আব্দুল্লাহ আল জোবায়ের
প্রকাশ : ২৯ জানুয়ারি ২০২৪, ০৩:১৬ এএম
আপডেট : ৩০ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন থাকছে না সরকারি কলেজ

বাড়বে শিক্ষার মান
কালবেলা গ্রাফিক্স
কালবেলা গ্রাফিক্স

প্রায় ৩০ লাখ শিক্ষার্থীর ভারে ন্যুব্জ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। অধিভুক্ত সরকারি কলেজগুলোয় মানসম্মত শিক্ষা দান নিয়ে বিভিন্ন সময়ই প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। এ কারণে সরকারি কলেজগুলো পার্শ্ববর্তী বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধীনে নিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশনা দেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসনের পরও বিভিন্ন অজুহাতে কলেজগুলোকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেওয়া সম্ভব হয়নি। মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল নতুন শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন বাস্তবায়নে ব্রতী হয়েছেন। এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন বাস্তবায়নের পাশাপাশি কলেজগুলোর শিক্ষার মান আরও বাড়বে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। বেসরকারি কলেজগুলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনেই থাকছে।

জানা যায়, একসময় স্নাতক (সম্মান) পড়ানো হয়—এমন কলেজগুলো কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ছিল। ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। এটি মূলত একটি অ্যাফেলিয়েট বিশ্ববিদ্যালয়। তখন কলেজগুলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়। কিন্তু যে উদ্দেশ্য নিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, সেই উদ্দেশ্য প্রতিষ্ঠানটি ঠিকমতো পূরণ করতে পারেনি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এ ছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোর শিক্ষার মান নিয়েও বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। এ কারণে ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান কাঠামো ভেঙে দিতে বলেন। যদিও সেটি পরে আর বাস্তবায়ন হয়নি।

২০১৪ সালের ৩১ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে গিয়ে সরকারি কলেজগুলোকে সংশ্লিষ্ট এলাকায় অবস্থিত সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেওয়ার অনুশাসন দেন। নির্দেশনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ওই বছরের ৭ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে (ইউজিসি) পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যদের নিয়ে সভা হয়। সভায় উপাচার্যরা কলেজগুলোকে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নিতে একমত হন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্নাতক (সম্মান) পড়ানো হয়—এমন সরকারি কলেজগুলোকে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ইউজিসিতে উপাচার্যদের নিয়ে অনুষ্ঠিত সভায় পক্ষে মত এলে তা বাস্তবায়নে কমিটি করা হয়। কিন্তু এই কমিটি কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি।

সে সময় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেশনজট কমাতে ‘ক্র্যাশ প্রোগ্রাম’ (সেশনজট নিরসনের জন্য দ্রুত ফরম পূরণ, পরীক্ষা গ্রহণ ও ফলাফল প্রকাশের উদ্যোগ) ঘোষণা করে। এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে দ্রুত পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হলেও ঠিকমতো ক্লাস না হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। নানা জটিলতার কথা তুলে অধিভুক্ত করার কাজটি সময়মতো বাস্তবায়ন করা হয়নি। এরপর ২০১৫ সালের মে মাসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সাবেক শিক্ষা সচিব নজরুল ইসলাম খানকে চিঠি দিয়ে অনুশাসন বাস্তবায়নে ফের নির্দেশনা দেওয়া হয়। এর মধ্যে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা রাজধানীর সাতটি বড় সরকারি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। শুরুতে এসব কলেজের সময়মতো পরীক্ষার ফল প্রকাশসহ শিক্ষা কার্যক্রমে বেশ কিছু সমস্যা হয়। এ নিয়ে তখন আন্দোলনও হয়েছিল। তবে এখন এই কলেজগুলোর কার্যক্রম স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসছে। কলেজগুলোর শিক্ষা কার্যক্রমেও কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। প্রতিবছর স্নাতক পর্যায়ে এই কলেজগুলোতে ২১ হাজার ৫১৩ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পান। এ অবস্থায় দেশের অন্য সরকারি কলেজগুলোকেও বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

নবনিযুক্ত শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী দায়িত্ব নিয়েই প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি সরকারি কলেজগুলোকে অধিভুক্ত করে একাডেমিক মনিটরিংয়ের (শিক্ষার মানে নজরদারি) দায়িত্ব নিতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের পরামর্শ দিয়েছেন। একই সঙ্গে শুরুতেই নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় স্নাতক কোর্স চালু না করে সরকারি কলেজের একাডেমিক কার্যক্রম মনিটরিংয়ের দায়িত্ব নিতে বলেছেন।

জানা যায়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত কলেজের সংখ্যা ২ হাজার ২৫৭টি। আর এসব প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়নরত প্রায় ৩০ লাখ শিক্ষার্থী। এর মধ্যে সরকারি কলেজের সংখ্যা ৫৮৩টি। তবে এর মধ্যে ৩৭৩ সরকারি কলেজে স্নাতক পর্যায়ে পড়ালেখার সুযোগ রয়েছে। শুধু সরকারি কলেজে মোট শিক্ষার্থীর ৬০ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ১৭ লাখ শিক্ষার্থী পড়ালেখা করেন। সরকারি কলেজগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে গেলে এসব শিক্ষার্থী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কমে যাবে।

