আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানুষকে সৃষ্টির সঙ্গে নারী-পুরুষের বন্ধন ও আকর্ষণও দিয়েছেন। পুরুষ নারীর প্রতি আকৃষ্ট হবে এবং নারী পুরুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইবে—এটা সৃষ্টিগত এবং প্রাকৃতিক বিষয়। নারী-পুরুষের পারস্পরিক এই আকর্ষণ বাস্তবে রূপ দিতে সৃষ্টিকর্তা বিয়ের বিধান দিয়েছেন। বিয়ে না করলে কিংবা নারী-পুরুষের এই প্রকৃতিগত আকর্ষণবোধ বৈধ উপায়ে বাস্তবায়ন না করলে মানুষ অবৈধ উপায়ে তা করবে। যা অনেক বড় ক্ষতি সাধন করে মানুষের জীবনে, সমাজে, প্রকৃতিতে এবং পরকালের জীবনে। এমনকি কিছু সাহাবি বিয়ে-শাদি না করে সারা দিন ইবাদত-বন্দেগি ও রোজা-জিকির ইত্যাদিতে কাটিয়ে দিতে চাইলে আল্লাহর রাসুল শক্ত ভাষায় এর বিরোধিতা করেন এবং বলেন, বিয়ে আমার আদর্শ, যে এটা এড়িয়ে চলবে সে আমার উম্মত হতে পারবে না।
সৃষ্টির প্রথম মানুষ আদম (আ.) জান্নাতে যখন একাকীত্ব অনুভব করলেন, তখন তার সঙ্গী হিসেবে হাওয়া (আ.)-কে জোড়া বানিয়ে দিয়েছেন আল্লাহ। পৃথিবীর প্রথম দম্পতির বিয়ে স্বয়ং আল্লাহ পড়িয়েছেন। সে থেকেই শুরু নারী-পুরুষের পারস্পরিক আকর্ষণ ও শূন্যতাবোধ। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ইচ্ছায় আদম-হাওয়া (আ.) পৃথিবীতে এলেন এবং তাদের ঔরসজাত সন্তানেরাই পৃথিবী সাজিয়ে চলেছে। সৃষ্টির সেই সময় থেকে ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে এই বিয়ের রীতি। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘আল্লাহর নিদর্শনসমূহের মধ্যে অন্যতম হলো— তিনি তোমাদের মধ্য থেকে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জীবনসঙ্গিনী, যাতে তোমরা তাদের নিকট প্রশান্তি লাভ করতে পারো এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা রুম : ২১)। এজন্য প্রাপ্তবয়স্ক ও সামর্থ্যবান প্রতিটি নারী-পুরুষের বিয়ে করা মানবিক, প্রাকৃতিক ও ইমানি দায়িত্ব। বিয়ে শুধু জৈবিক চাহিদাই নয়, বরং একটি মহান ইবাদতও বটে। বিয়ের মাধ্যমে ইহ ও পরকালীন কল্যাণ সাধিত হয়। বিয়ে মানুষের জীবন পরিশীলিত, মার্জিত ও পবিত্র করে তোলে।
বিয়ের প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা, যিনি নারী ও পুুরুষকে সৃষ্টি করেছেন। শুধু তাই নয়, যারা বিয়ে করেছে, তাদের প্রতি আল্লাহ সরাসরি এ নির্দেশ দিয়েছে—যারা বিয়ে করেনি তাদের বিয়ে করিয়ে দাও। কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহহীন, তোমরা তাদেরকে বিয়ে করিয়ে দাও এবং তোমাদের দাস-দাসীদের মধ্যে যারা সৎকর্মপরায়ন, তাদেরও। তারা যদি নিঃস্ব হয়, তবে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের সচ্ছল করে দেবেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ। যারা বিয়েতে সামর্থ্য নয়, তারা যেন সংযম অবলম্বন করে—যে পর্যন্ত না আল্লাহ অনুগ্রহ করে তাদের অভাবমুক্ত করে দেন।’ (সুরা নুর : ৩২-৩৩)। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, ‘হে যুব সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্যে যে বিয়ের সামর্থ্য রাখে, সে যেন বিয়ে করে নেয়, কেননা তা চক্ষুকে সংযত রাখে এবং লজ্জাস্থান রক্ষা করে। (বুখারি : ৫০৬৬; মুসলিম : ১৪০০)
