধা পাবে বাকৃবি শিক্ষার্থীরা

ডিএনসিসির রাজস্ব বিভাগ শনিবারেও খোলা থাকবে

লু’র কথার পরে ফখরুলের বক্তব্যের আর কোনো মূল্য নেই : কাদের

রাসেল ভাইপার আতঙ্কে মিলছে না ধানকাটার শ্রমিক!

জেলায় জেলায় ডাকাতি করাই তাদের নেশা

প্রমাণ হলো এসএমসি প্লাস অনুমোদহীন, কর্ণধারকে জরিমানা

উন্নয়ন প্রকল্পে মানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান দিয়ে সমীক্ষা করার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

নিপুন অসুস্থ, তাকে মানসিক ডাক্তার দেখানো জরুরি : জায়েদ খান

বিমানবন্দরের সামনে মাইক্রোবাসে আগুন

জেনিথ লাইফের সঙ্গে মিডল্যান্ড ব্যাংকের চুক্তি

১০

ফ্রেশারদের চাকরির সুযোগ দিচ্ছে ওয়ান ব্যাংক, পদ ৩০

১১

৯ হজ এজেন্সিকে ভিসা প্রক্রিয়া সম্পন্নের নির্দেশ

১২

সুনামগঞ্জে কুকুরের কামড়ে শিশুসহ ২৬ জন আহত

১৩

উপজেলা নির্বাচন / মঙ্গলবার ব্যাংক বন্ধ থাকবে যেসব এলাকায়

১৪

শিল্পী সমিতির আদালতের দারস্থ হওয়া শিল্পীদের জন্য লজ্জার : সোহেল রানা

১৫

দশ পদে ২৯ জনকে নিয়োগ দেবে রাজশাহী বিভাগীয় কমিশন

১৬

সাগর-রুনি হত্যা : ১০৮ বার পেছাল তদন্ত প্রতিবেদন

১৭

১৫ বছরে উন্নয়ন অর্জন-আধুনিকতায় বাংলাদেশ বদলে গেছে : ওবায়দুল কাদের

১৮

৫৪ দিনেও উদ্ধার হয়নি অপহৃত রূপন্তী

১৯

পানিতে প্রতিবন্ধকতা, কার প্রভাবে মরে যাচ্ছে ৮ নদী

২০
X