এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগটি ২০০০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত মূলত ঢাকাকেন্দ্রিক ছিল। এখন এটি দেশের প্রত্যন্ত গ্রামেও বিস্তৃত হয়েছে। আগে সংক্রমণ ঢাকায় শুরু হয়ে সারা দেশে ছড়ালেও এ বছর প্রথমবারের মতো বরগুনার মতো একটি প্রত্যন্ত জেলা থেকে ছড়াতে শুরু করেছে। দিন দিন এডিস মশার ঘনত্ব ও প্রজনন ক্ষেত্র বাড়ছে। অতীতে ঢাকার সুনির্দিষ্ট ও চিহ্নিত প্রজনন ক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। সেখানে গ্রামীণ এলাকার অনির্দিষ্ট প্রজনন ক্ষেত্র চিহ্নিত করে সেগুলো ধ্বংস করা প্রায় অসম্ভব। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আগামী বছরগুলোতে দেশে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুসহ অন্যান্য রোগ নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়তে পারে।
তাদের মতে, গ্রামে খালবিল, নালা-ডোবা, গর্তে পানি জমে মশার প্রজননস্থল তৈরি হয়। গবাদিপশুর আস্থাবল ও খাদ্যপাত্র, বর্ষার পানির ধারণ পাত্র, এমনকি গাছের গর্ত বা নারিকেল-সুপারি-তালগাছের পাতার ফাঁকে জমে থাকা পানিও এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র। কোন এলাকায় লার্ভার ব্রুট ইনডেক্স (বিআই) বেশি এবং কোন প্রজনন ক্ষেত্র বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, তা জানা না থাকলে মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এভাবে চলতে থাকলে ভেক্টরবাহিত রোগগুলো ইমার্জিং ও রি-ইমার্জিং আকারে মারাত্মক বিস্তার ঘটাবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার প্রাক্তন পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমদ বলেন, ‘এ বছরই দেশে প্রথমবারের মতো ঢাকার বাইরের একটি জেলা ডেঙ্গুর হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। অর্থাৎ ডেঙ্গু এখন রাজধানীকেন্দ্রিক রোগ থেকে প্রান্তিক রোগে পরিণত হয়েছে। বিগত দুই দশক রোগটি ঢাকা থেকে ছড়ালেও রোগতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে আগামী দুই দশক এটি প্রান্তিক এলাকা থেকে ছড়াবে, যা নিয়ন্ত্রণ সহজ নয়।’
কীটতাত্ত্বিক তথ্যানুযায়ী, এডিস মশার দুটি প্রজাতি—এডিস ইজিপ্টাই ও এডিস অ্যালবোপিকটাস। দুটিই ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকা ভাইরাস ছড়ায়। এডিস ইজিপ্টাই সাধারণত ডেঙ্গুর প্রধান বাহক, তবে এডিস অ্যালবোপিকটাসও গুরুত্বপূর্ণ। এডিস ইজিপ্টাই গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে বাস করে, দিনে কামড়ায়, বিশেষ করে সকাল ও সন্ধ্যায়। এর শরীরে কালো-সাদা ডোরা থাকে এবং বুকে লায়ারের মতো চিহ্ন দেখা যায়। এটি ডেঙ্গু, পীতজ্বর ও চিকুনগুনিয়া ছড়ায়। এডিস অ্যালবোপিকটাসকে এশিয়ান টাইগার মশা বা বনমশা বলা হয়। এটি বাড়ির আশপাশে ও বনে পাওয়া যায়, দিনের বেলায় কামড়ায় এবং ডেঙ্গু, ল্যাক্রস ও ওয়েস্ট নীল ভাইরাস ছড়ায়। এডিস মশা পরিষ্কার ও বদ্ধ পানিতে ডিম পাড়ে, আর প্রতিকূল পরিবেশে সেই ডিম দীর্ঘদিন সুপ্তাবস্থায় থাকতে পারে।
অনুপ্রাণ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মো. শেখ শহীদ উল্লাহ বলেন, ‘শুরুর দিকে ডেঙ্গু সংক্রমণ ঢাকায় থাকলেও বর্তমানে সেটা খুলনা ও বরিশাল বিভাগসহ সারা দেশে ছড়াচ্ছে। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে যাতায়াত সহজ হওয়ায় অনেক রোগী দ্রুত ঢাকায় যাতায়াত করছেন। আক্রান্ত ব্যক্তি প্রান্তিকে গেলে মশার কামড়ে নতুন চক্র শুরু হয় এবং সুস্থ মানুষের শরীরে রোগ ছড়ায়। ঢাকায় মশার প্রজননস্থল সীমিত হওয়ায় নিধন সহজ; কিন্তু গ্রামে পুকুর, খানাকান্দক, নালা, ডোবা ইত্যাদি থাকায় সেখানে নিয়ন্ত্রণ কঠিন। তার ওপর গ্রামীণ মানুষের সচেতনতা ও অভিজ্ঞতাও কম।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মশাবাহিত ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়ার ভয়াবহতা বাড়ছে, সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জিকা আতঙ্ক। ডেঙ্গু বাংলাদেশে আসার পর থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি ছিল ২০২৩ সালে, যখন আক্রান্ত হন ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন এবং মারা যান ১ হাজার ৭০৫ জন। ২০২৪ সালে আক্রান্ত ছিলেন ৭ হাজার ৫২৩ জন এবং মৃত্যু হয় ৬২ জনের।
জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (নিপসম) কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. গোলাম ছারোয়ার বলেন, ‘মশা দমনে লার্ভা ও পূর্ণাঙ্গ মশার ঘনত্ব জরিপ অপরিহার্য। এটি যত বেশি হবে, তত কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। কিন্তু রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগ আগে সিডিসি অপারেশনাল প্ল্যানের অর্থায়নে জরিপ চালাত, বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর তা বন্ধ হয়ে গেছে। এতে ২০২৪ সালের বর্ষা-পরবর্তী জরিপকে ২০২৫ সালের বর্ষা-পূর্ববর্তী জরিপ ধরা হয়েছে এবং ২০২৫ সালের বর্ষাকালীন জরিপ হয়নি। বর্ষাকালে জরিপ না হলে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা লাগামছাড়া হবে।’
গত ২৪ ঘণ্টায় পরিস্থিতি: ডেঙ্গুতে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। এতে চলতি বছরে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০৩ জনে। গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩৭৪ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম জানায়, ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে বরিশালে ৬৩ জন, চট্টগ্রামে ১০২, ঢাকা বিভাগে ৬৭, ঢাকা উত্তর সিটিতে ৪৬, ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ৪৮, ময়মনসিংহে ৩৭ এবং রাজশাহীতে ১১ জন। এ সময়ে ৩৭০ জন সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন। চলতি বছর ছাড়পত্র পেয়েছেন ৪৬ হাজার ৩৫৮ জন। বর্তমানে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ৭৮৭ ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, জানুয়ারিতে ১০ জন, ফেব্রুয়ারিতে তিন, এপ্রিলে সাত, মে মাসে তিন, জুনে ১৯, জুলাইয়ে ৪১, আগস্টে ৩৯ এবং সেপ্টেম্বরে ৭৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।
মন্তব্য করুন