রাজকুমার নন্দী
প্রকাশ : ২২ নভেম্বর ২০২৩, ০৩:৩৯ এএম
আপডেট : ২২ নভেম্বর ২০২৩, ১০:৩৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বিএনপি ভাবছে ভোটের বাইরে রাখতেই কারাদণ্ড

শঙ্কা ছিল আগেই
বিএনপির লোগো।
বিএনপির লোগো।

সরকার আবারও বিএনপিবিহীন একতরফা নির্বাচন করতে চায় বলে মনে করছে দলটি। নেতাদের দাবি, রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া ‘একতরফা’ তপশিল এবং নেতাদের কারাদণ্ড ও গ্রেপ্তারের ঘটনা বিএনপিকে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বাইরে রাখারই অংশ। গত ৯ অক্টোবর থেকে ২০ নভেম্বর পর্যন্ত বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের ৩২৭ নেতাকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকের অভিমত, সরকারি দল ও নির্বাচন কমিশন একদিকে বিএনপিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের কথা বলছে, অন্যদিকে নির্বাচনে যারা প্রার্থী হবেন, দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, সাজা দেওয়া হচ্ছে। তা ছাড়া এখন বিএনপির জন্য রাজনৈতিক কোনো স্পেস নেই। দলীয় কার্যালয় অবরুদ্ধ, পুলিশের নিয়ন্ত্রণে। নেতাকর্মীরা গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে রয়েছেন। এভাবে সংকট উত্তরণ সম্ভব নয়। এজন্য নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি করতে হবে। যদিও শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে বিএনপি এখনো অনড়।

বিএনপির পক্ষ থেকে বেশ আগেই শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল, নির্বাচনের আগেই গায়েবি ও রাজনৈতিক মামলায় নেতাদের সাজা দেওয়া হতে পারে। এর মধ্য দিয়ে যারা নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন, তাদের অযোগ্য ঘোষণা করা হতে পারে। বর্তমানে কারাগারে থাকা বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে এমন শঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন। ‘গায়েবি’ মামলায় দ্রুত সাজা দিতে আইন মন্ত্রণালয়ে বিশেষ সেল খোলার অভিযোগও করেছিল দলটি। এ ছাড়া গত এপ্রিলে খালেদা জিয়ার সঙ্গে ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা বিনিময়কালে নির্বাচন সামনে রেখে দলের ৩৬৯ জন নেতার সাজার শঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য। তবে এতে উদ্বিগ্ন না হয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। তিনি বলেছিলেন, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় হলে সেটিই হবে বড় অর্জন। তখন প্রয়োজনে দলের দ্বিতীয় সারির নেতারা নির্বাচন করবেন। কারণ, বিএনপিতে নেতার কোনো সংকট নেই।

বিএনপির দাবি, নেতাদের সাজা, গ্রেপ্তার, হামলা-মামলা করে সরকারবিরোধী একদফার চলমান আন্দোলন দমানো যাবে না। শিগগির পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তনের আশাবাদ ব্যক্ত করে তৃণমূলে আন্দোলন চালিয়ে যেতে দলের হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

দলটির নেতাদের দাবি, বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন হলে আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তখন নেতাদের সাজার বিষয়টি নিষ্পত্তি হবে। তাদের প্রত্যাশা, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক করতে পশ্চিমা বিশ্বের অব্যাহত চাপে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সমঝোতামূলক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। আর উপযুক্ত নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি হলে বিএনপিতে প্রার্থীর অভাব হবে না। কারণ, দলে প্রার্থীর কোনো সংকট নেই। প্রতিটি আসনে তিন থেকে পাঁচজন যোগ্য প্রার্থী রয়েছেন বলে দাবি বিএনপির।

