প্রভাষ আমিন
প্রকাশ : ০৩ এপ্রিল ২০২৪, ০২:৫২ এএম
আপডেট : ০৩ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:০৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ভয় দেখিয়ে জয় করা যায় না

ভয় দেখিয়ে জয় করা যায় না

২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর বুয়েটের শেরেবাংলা হলে আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করেছিল বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তারপর থেকেই বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ। গত ২৮ মার্চ রাতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা বুয়েট ক্যাম্পাসে যান। বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি ফিরে আসছে, এই অভিযোগে সাধারণ শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামেন। ক্লাস-পরীক্ষা বাদ দিয়েই তারা আন্দোলনে নেমেছিলেন। টানা আন্দোলন চালানোর কথা থাকলেও তৃতীয় দিনে শিক্ষার্থীরা মাঠে নামেননি। তাহলে কি তারা দাবি থেকে সরে এসেছেন? না, তারা তাদের দাবিতে অনড় আছেন। রোববার বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা দাবি করেন, নিরাপত্তাজনিত শঙ্কার কারণে তারা মাঠে নামেননি। তবে দাবি থেকেও সরে আসেননি। রাজনীতিমুক্ত নিরাপদ ক্যাম্পাসের নিশ্চয়তা দিলেই শুধু তারা ক্লাস-পরীক্ষাসহ একাডেমিক কার্যক্রমে ফিরবেন। এরই মধ্যে তারা পরীক্ষা রিশিডিউলের দাবি জানিয়েছেন।

নিরাপত্তাজনিত কোন শঙ্কায় তারা আন্দোলন করতে মাঠে নামতে পারেননি, সেটি পরিষ্কার না করলেও আমি ধরে নিচ্ছি ছাত্রলীগের পক্ষ থেকেই তাদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। ছাত্রলীগ আদৌ হুমকি দিয়েছে কি না জানি না, তবুও আমি ধরে নিচ্ছি, ছাত্রলীগ আন্দোলনকারীদের হুমকি দিয়েছে। গত দেড় দশকে ছাত্রলীগের যে ভাবমূর্তি, তাতে হুমকি না দিলেও মানুষ ভাববে হুমকি দিয়েছে। যদিও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরাই পরীক্ষায় অংশ নিতে চাওয়া শিক্ষার্থীদের হুমকি দিয়েছে বলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উঠেছে। যে পক্ষই হুমকি দিক, সাধারণ মানুষের সব আবেগ সবসময় আন্দোলনকারীদের পক্ষেই থাকে। দাবি যৌক্তিক হোক আর অযৌক্তিক, এস্টাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধে কেউ আন্দোলনে নামলেই সাধারণ মানুষ আন্দোলনকারীদের পাশে দাঁড়িয়ে যান। বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা যে আন্দোলন করছেন, তার আবেগের সঙ্গে আমি একমত। আবরার ফাহাদকে যেভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছিল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা, তার ক্ষত এখনো শুকায়নি, কখনো শুকাবেও না। বাংলাদেশে যৌক্তিক-অযৌক্তিক যে কোনো দাবি নিয়ে যে কারও আন্দোলন করার অধিকার আছে। তেমনি যে কারও অধিকার আছে, সে আন্দোলনের বিরোধিতা করারও। এ অধিকার আমাদের সংবিধান স্বীকৃত। আপনার যেমন প্রতিবাদ করার অধিকার আছে, ইমতিয়াজ রাব্বীরও তো ছাত্রলীগ করার অধিকার আছে। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, এই ‘অপরাধে’ বুয়েট থেকে তার বহিষ্কার দাবি করা অন্যায়। অনেক মানুষ মিলে দাবি করলেও অন্যায় ন্যায় হয়ে যায় না।

সাধারণত সরকারি দল রাজনৈতিক স্পেস সংকুচিত রাখতে চায়, যাতে বিরোধীরা সরকারের বিরুদ্ধে একজোট হতে না পারে। তবে বুয়েটে ঘটেছে উল্টো ঘটনা। সেখানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগই শুধু ছাত্ররাজনীতি ফিরিয়ে আনতে চায়। বাকি সবাই এর বিপক্ষে। বিরোধী দলগুলোও কেন ছাত্ররাজনীতি চায় না, এটা বুঝতে বিজ্ঞানী হওয়ার দরকার নেই। সবাই জানেন, ছাত্ররাজনীতি ফিরিয়ে আনতে পারলে দেশের অন্য সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো বুয়েটও ছাত্রলীগ দখল করে নেবে। বিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলোর কোনো লাভ হবে না। ছাত্রলীগ বুয়েট দখল করতে চাইছে বলে, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল যে অভিযোগ করেছেন, তা খুব একটা ভুল নয়। আসলেই ছাত্রলীগ বুয়েট দখল করতে চায়। তবে বুয়েটের স্পর্শকাতরতা বিবেচনায় ছাত্রলীগ একটু কৌশলে এগোতে চায়। তাই তো তারা আদালতের মাধ্যমে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি ফিরিয়ে আনার উপায় খুঁজছে। বুয়েট না হয়ে অন্য কোথাও হলে অনেক আগেই ছাত্রলীগ গায়ের জোরে দখল করে নিত। গায়ের জোরে যে সবকিছু দখল করা যায় না, এ ধারণাটাই আর নেই ক্ষমতাসীনদের মাথায়।

