৩৩ ভাইবোনের বিশাল পরিবারের একজন তউবা নিয়াং। সেনেগালের রাজধানী ডাকারের নিকটবর্তী ওয়াতেফ গ্রামে জন্ম ও বেড়ে ওঠা। জীবিকার তাগিদে আটলান্টিক পাড়ি দেন, নামেন আর্জেন্টিনার কুইলমেস শহরে। ফুটপাতে শুরু করেন চশমা বিক্রি, সেখান থেকে বক্সিং রিংয়ে পা রাখা; বাকিটা ইতিহাস!
গত ছয় মাসে চারবার আর্জেন্টাইন বক্সিং ফেডারেশনের স্টেডিয়ামে বিশেষ উত্তেজনা দেখা গেছে। তউবা নিয়াংয়ের ম্যাচ দেখতে দর্শক ভিড় করছেন। নিঃশ্বাস বন্ধ করে উপভোগ করছেন প্রতিটি লড়াই। অথচ মাত্র ১০ মাস আগে পেশাদার বক্সিংয়ে পা রেখেছেন এ যুবক। যার লড়াইয়ের ধরন—সরাসরি এবং ঝুঁকিপূর্ণ হলেও অত্যন্ত আকর্ষণীয়।
তাউবা নিয়াংয়ের জীবন কাহিনি যেন এক সিনেমার গল্প। আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দেওয়ার যাত্রা ছিল দীর্ঘ, কষ্টকর এবং অবশ্যই ঝুঁকিপূর্ণ। জীবন যুদ্ধে বেঁচে থাকার তাগিদে অনেক আফ্রিকান যুবক এমন ঝুঁকি নেন। কেউ সফল হন, কারোর ক্ষেত্রে ঘটে নির্মম পরিণতি। তউবা নিয়াংয়ের ক্ষেত্রে বিষয়টা ছিল জীবন বদলে দেওয়ার যাত্রা!
বক্সিং রিংয়ে পা রাখার পর থেকে অবাক করা সব লড়াই উপহার দিচ্ছেন। স্বপ্ন দেখছেন নিজেকে বিশ্বসেরা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার। তার আগে পরিবারের সদস্যদের ক্ষুধা নিবারণের ব্যবস্থা করতে চান, ‘অনেক মানুষ আমাকে অনুসরণ করে। আমাকে সমর্থন করে, ভালোবাসে—এটাই আমাকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করে। আমি সফল হতে চাই, নিজের এবং পরিবারের জীবন বদলাতে চাই।’
ডাকারের নিকটবর্তী ওয়াতেফ গ্রামের জীবন ছিল কঠিন। ২০১৫ সালে এক প্রতিবেশীর মাধ্যমে আর্জেন্টিনা সম্পর্কে জানতে পারেন এবং আটলান্টিক পাড়ি দেওয়ার অভিযানে নামার সিদ্ধান্ত নেন তউবা নিয়াং। ২০০১ সালে আর্জেন্টিনা যাওয়ার পর ফিরে আসা ওই প্রতিবেশীর গল্প শুনে অনুপ্রাণিত তউবা তার বাবাকে বলছিলেন, ‘আপনাকে কয়েকটি পশু বিক্রি করতে হবে। বিক্রি করে যে টাকা পাওয়া যাবে, তা দিয়ে আমাকে আর্জেন্টিনা পাঠাতে হবে।’ তিন মাসের দীর্ঘ যাত্রায় তউবা নিয়াং স্পেন, ইকুয়েডর হয়ে আর্জেন্টিনায় পৌঁছান। সেখানে প্রথম দিন খোলা আকাশের নিচে বৃষ্টিতে ভিজতে হয়েছিল। বেঁচে থাকার অবলম্বন খুঁজতে দেরি করেননি—দ্বিতীয় দিন থেকে তিনি চশমা কিনে বিক্রি শুরু করেন। এ প্রসঙ্গে তউবা বলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম এখানে সবাই ধনী। কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। তবুও আমি কখনোই আর্জেন্টিনায় আসার সিদ্ধান্তে অনুতপ্ত হইনি।’
সংগ্রামী জীবনের মাঝেই বক্সিংয়ের সঙ্গে পরিচয়। প্রথম পরিচয়েই জীবনের নতুন পথ খুঁজে নেন। এ প্রসঙ্গে তউবা নিয়াং বলছিলেন, ‘২০২১ সালে আমি প্রথমবার বক্সিং শুরু করি। শুরুর পরই আমি বুঝে যাই—এটাই আমার পথ।’ এল পরভেনির ক্লাবের হাভিয়ে সেগোভিয়ার অধীনে তিনি প্রশিক্ষণ শুরু করেন। পরে তিনি হরিজোন্তে জিমে দানিয়েল স্যালগুয়েরোর অধীনে নিজেকে পরিণত করছেন।
২০২৪ সালের ২৩ নভেম্বর তউবা নিয়াং পেশাদার বক্সিংয়ে পা রাখেন। প্রথম রাউন্ডেই প্রতিপক্ষকে কিক-আউট করেন। পরে আসে টানা ছয় জয়। ব্যাস, আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। টানা ছয় জয়ের চারটি ছিল নকআউট। শেষ লড়াইয়ে প্রতিপক্ষকে কুপোকাত করতে সময় নিয়েছিলেন মাত্র ৫৩ সেকেন্ড।
জীবনের অনিশ্চয়তা অতীত, নিজেকে ক্রমেই গড়ছেন তউবা; ভাবছেন আর্জেন্টিনার নাগরিকত্ব গ্রহণ করবেন। এ প্রসঙ্গে ফুটপাত থেকে বক্সিং তারকা বনে যাওয়া তউবা নিয়াং বলেন, ‘আর্জেন্টিনা আমার দ্বিতীয় দেশ। আমি যেখানে লড়াই করি, সেখানেই সেনেগাল ও আর্জেন্টিনাকে প্রতিনিধিত্ব করব।’
এ বক্সারের চূড়ান্ত লক্ষ্য বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়া। বর্তমানে বেটলিং সিকি একমাত্র সেনেগালিজ; যিনি বক্সিংয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। তিনি বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়া প্রথম আফ্রিকান বক্সারও। সেটা ১৯২২ সালের ঘটনা। ধুলোর প্রলেপ জমে থাকা রেকর্ড বই কি খুলতে পারবেন তউবা নিয়াং! এ যাত্রাও নিজের ওপর বিশ্বাস রাখছেন ২৪ বছরের টগবগে যুবক, ‘আমি নিশ্চিত কাজটা করতে পারব। শুধু সময় আর পরিশ্রমের ব্যাপার।’
মন্তব্য করুন