ইউজিসি তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনের সুপারিশে একাধিকবার বলেছে, কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজ থেকে স্নাতক সনদধারীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ এবং তাদের গুণগত মানও আশানুরূপ নয়। এতে উচ্চশিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটলেও শিক্ষার প্রত্যাশিত মান নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. মশিউর রহমান কালবেলাকে বলেন, কয়েকটি কলেজ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া আরও আগেই শুরু হয়েছে। সবগুলো করা না গেলেও কয়েকটি দ্রুত করতে পারে সরকার। তিনি বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তির আয়ের বিষয়টি নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হচ্ছে। যারা আলোচনা করছে, তাদের উল্টো প্রশংসা করা উচিত এজন্য যে, এত জঞ্জালের মধ্যে, এত বেশি পরিমাণ টাকা কীভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে তা ভেবে। করোনার মধ্যেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ড থেকে সরকারকে ১ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন সংশোধনের প্রয়োজন হলে সেটি করা হোক। প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যাতে ভবিষ্যতে কোনো সমস্যায় পড়তে না হয় সেটিও বিবেচনা করা উচিত। কারণ, অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ও সরকারের।

এদিকে, সরকারের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (রুটিন দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, নতুন শিক্ষামন্ত্রী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের সরকারি কলেজগুলোকে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় নিয়ে আসার কথা বলেছেন। এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। কলেজগুলোকে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় আনলে কলেজগুলোই লাভবান হবে। কারণ, এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা মেধাবী শিক্ষকদের সংস্পর্শে আসবে। গতানুগতিক শিক্ষা থেকে বের হয়ে তারা গবেষণামুখী হতে পারবে।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর বলেন, শিক্ষা প্রশাসন এবং শিক্ষা কার্যক্রমের গুণগত মান নিশ্চিত করার জন্য এটি প্রথম পদক্ষেপ। কলেজগুলোতে শিক্ষার যে মান তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সে কারণে কলেজগুলো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে এলে গুণগত মান নিশ্চিত হবে। দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহিও নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও বাস্তবতা বিবেচনার বিষয়টিও নজরে এনেছেন অনেকেই। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. হাসিবুর রশিদ বলেন, নতুন কলেজগুলোকে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় আনতে খুব বেশি সমস্যা নেই। পুরোনো কলেজগুলোর বেশিরভাগই পার্শ্ববর্তী সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আগে প্রতিষ্ঠিত। এ কারণে এসব কলেজ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নেওয়ার আগে বিবেচনা করা উচিত, যাতে ভারসাম্য নিশ্চিত করা যায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আবদুস সাত্তার বলেন, এটি এখনো প্রস্তাব আকারেই আছে। বাস্তবায়ন করতে গেলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে কী আছে তাও দেখতে হবে। এরপর সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, সরকারের এই সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছি। কলেজগুলোর মনিটরিং পার্শ্ববর্তী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় করলে সেখানে মানসম্মত পড়াশোনা নিশ্চিত করা যাবে। তাই এই সিদ্ধান্ত দ্রুত বাস্তবায়ন চাই।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

‘সব দোষ পাকিস্তানিদের’

দেড় কোটি টাকার কষ্টিপাথরের মূর্তিসহ যুবক গ্রেপ্তার

ভারতের আরেকটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিতের দাবি পাকিস্তানের

ট্রাম্পের কথায় ‘ভারত-পাকিস্তান উভয়ই খুশি’

পাবনায় বিএনপি-জামায়াত দফায় দফায় সংঘর্ষে আহত ৩০

মানবাকৃতিতে জে-১০সি বানিয়ে পাকিস্তানের বাহিনীকে শ্রদ্ধা

পাক-ভারত যুদ্ধবিরতি ১৮ মে পর্যন্ত, এরপর?

‘সুপার পাওয়ার’ ভারতের অহংকার চূর্ণ করেছে পাকিস্তান

ভারত যুদ্ধবিরতির প্রতিশ্রুতি রক্ষা নাও করতে পারে : বিলাওয়াল

শুক্রবার রাজধানীর যেসব এলাকার মার্কেট বন্ধ

১০

১৬ মে : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১১

তথ্য উপদেষ্টার ওপর হামলা : সিইউজে ও চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব নেতাদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া

১২

১৬ মে : আজকের নামাজের সময়সূচি

১৩

সহজ জয়ে লা লিগা শিরোপা নিশ্চিত বার্সার

১৪

স্বাস্থ্য পরামর্শ / ডায়াবেটিসজনিত পায়ের ক্ষত ও পিআরপি চিকিৎসা

১৫

শ্রমিকদল নেতা হত্যায় গ্রেপ্তার আরেক শ্রমিক দল নেতা

১৬

বিএনপির এক নিভৃত নেতৃত্ব আতিকুর রহমান রুমন

১৭

১৪ মে-কে জবির ‘কালো দিবস’ ঘোষণা, নতুন কর্মসূচি গণ-অনশন

১৮

জামালপুর জেলা ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণা—সভাপতি সুমিল, সম্পাদক শফিক

১৯

মানবিক করিডোর ও বন্দর নিয়ে সিদ্ধান্ত দেশবাসী মেনে নেবে না : জমিয়ত

২০
X