তবে নির্বাচনের ঠিক আগে বিরোধী দলের নেতাদের সাজার ঘটনা নির্বাচনী পরিবেশ বিঘ্নিত করবে বলে মনে করেন অনেক নির্বাচন বিশ্লেষক। এ প্রসঙ্গে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন কালবেলাকে বলেন, বিএনপি নেতাদের কী অপরাধে সাজা দেওয়া হচ্ছে সেটা জানি না, গায়েবি মামলা কি না—সেটিও জানি না। কিন্তু এর ফলে নির্বাচনী পরিবেশ বিঘ্নিত হবে। অনেকে মনে করছেন, বিএনপি যাতে নির্বাচনে আসতে না পারে, সেজন্য এটি করা হচ্ছে। নির্বাচন এগিয়ে আসায় এটি মনে করার কথাও। এটি ভালো কোনো বিষয় নয়। তিনি আরও বলেন, একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে এটি এক ধরনের বাধা। যদি এর মধ্যে দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা থাকেন, সেক্ষেত্রে তারা যদি নির্বাচনে আসতেও চান, আসতে পারবেন না। তাদের উচ্চ আদালতে যেতে হবে, আপিল করতে হবে। আপিলে যদি সাজা বাতিল হয়, তাহলে তো হলো। কিন্তু শত শত, হাজার হাজার নেতা যদি জেলেই থাকে, তাহলে তারাই বা কীভাবে নির্বাচনের জন্য তৈরি হবে, করবেই বা কেন—

জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হলে বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর ব্যাপক ভরাডুবি হবে ভেবেই তারা বিএনপির শীর্ষ নেতাদেরসহ সব পর্যায়ের নেতাকর্মীকে গণহারে গ্রেপ্তার করে কারান্তরীণ রেখে এবং দণ্ডাদেশ দিয়ে একতরফা নির্বাচন করতে চাচ্ছে। বিএনপিকে নির্বাচনী মাঠ থেকে সরিয়ে দিয়ে আওয়ামী শাসকগোষ্ঠী তাদের গৃহপালিত কিছু রাজনৈতিক দল নিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চাচ্ছে। আবারও যেনতেন নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করতে এটি তাদের মাস্টারপ্ল্যান।

তিনি আরও বলেন, ২০১৪ এবং ২০১৮-এর মতো নির্বাচন এবার আর করতে দেবে না দেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ। নির্যাতন-নিপীড়নের মাত্রা যত বাড়বে বিএনপিসহ বিরোধী নেতাকর্মী ও জনগণ আরও বলীয়ান হয়ে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করেই ঘরে ফিরবে।

জানা গেছে, বিভিন্ন মামলায় গত ৯ অক্টোবর থেকে ২০ নভেম্বর পর্যন্ত বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের ৩২৭ জন নেতার বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। রাজধানীতে নাশকতার অভিযোগে সাত মামলায় গত সোমবার বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের ১৪০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়। এর মধ্যে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, তথ্যবিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল, যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নিরব, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজীব আহসান, ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রশিদ হাবিব ও আকরামুল হাসানসহ ২৫ জনকে দুই বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া গত ১৬ নভেম্বর শ্যামপুর থানার এক মামলায় বিএনপির ১০ নেতাকর্মীর দুই বছরের সাজা দেন আদালত। গত মে মাসে দুদকের মামলায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর ৯ বছর এবং ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমানের ১৩ বছরের সাজা বহাল রাখেন হাইকোর্ট। এই মামলায় আমান এখন কারাগারে। ৯ অক্টোবর নাশকতার অভিযোগে ভাটারা থানার মামলায় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও নোয়াখালী-৪ আসনের সাবেক এমপি মো. শাহজাহান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিব এবং কুষ্টিয়া-২ আসনের সাবেক এমপি আহসান হাবিব লিংকনসহ ১৫ জনকে চার বছর করে কারাদণ্ড দেন আদালত। এই মামলায় শাহজাহান এবং লিংকন এখন কারাগারে। এর আগে বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রকাশনাবিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক এমপি হাবিবুল ইসলাম হাবিবকেও সাজা দেওয়া হয়।