চার বছরেরও বেশি সময় ধরে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ। ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ মানে সেখানে আনুষ্ঠানিক কমিটি দেওয়া যাবে না, মিছিল-সমাবেশ করা যাবে না, পোস্টার লাগানো যাবে না। এই তো। কিন্তু সত্যিই কি এ চার বছর বুয়েটে রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল? আমার মনে হয় না। আসলে আমাদের সবকিছুতেই রাজনীতি। আনুষ্ঠানিক রাজনীতির অনুপস্থিতিতে অপশক্তি শিকড় গেড়ে বসেছে বুয়েটে। নিষিদ্ধ ঘোষিত হিযবুত তাহরীরও নির্বিঘ্নে বুয়েট ক্যাম্পাসে তৎপরতা চালায়। টাঙ্গুয়ার হাওরে গিয়ে আটক হওয়া শিবিরকর্মীরা নির্বিঘ্নে বুয়েটে পড়াশোনা করছে।

তবে সমস্যা আছে ছাত্রলীগেরও। মূল সমস্যা তো আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে মারা। আবরার মারা যাওয়াতে তখন ছাত্রলীগের অনেক অপকর্ম সামনে এসেছিল। এমন নির্যাতন নিয়মিতই হতো, আবরার মারা না গেলে নির্যাতনের এ ধারাবাহিকতা হয়তো অব্যাহতই থাকত। দিনের পর দিন নির্যাতনে অতিষ্ঠ সাধারণ শিক্ষার্থী তাই ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে একাট্টা হয়েছে। ছাত্ররাজনীতির নামে আবার সেই বিভীষিকা ফিরে আসে কি না, সেই আশঙ্কায় রয়েছে তারা। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা বুয়েট ক্যাম্পাসে গেছেন, তাতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু তাদের মধ্যরাতে যেতে হবে কেন। মধ্যরাতের মহড়ার মধ্যেই একটা ভয় দেখানোর ব্যাপার আছে। ডেইলি স্টারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বুয়েটের উপাচার্য সত্যপ্রসাদ মজুমদারও স্বীকার করেছেন বিষয়টি, ‘২০১৯ সালে নিয়ম করা হয়েছিল যে, বুয়েট ক্যাম্পাসে রাজনীতি করা যাবে না। তখন যে পরিস্থিতির কারণে এ নিয়ম করা হয়েছিল, সেটার কারণে হয়তো শিক্ষার্থীদের মনে একটা ভয় রয়ে গেছে। সেদিন রাতে ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে এসেছিল, সেটাও ভয় বেড়ে যাওয়ার একটা কারণ হতে পারে। তাদের এ ভয় দূর করার জন্য একটা সময় প্রয়োজন। আমাদের শিক্ষার্থীরা যদি ছাত্রলীগের কার্যক্রম দেখে, তাদের ভালো কাজগুলো দেখে, তাদের সঙ্গে আলোচনা করে—তাহলে একসময় হয়তো শিক্ষার্থীদের মনে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে ভয় থাকবে না। তখন তারা হয়তো এ বিষয়ে ওপেন মাইন্ডেড হবে।’

