‘খুব আবেগ নিয়ে বলছিল—‘বউ মিছিলে যাচ্ছি, আমার জন্য দোয়া করো।’ আমি বললাম, এভাবে কেন বলছ? তখন আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘মানুষের হায়াত-মউতের কথা বলা যায় না। নাও তো ফিরে আসতে পারি। আমি তখনো বুঝিনি তার এই যাওয়াই শেষ যাওয়া হবে। বাবা ফেরার মিথ্যা আশ্বাস নিয়ে ঘুমায় আমার মেয়েটা।’
গভীর এক শোক চেপে কাঁপা-কাঁপা গলায় কথাগুলো বলছিলেন গত ৪ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত যুবদল নেতা সোহানুর রহমান খান রঞ্জুর স্ত্রী মৌসুমী খাতুন (৩২)। এ সময় আড়াই বছর বয়সী মেয়ে রোজা বারবার মায়ের দিকে জিজ্ঞাসা ভরে তাকায়—তার বাবা কখন ফিরবে।
সোহানুর রহমান খান রঞ্জু (৪০) সিরাজগঞ্জ শহরের মাসুমপুর দক্ষিণপাড়া মহল্লার মৃত মাজেদ খানের ছেলে। বাবা ও মা শামসুন্নাহার অনেক আগেই প্রয়াত হয়েছেন। তিনি ঢাকায় একটি ডেন্টাল ক্লিনিক পরিচালনা করতেন। পরবর্তী সময়ে সিরাজগঞ্জ নিউমার্কেটে ‘খান ডেন্টাল’ নামে আরেকটি ক্লিনিক চালু করেন। তিনি সিরাজগঞ্জ পৌর যুবদলের সহসাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
সিরাজগঞ্জ পৌর এলাকার মাসুমপুর দক্ষিণপাড়া মহল্লার নিহত রঞ্জুর বাড়িতে গিয়ে কথা হয় তার স্ত্রী মৌসুমী খাতুনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বিয়ের আট বছর পর আমাদের একমাত্র সন্তান রোজার জন্ম হয়। রঞ্জু মেয়েকে ছাড়া কিছুই বুঝত না। মেয়েটিও বাবা বলতে পাগল ছিল। এখনো ও বাবার ফেরার অপেক্ষায় থাকে। প্রতিদিনই বাবার কথা বলে। বিভিন্ন আশ্বাস দিয়ে ওকে খাওয়াতে হয়। রাতে বাবা আসবে—এ কথা বলে ঘুম পাড়াতে হয়।’
কী ঘটেছিল সেদিন, সেই ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে মৌসুমী জানান, রঞ্জু যুবদল করতেন। জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের শুরুতে পুলিশের ভয়ে রাতে বাসায় থাকতেন না। আগস্টের ৩ তারিখ রাতেও বাইরে ছিলেন। পরদিন ৪ আগস্ট সকালে বাসায় আসেন। একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করেন, অনেক গল্পও করেন।
মৌসুমী বলেন, ‘ও (রঞ্জু) বলছিল, ‘মিছিলে যাবো’, আমি নিষেধ করে বলেছিলাম, গোলাগুলি হবে, তোমার যাওয়ার দরকার নেই। ও বলছিল, ‘আজ (৪ আগস্ট) গোলাগুলি হবে না। আমরা সবাই যাব মিছিলে।’ আমি আর বাধা দিইনি। খাওয়া শেষ করে যাওয়ার সময় খুব আবেগ নিয়েই বলছিল, ‘বউ মিছিলে যাচ্ছি, আমার জন্য দোয়া করো।’
এর প্রায় আধঘণ্টা পর তিনি জানতে পারেন সোহানুর রহমান খান রঞ্জু গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। দৌড়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে মৌসুমী জানতে পারেন তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে, সেখানে গিয়ে দেখেন তার স্বামী আর বেঁচে নেই। শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে ৬ আগস্ট সকালে কান্দাপাড়া কবরস্থানে দাফন করা হয়।
মৌসুমী বলেন, ‘গুলি করার পর তাকে অনেক মারধর করা হয়েছে। ডান চোখে সামনে থেকে গুলি লেগে পেছন দিয়ে বেরিয়ে গেছে।’
জুলাই আগস্টে রঞ্জুর আন্দোলন সংগ্রামের সঙ্গী মাসুমপুর ১ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সভাপতি ইবনে জায়েদ হাসু বলেন, ‘৪ আগস্ট এলাকা থেকে আমরা মিছিল নিয়ে যাই। রঞ্জু আমাদের সঙ্গেই ছিল। আমাদের অবস্থান ছিল বাজার স্টেশন এলাকায়; কিন্তু রঞ্জু কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে এস এস রোডে আওয়ামী লীগ অফিসের দিকে এগিয়ে যায়। আমি যেতে নিষেধও করেছিলাম, কিন্তু শোনেনি। কিছুক্ষণ পরই খবর এলো রঞ্জুকে গুলি করা হয়েছে।’
জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান বাচ্চু বলেন, রঞ্জু যুবদলের বলিষ্ঠ কর্মী। সে সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশ নিয়েছে। স্বৈরাচার হাসিনা সরকার পতন আন্দোলনের অগ্রসৈনিক ছিল সে।
সিরাজগঞ্জ সদর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) প্রণয় কুমার বলেন, এ হত্যা মামলায় সাবেক সংসদ সদস্য জান্নাত আরা হেনরী, সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শামীম তালুকদার লাবু, সাবেক পিপি-জিপি, ইউপি চেয়ারম্যানসহ একাধিক আসামি গ্রেপ্তার রয়েছে। বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। মামলার তদন্ত কার্যক্রম দ্রুতই এগিয়ে চলছে বলে জানান তিনি।
মন্তব্য করুন