বিএনপি নেতারা বলছেন, নির্বাচন সামনে রেখে দলের সম্ভাব্য এমপি প্রার্থী ও গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের যে সাজা দেওয়া হতে পারে, এমন শঙ্কা তাদের আগেই ছিল। গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে করেছে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব ও বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, সাজা প্রদান করা প্রতিটি মামলা আইনজীবী হিসেবে পর্যালোচনায় দেখেছি, সাজাপ্রাপ্ত রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে কোনো অপরাধের সংশ্লিষ্টতা নেই। কোনো ফৌজদারি অপরাধ প্রমাণ করতে হয় সাক্ষ্যপ্রমাণ দিয়ে। অধিকাংশ মামলায় সাক্ষী হিসেবে শুধু পুলিশ সদস্যকে হাজির করিয়ে সাজা দেওয়া হয়েছে। বিচারিক প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই তড়িঘড়ি করে বিএনপির নেতাদের সাজা দেওয়া হয়েছে।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংবিধানের ৬৬(২)(ঘ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কেউ নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষীসাব্যস্ত হয়ে কমপক্ষে দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং মুক্তি লাভের পর পাঁচ বছর অতিবাহিত না হলে তিনি কোনো নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না।

২০১৮ সালে দণ্ডপ্রাপ্ত বেশ কয়েকজন বিএনপি নেতা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগের দাবিতে সর্বোচ্চ আদালতে আবেদন করেছিলেন। আবেদনটি শুনে ওই বছরের ২৭ নভেম্বর আপিল বিভাগ বলেছিলেন, আপিল বিচারাধীন থাকলেও বিচারিক আদালতে দুই বছরের বেশি সাজাপ্রাপ্তরা যতক্ষণ পর্যন্ত উচ্চ আদালত থেকে খালাস না পাবেন এবং উচ্চ আদালত সাজা স্থগিত না করবেন, ততক্ষণ দণ্ডিত কারও নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ থাকবে না।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

পারভেজ হত্যার মূল আসামি গ্রেপ্তার

পোপ ফ্রান্সিসের মৃত্যুতে শোকবার্তা দিয়ে আবার প্রত্যাহার করল ইসরায়েল

ছাত্রলীগ নেতার যে কথায় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে আদালত 

কুয়েটের ৩৭ শিক্ষার্থীর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার

দিনাজপুরে ভুয়া সেনা সদস্য গ্রেপ্তার

কাশ্মীর ইস্যুতে প্রধান উপদেষ্টার নিন্দা

অর্থ পাচারকারীরা শয়তানের মতো, এদের ধরা মুশকিল : দুদক কমিশনার

এক দিন পরেই সোনার দামে বড় পতন

জম্মু-কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলায় বাংলাদেশের নিন্দা

আইন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা কর্মচারী কল্যাণ সমিতির নতুন সভাপতি জিল্লুর, সম্পাদক সাইদুল

১০

কাশ্মীরে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার ভিডিও প্রকাশ

১১

কাশ্মীর হামলা নিয়ে মুখ খুললেন ভারতের মুসলিম নেতা

১২

প্রাইম এশিয়া শিক্ষার্থী হত্যায় বৈষম্যবিরোধী নেতা রিমান্ডে 

১৩

এবার গৃহকর্মীর বিরুদ্ধে পরী মণির মামলা

১৪

রাস্তা অবরোধ করে যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করার অনুরোধ ডিএমপির

১৫

কুয়েট ভিসির পদত্যাগ দাবিতে জবি শিক্ষার্থীদের অবস্থান

১৬

ওয়ালপ্যাড ৯জি : অত্যাধুনিক ফিচারসমৃদ্ধ ওয়ালটনের নতুন অ্যান্ড্রয়েড ট্যাব

১৭

আবাসন সংকট নিরসনসহ চার দফা দাবিতে জবি শিক্ষার্থীদের স্মারকলিপি

১৮

কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলা, দুই বিদেশিসহ তিন সন্দেহভাজন চিহ্নিত

১৯

ঘরের মাঠে লজ্জার মুখে টাইগাররা

২০
X