যারা বিয়ে করে না, তাদের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন রাসুল (সা.)। হাদিসে আছে, তিনজন ব্যক্তি আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর ঘরে আসলেন। তারা ঘরবাসীদের রাসুল (সা.)-এর ইবাদত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। তার ইবাদতের কথা শুনে তারা যেন বলল, কোথায় আল্লাহর রাসুল (সা.) আর কোথায় আমরা? তার আগের ও পরের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে। তখন তাদের একজন বলল, আমি সারাজীবন রাতভর ইবাদত করব। আরেকজন বলল, আমি আজীবন রোজা রাখব। কখনো রোজা ভাঙব না। অন্যজন বলল, আমি নারীদের থেকে দূরে থাকব; কখনো বিয়ে করব না। আল্লাহর রাসুল (সা.) তখন তাদের কাছে এসে বললেন, ‘আরে! তোমরা এমন-অমন বলছো! অথচ আমি তোমাদের সবার চেয়ে বেশি আল্লাহকে ভয় করি। কিন্তু আমি রোজা রাখি, আবার ইফতারও করি। নামাজ পড়ি, আবার ঘুমও যাই। নারীকে বিয়েও করি। অতএব, যারা আমার সুন্নত ছেড়ে দেবে, তারা আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ (বুখারি : ৫০৬৩; মুসলিম : ১৪০১)
ইসলামে বিয়ের বিষয়ে এত গুরুত্ব দেওয়ার পরও অনেক সময় অর্থ-সংকটের কথিত অজুহাতে পিতামাতারা ছেলে-মেয়েকে বিবাহ দিতে গড়িমসি করেন। আবার অনেক যুবক-যুবতীও ক্যারিয়ারের কথা বলে বিয়ে করতে টালবাহানা করেন। কিন্তু মানুষের সৃষ্টিগত প্রাকৃতিক তাড়না থেকে তো কোনো মানুষের পক্ষেই দূরে থাকা সম্ভব নয়। যখন বৈধ উপায়ে স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবনে বিলম্ব করছে, অবৈধ প্রেম-ভালোবাসার মাধ্যমে সে তাড়না নিবারণ করছে। ইসলাম মানুষের প্রাকৃতির তাড়না নিবারণের জন্য বৈধ উপায় রেখেছে এবং অবৈধ প্রেম হারাম করেছে। এমনকি কাউকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যেও তার সঙ্গে বিবাহপূর্ব প্রেম নামের অবৈধ সম্পর্কের অবকাশ নেই। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, চোখের ব্যভিচার হলো বেগানা নারীকে দেখা, জিহ্বার ব্যভিচার হলো (তার সঙ্গে) কথা বলা (যৌন উদ্দীপ্ত কথা বলা)। (বুখারি: ৬২৪৩)। অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, দুই চোখের ব্যভিচার হলো, বেগানা নারীর দিকে তাকানো, কানের ব্যভিচার যৌন উদ্দীপ্ত কথা শোনা, মুখের ব্যভিচার আবেগ উদ্দীপ্ত কথা বলা, হাতের ব্যভিচার (বেগানা নারীকে খারাপ উদ্দেশ্যে স্পর্শ করা আর পায়ের জিনা ব্যভিচারের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হওয়া এবং মনের ব্যভিচার হলো চাওয়া ও প্রত্যাশা করা। (মেশকাত: ৮৬)। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয় তা অশ্লীল কাজ ও মন্দ পথ। (সুরা ইসরা: ৩২)
মানুষ যখন প্রেমে পড়ে, তখন সে তার মনের মানুষকে না দেখে থাকতে পারে না। সে দূরে থাকলেও কমপক্ষে তার ছবি দেখে, অথবা তার সঙ্গে ফোনে কথা বলে, কমপক্ষে তাকে নিয়ে স্বপ্নের বাসরে হারিয়ে যায়, যার প্রতিটি স্তরকেই উল্লিখিত হাদিসগুলোতে হারাম বলা হয়েছে। কারও প্রতি সত্যিই দুর্বলতা চলে এলে, পারিবারিকভাবে তাকে বিয়ে করে নেওয়া উচিত। বিয়ে করার দৃঢ় সংকল্প থাকলেও কোনো বেগানা নারীর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা হারাম। আর বেশির ভাগ প্রেমের শেষ পরিণতিই হয় বিচ্ছেদ এবং সারাজীবনের কান্না। তাই প্রেম না করে বিয়ে করা উচিত। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যখন মানুষ বিয়ে করে, তখন সে তার দ্বীনের অর্ধেক পূরণ করে। অতএব, বাকি অর্ধেকাংশে সে যেন আল্লাহকে ভয় করে।’ (জামিউস সাগির: ৬১৪৮)
লেখক: ইমাম ও খতিব