ছাত্রলীগ কিন্তু সাধারণ শিক্ষার্থীদের মন থেকে ভয় দূর করার জন্য সাড়ে চার বছর সময় পেয়েছিল। কিন্তু এই সময়ে তারা কী এমন করেছে, যাতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা আশ্বস্ত হতে পারে। ছাত্রলীগ কী এমন ভালো কাজ করেছে, যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে। ২০১৯ সাল থকে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ। তার মানে বুয়েটে কোনো ছাত্র সংগঠনেরই কমিটি নেই, নেই আনুষ্ঠানিক তৎপরতা। কিন্তু ছাত্রলীগ চাইলে তো অনানুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে পারত। শিবির বা হিযবুত তাহরীর যেভাবে গোপনে তৎপরতা চালায়, ছাত্রলীগও তো তেমনটা করতে পারত। ছাত্রলীগের পরিচয়ে না হোক, অন্য পরিচয়ে তারা শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছার চেষ্টা করতে পারত। সেটা তারা করেছে, এমন কোনো তথ্য আমার জানা নেই। বরং বুয়েটের অধিকাংশ সাধারণ শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের বিপক্ষে কেন, এটা তাদের অনুধাবন করতে হবে। নতুন নেতৃত্বে ছাত্রলীগে অতীতের গ্লানি মুছে নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। তবে এ প্রক্রিয়ায় তাদের আত্মজিজ্ঞাসা, আত্মসমালোচনা, আত্মমূল্যায়নটা বেশি জরুরি। বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নেই। কিন্তু বাকি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তো ছাত্রলীগের একক নিয়ন্ত্রণে। সেসব প্রতিষ্ঠানে তাদের কী অবস্থা, সেটা কি ছাত্রলীগ নেতারা গোপনে অনুসন্ধান করে দেখেছেন। সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচনে কিন্তু সবাই দেখেছে ছাত্রলীগের অবস্থা। সে কারণে ডাকসু নির্বাচন আর হচ্ছে না। শুধু ডাকসু নয়, বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে ছাত্রলীগ হারবে। আমার ধারণা এটা ছাত্রলীগও জানে। তাই তারা কখনো ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি তোলে না।

সরকারের আনুকূল্যে আর গায়ের জোরে ক্যাম্পাস দখল করে রাখা আর শিক্ষার্থীদের ভালোবাসা পাওয়া এক কথা নয়। ভয় দেখিয়ে জয় করা যায় না। কোনো কারণে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলে রাতারাতি সব ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রলীগকে পালাতে হবে। ছাত্রলীগের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী সংগঠনের এ দুরবস্থা কেন, তা ছাত্রলীগকেই খুঁজে বের করতে হবে। ক্যাম্পাস দখল, হল দখল, গণরুম, টর্চার সেলের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে শিক্ষার্থীদের ভালোবাসা পাওয়ার উপায় বের করতে হবে।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

পাইপলাইনে গ্যাস, ১০ বছরেও আবেদন করেনি কেউ!

নারায়ণগঞ্জে নারী কাউন্সিলর লাঞ্ছিত, অতঃপর...

রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে সদস্য সংগ্রহ করছে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো : পররাষ্ট্রমন্ত্রী

মঙ্গলবার শুরু হচ্ছে বিএসপিএ স্পোর্টস কার্নিভাল

জামায়াতকে একমঞ্চে চায় ১২ দলীয় জোট

সৈয়দপুরে বিমান ওঠা-নামা বন্ধ

মেক্সিকোতে শক্তিশালী ভূমিকম্প, ধ্বসে পড়েছে রাস্তাঘাট

‘সরকার দুর্নীতি দমন না করে বিএনপি দমনে ব্যস্ত’

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রীর সঙ্গে প্রণয় ভার্মার সাক্ষাৎ

ইউএস ট্রেড শো ২০২৪ / সেরা প্যাভিলিয়নের পুরস্কার জিতে শেষটা রাঙিয়ে তুলল রিমার্ক-হারল্যান

১০

সোমবার রাতে কুতুবদিয়ায় পৌঁছবে এমভি আব্দুল্লাহ

১১

জিপিএ-৫ পেল মেয়ে, দুশ্চিন্তায় রিকশাচালক পিতা

১২

মুখস্থ শিক্ষার ওপর নির্ভরতা কমাতে পাঠ্যক্রমে পরিবর্তন আনা হচ্ছে : প্রধানমন্ত্রী

১৩

রাশিয়ায় ইউক্রেনের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, নিহত ৭

১৪

বহুমুখী শিক্ষায় সীমাখালী ইসলামিয়া আইডিয়ালের ঈর্ষণীয় সাফল্য

১৫

অংকে ফেল করায় গলায় ফাঁস নিল কিশোরী

১৬

ইসরায়েলে পুলিশ-জনগণ সংঘর্ষ, ভয়ংকর বিপদে নেতানিয়াহু

১৭

পা দিয়ে লিখেই এসএসসি পাস করল সিয়াম

১৮

দোয়া কুনুত বাংলা উচ্চারণ ও অর্থসহ

১৯

গ্রিন রোড থেকে রিকশার গ্যারেজ উচ্ছেদ, যান চলাচলে ফিরেছে স্বাচ্ছন্দ্য

২০
X